শেখ রোকন, বাংলাদেশের নদীসুরক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। নদী ও পানি বিষয়ক নাগরিক সংগঠন ‘রিভারাইন পিপল’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও মহাসচিব। পেশায় লেখক হলেও তাঁর সমস্ত মনযোগ নদ-নদীর উপর। দুই দশক ধরে লেখালেখি ও গবেষণা করছেন, নদ-নদী বিষয়ে।
ইতিমধ্যে নদী বিষয়ে লিখেছেন বেশকয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। এর অন্যতম হল- মেঘনা পাড়ের সংকট ও সংগ্রাম (২০০৬), নদী প্রসঙ্গ (২০০৭), নথিবদ্ধ বড়াল (২০১১), বিষয় নদী (২০১২), নদীচিন্তা (২০১৫)। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এর বাইরে পানি-নদী-পরিবেশ বিষয়ে নিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ। এর অংশ হিসেবে ভারতের সিকিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ-ভারত পানিসম্পর্ক বিষয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ ও সম্পাদকীয় নীতি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। সম্প্রতি তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন রিভার বাংলা সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ।
রিভার বাংলা : সম্প্রতি ঘোষণা দিলেন নতুন বই ‘নদীময় জীবন’ শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। সে বিষয়ে জানতে চাই?
শেখ রোকন : ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা যে, বিষয়টি আপনার নজরে এসেছে এবং এ ব্যাপারে সাক্ষাৎকারের কথা ভেবেছেন। আমার নতুন বইয়ের ঘোষণা শুনে যারা ফেসবুকে ইতিবাচক সাড়া ও উৎসাহ দিচ্ছেন, তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা। একটি দৃশ্যত নৈরাশ্যজনক পোস্টের প্রতিক্রিয়া আমাকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু এখন একটু ভাবনায় আছি যে, বইটি হাতে পেয়ে তারাই নিরুৎসাহিত হন কি-না। কারণ এই বই আমার আগের বইগুলোর ধারাবাহিকতা। বিশেষ নতুন কিছু নয়। সংবাদমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব বিষয়ে লিখি বা বলি, তারই সম্প্রসারিত অংশ।
রিভার বাংলা : আপনার সর্বশেষ বই ‘নদীচিন্তা‘ ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর অনেকদিনের বিরতি। কেন?
শেখ রোকন : এর পেছনে ওই বইটিরও দায় কম নয়। নদীচিন্তা প্রকাশের সময়ই মনে মনে ঠিক করেছিলাম, নদী নিয়ে বারোয়ারি বিষয়ের বই আর নয়। সুনির্দিষ্ট একটি নদী বা বিষয় নিয়ে লিখবো। গত চার বছরে চেষ্টাও করেছি, কয়েকটি পাণ্ডুলিপি আধা-সম্পন্ন হয়ে আছে। শেষ করা হয়নি। কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। বিলম্বে হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে, নদী বিষয়ে মাস্টারপিস লেখার জন্য অন্যান্য লেখালেখি বা বই লেখা থেমে থাকা কাজের কথা নয়। আমরা তো চাই, নাগরিকরা নদী সম্পর্কে আগ্রহী হোক। লিখুক, পড়ুক। ফলে প্রতি বছর বইমেলা উপলক্ষে একটি নতুন বই, যেমনই হোক, প্রকাশ হওয়া যে কোনো বিবেচনাতেই ইতিবাচক। শুধু আমি না, যে কেউ প্রকাশ করলেই খুশি। নদী বিষয়ে যত বই প্রকাশ হবে, তত ভালো। সেখান থেকে বইটি প্রকাশ।
রিভার বাংলা : যতটা নিয়মিত কলাম লিখছেন, বই প্রকাশে কিন্তু ততটাই ধীরগতি?
শেখ রোকন : সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? কলাম লেখা হয় তাৎক্ষণিক বিষয়ে। বইয়ের ক্ষেত্রে বড় প্রেক্ষাপটে বড় আকারে ভাবতে হয়। কলামের স্থায়িত্ব সাময়িক, বই তো দীর্ঘদিন টিকে থাকার জন্য। এছাড়া প্রকাশের পরিসও ভিন্ন। একটি কলাম মুদ্রণ বা অনলাইন সংবাদমাধ্যমে, এমনকি ফেসবুকেও দিয়ে দিতে পারেন। বইয়ের জন্য প্রকাশক থাকতে হবে। এর প্রকাশনা প্রক্রিয়া ও সময় দীর্ঘ। বড় কথা, বইয়ের ক্ষেত্রে পাঠক পাওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয়।
রিভার বাংলা : প্রকাশনার কথাই যেহেতু তুললেন। বাংলাদেশে নদী বিষয়ক বই কেমন প্রকাশ হচ্ছে?
