নদীধারাগুলো সুরক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে : মার্ক অ্যাঞ্জেলো

।। রিভার বাংলা ডট কম ।।

সাক্ষাৎকার

মার্ক অ্যাঞ্জেলো বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিষ্ঠাতা এবং দিবসটির জাতিসংঘ চেয়ারপারসন। তিনি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির রিভার ইনস্টিটিউটের ইমেরিটাস সভাপতি। এ ছাড়া প্যাসিফিক ফিশারিজ রিসোর্সেস কনজারভেশন কাউন্সিলের সভাপতি ছিলেন। নদী সংরক্ষণে তার চার দশকের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ পদক ‘অর্ডার অব কানাডা’ লাভ করেছেন। লাভ করেছেন জাতিসংঘ স্টুয়ার্ডশিপ অ্যাওয়ার্ড এবং ন্যাশনাল রিভার কনজারভেশন অ্যাওয়ার্ড। তিনি বিশ্বের এক হাজারের বেশি নদী ভ্রমণ ও পরিদর্শন করেছেন। তার জন্ম ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : শেখ রোকন

দৈনিক সমকাল :আমরা প্রথমেই জানতে চাইব, কীভাবে বিশ্ব নদী দিবসের সূচনা করলেন?

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :ধন্যবাদ। সত্তর দশকের প্রথম দিকে আমি কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে স্থায়ী হই। এ এলাকা নদ-নদীর জন্য বিখ্যাত। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছিলাম, এই নদী ও প্রবাহগুলোর গুরুত্বের স্বীকৃতি নেই! এগুলোকে কাজে লাগানো এবং অবদানের স্বীকৃতির জন্য এমনকি রাজ্য পর্যায়েও কোনো অনুষ্ঠান নেই। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমি এবং কিছু সমমনা বন্ধু ১৯৮০ সালে রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানাই, সেপ্টেম্বরের শেষ রোববারকে যেন উদ্বোধনী ‘রিভার ডে‘ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দিবসটি উদযাপনের জন্য আমরা থম্পসন নদীতে পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি গ্রহণ করি। এই নদী হচ্ছে ফ্রেজার এলাকার সবচেয়ে বড় প্রবাহ। ওই দিন একটি বড় স্বেচ্ছাসেবী দল এবং কয়েকটি ফ্লোটিলা ভেলা নিয়ে আমরা থম্পসন নদী থেকে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য ও পরিত্যক্ত বস্তু সংগ্রহ করি। এটি ছিল আমাদের জন্য প্রথম অথচ ব্যাপক সফল একটি কর্মসূচি।

সমকাল :আমরা জানি, পরের বছর আবারও একই কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :হ্যাঁ, প্রথম বছরের সফল কর্মসূচির পর অংশগ্রহণকারীরা সবাই উদগ্রীব ছিল পরের বছর আরও বেশি তৎপর হওয়ার জন্য, আরও বড় নদী পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি পালনের জন্য। এখন পর্যন্ত আমাদের সেই কর্মসূচির ধারাবাহিকতা চলছে। এটা সম্প্রসারিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ এই দিবস সমর্থন করার পর বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপকতা আরও বেড়েছে। এ বছর ৭০টিরও বেশি দেশে পালিত হচ্ছে। বিশেষভাবে বাংলাদেশের নাম বলতে হবে। সেখানে নদী দিবস নিয়ে যেভাবে সাড়া পড়ছে, তা সত্যিই হৃদয়গ্রাহী।

সমকাল :বিশ্ব নদী দিবস পালনের লক্ষ্য কী?

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :বিশ্ব নদী দিবস চায় আমাদের নদীধারাগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে। একই সঙ্গে নদীর প্রতি যে চাপ ও হুমকি রয়েছে এবং সেগুলো মোকাবেলার যে পথ রয়েছে, সে সম্পর্কে জনসাধারণের বোঝাপড়া বাড়াতে চায়। নদী দিবস উদযাপনের আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে, জনসাধারণকে তাদের স্থানীয় নদীর ব্যাপারে সম্পৃক্ত করা। কারণ নদীধারাগুলো সুরক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সমকাল :সেই কানাডায় শুরু করেছিলেন। এখন সুদূর বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ব নদী দিবস উদযাপন। নদী দিবসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :নদী দিবস পালনে বাংলাদেশের ভূমিকা আমার জন্য ও বিশ্ববাসীর জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। আমি আপনাকে, আপনার সহযোদ্ধাদের এবং আরও যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন নদী দিবস পালন করছে- সবাইকে অভিনন্দন জানাই। সুনির্দিষ্টভাবে রিভারাইন পিপল বিশেষতম স্বীকৃতির দাবি রাখে। তারা বাংলাদেশে দিবসটি উদযাপনের সূচনা করেছিল। আমি জেনে আনন্দিত ও মুগ্ধ হয়েছি যে, এবার আপনাদের দেশে ‘নদী দিবস উদযাপন পরিষদ’ গঠিত হয়েছে।

রিভার বাংলা ডট কম ।। একটি নদী বিষয়ক পত্রিকা ।।

সমকাল : বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া সফরের কোনো পরিকল্পনা আছে?

