সেদিন দেখা হল পরাণ মাঝির সাথে। রিকশা ঠেলে সওয়ারী নিয়ে যাচ্ছে নদী পাড়ে।হাঁক দিলামঃ কি গো! তুমি? উত্তর পেলামঃ এখন আর নৌকা ঠেলি না গো! ব্রীজ হয়ে গেসে। জলও তো নাই। বলতে বলতে বেরিয়ে গেল পরাণ মাঝি। সত্যিই তো আগের মতো তো আর নৌকা চলাচল করেনা।যাত্রী কিংবা পন্য- দুটোতেই নৌকার প্রাধান্য কিংবা কদর কমেছে। উন্নয়ন আর নগরায়নে এক শ্রেণীর মানুষ কাজ হারিয়েছে।
রাতের বেলা সিভিক পুলিশের ডিউটি শেষ করে নদী পেরিয়ে পাগলিগঞ্জের ওপারে সোদপুর- বদিহারে যেতে তাই জয়দেব দের আর নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া মাঝিকে ডাকতে হয়না। ব্রীজ আর রাস্তা হয়ে গিয়েছে যে! সেদিন গনগনে রোদ। আত্রেয়ী নদীর চক্কাশি ঘাটে হঠাৎই চোখে পড়লো নৌকা তৈরি হচ্ছে। কাছে গেলাম, দেখি নৌকা তৈরি করাচ্ছেন চক্কাশির কালিদাস চৌধুরী। এক একটা নৌকা তৈরি করতে প্রায় দশ- বারো দিন লাগে প্রায় সাত ঘন্টার পরিশ্রমে। দামও অনেক। শাল কাঠের হলে প্রায় এক লক্ষ কুড়ি পঁচিশ হাজার মতো। আর ইউক্যালিপটাস কাঠের হলে পয়ষট্টি থেকে সত্তর হাজার। জিজ্ঞেস করতেই বললেন লসেই করতে হয় এসব। নৌকা তো আর আগের মতো চলেনা, ভাড়াও হয় না অত। আগে চলতো। তাহলে নৌকা বানাচ্ছেন যে! কি করবো! বন্যা হলে যাবো কোথায়? পরিবার নিয়ে নৌকার উপরেই যে থাকি। একথা বলে গতবছরের ভয়ংকর বন্যার কথা শোনালেন কালিদাস বাবু।
নদী টা ক্রমশ: অচেনা হয়ে যাচ্ছে ।কখনও জলই থাকেনা কখনও আবার ভয়ংকর বন্যা। আক্ষেপ তার। ওখানেই ছিলেন নৌকা তৈরির কারিগর খিদিরপুর ঘোষপাড়ার পলান সূত্রধর। হতাশ হয়ে বললেন, আগে নৌকা বানানোর জন্য অনেকবার ডাক পড়তো আমাদের।এখন তো আর নৌকাই তৈরি হয়না।সংসার চালানোই সমস্যা। এই বয়সে অন্য পেশাতেও যে যাবো, সেই উপায় নেই তো!
ঝন্টু হালদার। মৎস্যজীবী পরিবারের সন্তান পেশায় শিক্ষক ঝন্টু দেখেছেন ছোটবেলা থেকে বাবা কাকাদের মুখে শুনছেন নৌকার কথা।নদীর কথা ।ঝন্টুর কথায় শুনেছি আমাদের বাড়ি যে এলাকায় সেই খিদিরপুর আগে ডকের মত ছিল। আজ থেকে পঁচিশ- তিরিশ বছর আগেও এখানে তিনশো পঞ্চাশটির মতো নৌকা থাকতো। বাংলাদেশের সঙ্গে জলপথে ব্যবসা- বানিজ্য হতো। বড় বড় বেশ কয়টি ঘাট ছিল আমাদের এখানে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খিদিরপুর শ্মশান ঘাট, নিমতলি ঘাট, খিদিরপুর হালদার পাড়া।এখান থেকে বাংলাদেশে যেত চিনি, পেঁয়াজ, লংকা, আলু, ইউরিয়া, ফসফেট আর বাংলাদেশ থেকে মূলত বিভিন্ন গাড়ির যন্ত্রাংশ।গঙ্গারামপুর, কুমারগঞ্জ থেকেও এখানে নৌকা আসতো শুনেছি।
আজ থেকে চব্বিশ বছর আগে আরেকটি ভয়ংকর বন্যা হয়েছিল উনিশশো পঁচানব্বই সালে। তার পর থেকে অনেক নৌকা ডুবে গিয়ৈছে, ভেঙে গিয়েছে। জলও নেই নদীতে।বহু নৌকা পড়ে থাকতে থাকতে মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। নদী ভাল না থাকলে নৌকাও ভাল থাকেনা। তাই কি করেই বা ভাল থাকে নৌকা তৈরির কারিগররা?
অনেকেই আছেন যাদের আর নতুন করে অন্য পেশাতে যাওয়ার পরিস্থিতি নেই। যাদেরও বা আছে তারা অন্য পেশায় যাচ্ছে ঠিকই কিন্ত সেখানেও বাড়ছে ভীড়, বাড়ছে প্রতিযোগিতা।একটা অন্যধরণের সঙ্কট তৈরি হয়েছে, হচ্ছে।এই সঙ্কটের কথা কারো ভাবনাতেই নেই। নদীর সাথে জড়িয়ে থাকে অনেক জীবন। নদী ও পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে অনেক কিছুই বদলে যায়। ফেরার পথে আবার দেখা সেই পরাণ মাঝির সাথে। বললাম কি গো! নৌকা ঠেলতে ঠেলতে তোমার যে নদীয়ালি গান সেটা তো তাহলে আর শুনতে পাবো না। পরাণ মাঝি একটা কষ্টের হাসি দিয়ে বললো, বাবু নৌকা গেলেও গানটা যায়নি।ওটা আছে।রিকশাতে উঠবেন একদিন, রিকশাতে বসিয়েই নদীর গান শোনাবো। বলেই গুনগুন করতে করতে অন্য পথ ধরলো সে।