রিভার বাংলা’র বৈশাখী আয়োজনে কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলাস্থ সুতি নদী নিয়ে লিখেছেন নদীকর্মী আফজল হোসেন আজম।- সম্পাদক
আজ চৈত্রের শেষ দিন। কেমন জানি সাজ সাজ রবে মেতে উঠেছে আমার দুই পাড়ের বাঙালী। তাদের স্বত্বা নিয়ে লড়ছে বুঝি।আর্য আর অনার্যদের ঝাঁপি মাথায় নিয়ে একি আনন্দের নববর্ষ! ১লা বৈশাখ ১৪২৬ বংঙ্গাব্দ। শুভ নববর্ষ। বাঙালী স্বত্তার একটি দিন। সারাবিশ্বের বিস্ময়! বাঙ্গালী ওরা।আমি সূতী।ওদের স্বত্তার অংশীদার। পিতা নরসুন্দার বড় মেয়ে। আমার বুঝি নববর্ষ নেই। আমি তোমাদেরি মেয়ে। কেমন সুন্দর তুলতুলে নামটি রেখেছিল দাদা ব্রক্ষ্রপুত্র। যৌবনে লালপাঁড়ের শাড়ী পড়তাম। কোমল সূতার বুননের।বাঙ্গালী তাঁতীদের হাতের নিখুঁত সূতার জাল বিছিয়ে নরসুন্দা হতে তাড়াইল হয়ে কেন্দুয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম দিয়ে আমার দাদার বাড়ির সীমানায় মগড়ায় পড়িয়ে দিয়েছিল।
পাঁড় হতে আঁচল।কতো রকমের ছাপার কারুকার্জ ছিল আমার গাঁয়ে।আমিতো ক্যামিক্যাল নই।প্রানহীন পলিথিন হয়ে চারশো বছর মাটিচেপে রইবো।আমি সূূতি।আদরের বস্ত্রবিতান।উজান ও ভাটির কালনী, মেঘনা, মগড়া, ঘোড়াউত্রা, নরসুন্দার উপরের পোষাক। নদীরা বুঝি পোষাক পড়ে না। সম্রাট আকবরের খাজাঞ্জীরা আমায় পোষে পেট চালাতো।সওদাগরের সওদা দেখতাম টলটল ঢেউয়ের আঁখিমেলে।মগ জলদস্যুদের হাত থেকে সওদাগরদের বাঁচাতে আমার তীরে নৌ-ফাঁড়ি ও ভাটির রাজধানী বানিয়েছিল সস্রাট আকবর। কেন্দুয়ার রৌয়াইল বাড়িতে।নিয়ামত বিবি আর ডেঙ্গু মালের কবর কালের স্বাক্ষী। ড. দীনেশ বাবুর মৈয়মনসিংহ গীতিকা পড়েননি বুঝি।
‘বারো জনে কাজ করে তেরো জনের খোরাক নেয়,
জ্বিনের বাদশা কাজ করে শহর গড়ে দেয়।’
আমি বাবার কোলে শুয়ে কতো শুনেছি সামন্ত রাজার পেয়াদাদের হাঁকডাক। তীরের চৈত্র সংক্রান্তির সময়ে। নিরীহ প্রজাদের ধড় আলাদা করতো করের জন্য। হাজারো পানসেতুক ভীড় করতো। লাঠিয়ালদের লাঠি খেলা আর জারিকারদের ফরমানের ফাঁকে চারণ কবিরা গাইতো…
খাজনা আদাযকৃত রায়তের গালে লাল রং চিহ্ন দেয়া হতো। সেইযে স্মৃতি ভুলা কি যায়? ইতিহাসের কালের স্বাক্ষী। আমি মা বাবার আহল্লাদি বড় মেয়ে।মহাকাল পরে রইলাম।আমার খবর কেউ রাখে না। স্বামীবিনে বধূ, স্রোতবিনে সূতি।এখন যে আমার পিতৃকুলের মান যাবে।কেউ ভাবে না।কূলটা নারীর তকমা দিতে চায় তীরের বোকা মানুষগুলি। ইদানীং রাজা প্রজারা নড়ে বসেছে। তাদের মেয়ে কূলটা হোক চায় না। তাই খনন করতে লেগেছে।আমার গা থেকে ময়লা আবর্জনা সরাতে হিল্লে বিয়ে দিচ্ছে ঠিকাদারের নিকট।ভেকু মিয়া গাত্রহতে পলি সরাচ্ছে। কি যে খুশি আমি!
আবার ঘেটুপুত্র কমলাদের গান শুনবো।এখন আমি স্বপ্ন দেখি আবার টলটল ঢেউয়ে পালতোলা নৌকা যাবে। এদিকে মেঘনার জাটকারা ঘুমিয়ে আমার মাঝে চলে আসবে।শ্বশুড় মশাইরা জামাই ষষ্টি করার জন্য উদগ্রীব থাকবে।
বিয়ের বধূ আসবে লালপাঁড়ের সূতি শাড়ী পড়ে। আমিও নাচবো। কৃষকেরা আমার বুকে ধানচাষ করে আমাকে সবুজশাড়ী পড়াবে না।রাতে বিয়ের গীত গাইবো।দুষ্টু রাখাল ছেলেরা বাঁশিতে বিরহের সুর তুলবে….
নদীর ধারে নাইতে গেলে পাইবে বন্ধুর দর্শন
যাওরে মন,
সকাল সন্ধ্যা আসে যায়,
প্রেমের মানিক ধন।।
বৈরি প্রকৃতির আগাম অতি বৃষ্টিতে এবার খননের কাজ পূর্ন্য হলো না। তাই এই নববর্ষে খুব ভাল নেই আমি সূতি।অপেক্ষায় রইলাম আগামী মৌসুমের জন্য।এরপর খনন শেষ হলে আমি ভালই থাকবো তীরের মানুষদের নিয়ে।আমি আশাহত নই।বাংলার নারীরা যেমন আশায় বুকবাঁধে, নিরবে নিভূতে কাঁদে, তবুও স্বত্বা হারায় না।আমিও স্বত্বা হারাইনি।আগামী বৈশাখে আমি সূঁতি শাড়ী পড়ে বাবার বাড়ি বেড়াতে যাব।
আরো পড়তে পারেন….
নদী এখন ভূগোলের নয় ইতিহাসের বিষয়
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নদী’ ভাবনা : ভারতবর্ষ থেকে নদীমাতৃক শুভেচ্ছা
শিক্ষক ও নদী রক্ষা আন্দোলন কর্মী
তাড়াইল, কিশোরগঞ্জ।