রাজেশ ধর এর গল্প “শেকল”

শেকল

“এত দেরি করি আসলি, চলে কী করি? একগাদা লোক দাঁড়ায়ে রয়েছে ঘণ্টা ধরি!”

“কী করব? খেয়া তো দরকারের জন্যি। কত্ত সমিস্যের লোক আসতি নাগে। সবারে না নি এলি হয়। সক্কলের জন্যি দাঁড়ায়ে থাকতি হয়।”

“হ, লগেন মাঝি,.তোমার মাথাডা এক্কেবারে গিইছে। কেডা কখন আসপে তার জন্যি তুমি ঐ পারে দাঁড়ায়ে থাকপা আর এই পারের লোকেরা রোদের তাপে বেগুন পোড়া হবে? তোমারে নে তো আর পারা যায় না!”

“তা কী করবা কর! করি নাও… দুডো পারই তো এই ফুডিডার নাকি? ফুডিনদীর একপারের লোকের সুক দেখতে গি, অন্য পারের লোকে কষ্ট পাবে, তা করতি পারবো না।”

“হুঁশোর মত কথা বলছ কিন্তু! এভাবে চললে, বল…”

“কী করবা? হয়… কিছু করার থাকলি, করি দেখাও…”

এইভাবে প্রায় প্রতিদিন নগেনের সঙ্গে এপারের কিংবা ওপারের কারোর না কারোর লেগে যেত। অথচ নদী পেরোনোর তাড়া থাকলে ঝগড়া নিয়ে মেতে থাকলে হয় না। তাই বিপুলের মত কোনো একজন এগিয়ে আসত। অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য হয়েই আসতে হত। আর নিমেষে রোজকার সেই ঝগড়া কর্পূরের মত উবে যেত। খেয়া ভরে যেত তারপর। নগেন বৈঠা ধরত। পার থেকে একটু দূরে এলেই, গান ধরত সে।

ট্রেন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত বিপুল রাত একটা-দেড়টাতেও পেয়ে যেত নগেনকে। সত্যি সত্যি হাড় কেঁপে যাওয়া ঠান্ডাতেই হোক কিম্বা পচা ভাদ্রের দমবন্ধ করা গুমোট গরমে… কাক জ্যোৎস্নায় দূর থেকে দেখা যেত, নগেনের নেংটি পরা, কুচকুচে কালো আদুর শরীরের আবছা আকৃতি। ওপারের বটগাছটায় একহাতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অমাবস্যার অন্ধকারে, চোখে পড়ত বিড়ির টিমটিমে লাল আগুন। বিপুল বলত,

“নগেন কা, কেউ দিচ্ছে দশ পয়সা, কেউ কুড়ি, কেউ বা পাঁচনয়া ঠেকাচ্ছে। কতজন তো কিছু না দিয়েই নেমে যাচ্ছে! এমন ভূতের মত খেটে কী পাচ্ছ? এর থেকে জন খাটলে মজুরি , তার ওপরে পান্তা-মুড়ি-কাঁচা লঙ্কা…কেন বেগার দিচ্ছ কাকা?

গানে মশগুল নগেন জ্যোৎস্নায় ঝলমল করা নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকত। সারাদিনের ক্লান্তি এসে গিলত বিপুলকে। সেও চুপ করে যেত।

শুধু একদিন উত্তর দিয়েছিল নগেন। সেদিন হয়ত কোন বিশেষ পূর্ণিমা…সেদিন মনে হচ্ছিল চাঁদের সাদা-রুপো রঙ চিরকালের মত পৃথিবী থেকে সব অন্ধকার মুছে দেবে…সেদিন হাওয়ার স্রোতেও ফুটি নদীর ছোট ছোট ঢেউ দুষ্টুমি করছিল…সেদিন বিকেলের শেষে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির নির্জন করিডরে প্রেমিকাকে চুমু খেয়েছিল বিপুল…জীবনে প্রথম কোন নারীর ঠোঁট…। সেই মাঝরাতে মোহগ্রস্ত নগেন ফুটির দিকে তাকিয়েই বলেছিল;

“জন খাটতি গেলি… এই ফুডির দুপারডা কেডা বাঁধবে? তোমার মত সোনার কুঁচি ছেইলে গেরাম ছেড়ি চলি যাবে! তোমার মা কানবে আর…আর এই ফুডি…এও যে কানবে… খুব কানবে, খোকা! ও যে সবাইরে নিজের ভাবে…নিজের করি ভাবে…নিজের মনে করে গো! ওর কান্নার আওয়াজ আমি সহ্য করতি পারি না বাপ।”

চালচুলোহীন লোকটা কখন ঘুমোত, কখন খেত, কে জানে? দিনরাত, প্রতিটা মুহুর্ত নদীর পাড়ে। বিপুলের মনে হত। ওর কথাগুলোকে সাজিয়ে দিলেই একটা কবিতা হয়ে যাবে! কতবার ভেবেওছে একবারে হুবুহু খাতায় লিখবে নগেনের ঐ অসংলগ্ন কথাগুলো। কিন্তু হয় নি…হয় না!