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :নদীর পক্ষ হয়ে আপনারা যা করছেন, তা দেখতে আমি উন্মুখ। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আরেকটি সফরের জন্য আমি অপেক্ষা করে আছি।

সমকাল :আপনি সম্ভবত জানেন, বাংলাদেশে এবার নদী দিবসের প্রতিপাদ্য ‘নদী থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলন বন্ধ কর’। কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপীই নদীগুলোর জন্য এটা একটি সংকট। এ ব্যাপারে বলুন।

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :আমি জেনে আনন্দিত হয়েছি যে, এ বছর বালু উত্তোলনের বিষয়টি সামনে এনেছেন। আমি মনে করি, বাংলাদেশের বন্ধুরা একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে। বস্তুত প্রতিবছরই আপনারা দেশীয় প্রতিপাদ্য হিসেবে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আনছেন। আমি এও জানি, অন্যান্য দেশও একই ধরনের সংকট মোকাবেলা করছে। ফলে আপনি ঠিকই বলেছেন যে, নদী থেকে বালু উত্তোলন একটি বৈশ্বিক ইস্যু।

সমকাল :বালু উত্তোলনের ব্যাপারে কানাডার চিত্র কী?

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :কানাডার উদাহরণ হচ্ছে, এখানে বছরের পর বছর মাত্রাতিরিক্ত ও নির্বিচার বালু ও নুড়ি উত্তোলন চলে। বিশেষ করে ফ্রেজারের মতো নদীগুলোতে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই আরও ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রতিবেশগত দিক থেকে সংবেদনশীল পদ্ধতি গ্রহণের জন্য দাবি জানিয়ে আসছি।

সমকাল :আমরা জানি, বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য অঞ্চল ও দেশভেদে ভিন্ন হয়। অন্যান্য দিবসের মতো বিশ্বব্যাপী একক প্রতিপাদ্য কেন নয়?

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :সার্বিকভাবে বললে, যেহেতু বিভিন্ন ধরনের দেশ, অঞ্চল ও নদীধারায় বিশ্ব নদী দিবস উদযাপিত হয়, আমরা এ জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করি না। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্য, আমরা বিভিন্ন দেশকে উৎসাহিত করে থাকি, তাদের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয় প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করুক। যেমন আপনারা করছেন। স্থানীয়ভাবে এ ধরনের প্রতিপাদ্য যেমন নদী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি করে, তেমনি সংশোধনমূলক পদক্ষেপের প্রতি আলোকপাত করে।

সমকাল :শেষ প্রশ্ন। বিশ্বব্যাপী নদ-নদীর জন্য এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :আমাদের নদ-নদীর বিপুল গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু তারা একই সঙ্গে বিচিত্র ধরনের চাপ ও হুমকির মুখেও থাকে। এর মধ্যে রয়েছে দূষণ, নগরায়ন, শিল্পায়নের বিকাশ, মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলন, বালি উত্তোলন এবং অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তন। আমি বিশ্বের কমবেশি এক হাজার নদী ভ্রমণ করেছি। আমার বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মেছে যে, আমাদের নদীগুলোর পরিস্থিতি আরও উন্নত হওয়া দরকার। সার্বিকভাবে এই গ্রহের সবচেয়ে চাপের মুখে থাকা পরিবেশগত সম্পদ হচ্ছে আমাদের নদী বা পানিসম্পদ

সমকাল :আপনার সময় ও মনোযোগের জন্য অনেক ধন্যবাদ। আমরা জানি, বিশ্ব নদী দিবসের প্রাক্কালে আপনি কতটা ব্যস্ত থাকেন।

মার্ক অ্যাঞ্জেলো :ধন্যবাদ। আমি বিশ্বের সব নদীকর্মীর পক্ষে বাংলাদেশি বন্ধুদের অভিনন্দন জানাই।

সূত্র: সমকাল,  প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮।।

আরো পড়ুন…

“নদী তো আর এক জায়গায় থাকে না, যেখানে পলি উঠানো হয় নদী সেখানেই যায়”

ধলেশ্বরী নদী : দখল-দূষণে আজ বিপন্ন

সংশ্লিষ্ট বিষয়