একবার জৈষ্ঠ্যের এক ঝলসানো দুপুরের শেষে নদীর ঘাটে এসেছিল বিপুল। নিজেকে মনে হচ্ছিল শ্মশানের জ্বলন্ত কাঠকয়লা। সামান্য সময় চোখ বন্ধ করে দাঁড়াতেই যেন বেঁচে উঠল ও। চোখ খুলতেই নজর গেল ফাঁকা ঘাটে। সেখান দাঁড়িয়ে, আছে নগেন। ওপারের সূর্য ডুবে যাওয়া রঙ ছড়ানো আকাশের দিকে তাকিয়ে। নিঃশব্দে তার কাছে এগিয়ে গিয়েছিল বিপুল,

“দেকতেছ বাপ সুয্যি ডুবি গেলি, আকাশের মন কেমন খারাপ হইয়ে যায়! ওর কপাল থেকি সব সিঁদুর ধুয়ে যাচ্ছে।”

সেদিন অন্য আরেকটা প্রশ্ন করেছিল বিপুল। সে কথাটাও দীর্ঘদিন মনের ভেতরে জমেছিল;

“ এই যে তুমি হেঁকে হেঁকে সবাইকে বল, এই নদীটা নাকি তোমার সঙ্গে কথা বলে…সত্যি?”

“লিচ্চয় বাপ, তোমার গা ছুঁইয়ে বলতিছি।”

“তাহলে আমায় বল দেখি এখন, তোমার নদী কী বলছে?”

“শুধু অ্যাখনই লয়…যে দিন থেকে দেকতিছি একটাই তো কথা কয়,- লগেন রে আমারে ফেলি যাস নে। এরা শিকলি নে ঘুরতেছে! গলায় বেন্ধে মেরি ফেলাবে।”

তখনও গ্রামের শেষ প্রান্তে নদীর বুকে পঁচিশ ফুট পাকা সেতুর কথা শিক্ষিত কয়েকজনের মস্তিষ্কে। নগেনের কিছুতেই তা জানার কথা নয়।

দুই.

প্রায় বছর তিরিশ পরের এক মধ্য বৈশাখ। ভাজা ভাজা গরমের পর আর এক গোধূলি। ফুটি নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বিপুল। আতপ বিহীন শীতার্ত গাড়ি থেকে নামার পর… নদীর হাওয়া! বুকের ভেতরটা আকুলিবিকুলি করতে থাকে তার!ওপারের আকাশে গোলাপি-কমলা-আবীর-হাল্কা পেস্তা রঙের এলোমেলো স্ট্রোক | বিপুল দেখতে থাকে। তারপর একটু একটু করে সেই অ-লৌকিক পেন্টিং মিলিয়ে গিয়ে নীলচে ধূসর একটা খালি ক্যানভাসে দুটো…তিনটে নীলাভ আলোর বিন্দু উঁকি দেয়।

নতুন ব্রিজটা দিয়ে যখন নামছিল বিপুল তখনই ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল । কিছুতেই তাকে পাওয়া যাবে না। ফুটি নদীকে আগলে আর তো থাকার কোন কারণই নেই। তবুও সে ইতিউতি খুঁজছিল নগেন মাঝিকে। কেন খুঁজছিল? সে প্রশ্নের কোন উত্তরই বিপুলের কাছে ছিল না! হয়ত অকারণ…যাই হোক, নদীর ঘাটে শুধু বিপুল একাই ছিল…একেবারে একা!

গোটা পাঁচেক বেনসেন হেজেস শেষ করার পর ওর মনে হল। অনেকক্ষণ মোবাইলটা কাঁপছে বুকে পকেটে। ডাক দিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার মুছে দেওয়া সভ্যতা। বুক পকেট থেকে মোবাইলটা বার করতে যাবে ঠিক তখনই ওর নজরে পড়ল। প্রায় শুকনো খাত থেকে ঢালু পাড় বেয়ে উঠে আসছে সেই কালো কুচকুচে নেংটি পরা, পাকানো দড়ির মত আদুর শরীরটা। বিপুল বুঝতে পারল তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে একটুও গুরুত্ব না দিয়ে তারা সারা শরীর যেন পাথর হয়ে গেছে। একটা স্ট্যাচুর মতই সে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে থাকল সামনে।

কাছে এসে ঠিক চিনতে পারল সে। বিপুল বলল,

“নৌকাটা কই গো নগেনকা? একটু চড়াবে!”

“সেইডারেই তো খুঁজতে গিলাম।”

“কোথায়?”

“ঐ যে গো…ঐ ওখেনে… ফুডির গবভে!”

“তার মানে?”

“যেদিন বিরিজডা খুলি গেল, সেইদিন রাত থেকি লৌকোডা কোথায় চলি গেল? সক্কলে কয় ওডা চুরি গিছে…”

তখন পুরো অন্ধকার নেমে এসেছে নদীর ঘাটে। বিপুল আর নগেন মাঝি এই দুজনই মানুষের প্রতিনিধি সেখানে। বাকি জল, মাটি আর জঙ্গলের জীববৈচিত্র্য তাদের নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত। আর ব্যস্ত …ঐ দূরের আলো না জ্বলা ব্রিজটার ওপরে ছুটন্ত ইঞ্জিন ভ্যান, চোদ্দজন চড়ার অটো, লাখ-দেড়লাখি বাইক আর মোবাইলের পর্দায় নিজেদের জগত নিয়ে গ্রামের যুবক-যুবতীরা…। নগেনের চোখের দিকে কোনদিন তাকায়নি বিপুল। আজ দেখল, নিকষ কালো কোটরে দুটো ম্লান মেটে প্রদীপ জ্বলছে। সেই আলো-আঁধারে বিপুলের মোটেও গা ছমছম করে উঠল না। ওর মনে হল…ও কি কোনদিন সাঁতার জানত! সাঁতরে পার হত কি… ঐ ভরা ফুটি নদী? তাহলে কি ও একবার গিয়ে নামবে এখন?…কিন্তু নগেন তার কথা থামায়নি, সে বলে যাচ্ছিল;

“ খোকা…আমি জানি, নৌকোডা আমার, নিজি নিজি জলে ডুবি গেছে। কেউ এসি আর ওর কোলে বসে না! ওরে ছোঁয় না!…ওর মনে খুব লেগিছে গো! দিনরাত জলে ডুব দি, কাঁদা ঘেটি ঘেটি ওটারে –খুঁজতিছি বাপ!”

বিপুল ঢোক গিলতে পারে না। অনেক কষ্টে বলে,

“কতদিন, এমন খুঁজছ?”

“ঐ যে বললাম, বিরিজ যেদিন খুলি গেল তা পেরায় দুই-তিন বচ্ছর।”

বুকের ভেতরটা কে যেন খুব জোরে ধাক্কা দিল বিপুলের। ও সাঁতার কাটলেও কি আদৌ ফিরতে পারে নৌকাটা?

“এভাবে কি পাওয়া যায়? এসব ছাড় তুমি!”

“কী বলতেছ বাপ? ফুডি কেবল কান্দে আর বলে- শিকলির ফাঁসে পেরানডা যায় রে লগেন। লৌকোডারি খুঁজি নে আয়! না হলি এই শিকলি কাটবে নে… ওরা শিকলি পরায়ে দেছে রে লগেন…পরায়ে দেছে…”

গাড়িটা বাঁধের শেষে। নগেন মাঝি আবার নদীর জলে…নাকি জল নামের এক অন্ধকারে নেমে গেল! নদীর দিকে পিছন ফিরে হাটতে লাগল বিপুল। ফুটির ঢেউ-এর মৃদু কুলুকুলু…আর অন্ধকার পেরিয়ে যাচ্ছে সে। তিরিশজন জুনিয়র এক্সিকিউটিভ ছাঁটতেই হবে ওকে। ‘ডিসিশান ফ্রম বোর্ড অব ডিরেক্টারস’… লাগু করতে হবে তাকেই। তিনদিন আটকে রেখেছিল সিদ্ধান্তটা। আর উপায় নেই। মাথাটা কিছুতেই হালকা হল না। প্রমোশানের আগের যারা বন্ধু ছিল, সহকর্মী ছিল…যাদের চোখের আলো নিভতে যাচ্ছে তারা যদি একটা নগেন মাঝিকে খুঁজে পেত!


আরও পড়ুন রাজেশ ধর এর লেখা
রাজেশ ধর এর গল্প- “চুপিকথা”
নদী একটাই ।। রাজেশ ধর

সংশ্লিষ্ট বিষয়