শেখ রোকন : দেখুন, আমার বিবেচনায় নদী বিষয়ে তিন ধরনের বই থাকে। প্রথমটি সাহিত্যধর্মী বা ফিকশন। এই ধরনের বই বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই প্রকাশ হয়ে আসছে। যেমন সেই ত্রিশের দশকে পদ্মা নদীর মাঝি প্রকাশ হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে নদী ও নারী বা তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস প্রকাশ হয়েছে। আপনি দেখবেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নৌকাডুবি, বিভূতিভূষণের ইছামতী, আবু ইসহাকের মতো উপন্যাসগুলো যদিও ঠিক নদী বিষয়ক নয়, কিন্তু পরোক্ষভাবে নদী আছে। মজার ব্যাপার, হুমায়ুন কবিরের নদী ও নারী প্রথমে ইংরেজিতে প্রকাশ হয়েছিল চল্লিশের দশকে। তখন এর নাম ছিল ‘মেন অ্যান্ড রিভারস’। তার মানে, বইটি বাংলায় প্রকাশের সময় নর পরিণত হয়েছে নারীতে!
রিভার বাংলা : নদী বিষয়ক উপন্যাসের মধ্যে আপনার প্রিয় কোনটি?
শেখ রোকন : একটি নয়, দুটি উপন্যাসের নাম বলতে চাই। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাঁদো নদী কাঁদো এবং দেবেশ রায়ের তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত।
রিভার বাংলা : পড়া হয়নি, কিন্তু পড়তে চান- এমন কোনো উপন্যাস আছে?
শেখ রোকন : সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’ এখনো পড়া হয়নি। পড়তে চাই। দেবেশ রায়ের তিস্তাপুরাণ আমার কাছে ছিল, পড়া শেষ হওয়ার আগে একটি ট্রাজিক ঘটনার মধ্য দিয়ে হারিয়ে গেছে। তারপর থেকে খুঁজছি।
রিভার বাংলা : তিন ধরনের বইয়ের কথা বলছিলেন…
শেখ রোকন : দ্বিতীয় ধরনের বই নদী বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ বা একাডেমিক বই। নদ-নদীর কারিগরি বিষয়াবলী। সেগুলোও নদী বা পানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রয়োজনে প্রকাশ হয়ে আসছে আগে থেকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা সংস্থা থেকে প্রকাশ হতো। আমার বিবেচনায় তৃতীয় যে ধরনের বই প্রকাশের ট্রেন্ড খুবই সাম্প্রতিক, তা হলো নদী বিষয়ক নন-ফিকশন, নন-টেকনিক্যাল বই। নিবন্ধমূলক, তথ্যমূলক, ব্যাখ্যামূলক বই। কোনো একটি বিশেষ নদী নিয়ে প্রফাইল ধরনের বই। এর ইতিহাস খুব বেশি হলে দুই দশকের বেশি নয়। কিন্তু গত দুই দশকে এই ধারা আমার মতে নদী বিষয়ক বইয়ের প্রধান ধারা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেও ধরেন নদী বিষয়খ এ ধরনের বর্ণনা বা ব্যাখ্যামূলক বই প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সেগুলো ছিল বৃহত্তর কোনো প্রেক্ষাপটের অংশ হিসেবে। যেমন ২৯১২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস বইটি। সেখানে ওই সময়ে নদীগুলোর হদিস পাই আমরা।
রিভার বাংলা : নদী বিষয়ে আগ্রহীদের জন্য এমনকিছু বইয়ের নাম বলেন, যেগুলো পড়ে তারা উপকৃত হবে এবং তাদের কাজের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে?
শেখ রোকন : অনেক বই রয়েছে। কেউ যদি নদী বিষয়ে আগ্রহী হয়, আগ্রহই তাকে নিয়ে যাবে নদী বিষয়ক বইয়ের কাছে। তবে যারা শুরু করতে চান, তাদের জন্য দুটি বইয়ের কথা আমি বলতে চাই। প্রথমটি বাংলায়। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিকের নদী সংখ্যা। খুব সম্ভবত ১৯৯৯ সালে প্রকাশ হয়েছিল। নদী বিষয়ক প্রায় সবকিছু সম্পর্কে সুখপাঠ্য বাংলায় পাওয়া যাবে এখানে। একেবারে নদী ভাঙন থেকে শুরু করে নদী বিষয়ক চিত্রকলা পর্যন্ত। দ্বিতীয়টি ইংরেজিতে, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রকাশিত। রিভারস: আ ভেরি শর্ট ইন্ট্রোডাকশন। খুব ছোট্ট বই, কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নদী সম্পর্কে সব প্রেক্ষিত পাওয়া যাবে। আমার খুব পছন্দ এই পুস্তিকাটি।
রিভার বাংলা : আমি জানি, নদী বিষয়ক বই সংগ্রহের শখ রয়েছে আপনার। একবার ফেসবুকেই সংগ্রহে থাকা বইগুলোর তালিকা দিয়েছিলেন। বিদেশের নদী বিষয়ক বইগুলোর সঙ্গে যদি তুলনা করতে বলি, আমাদের দেশে নদী বিষয়ক বইয়ের সীমাবদ্ধতাগুলো কী কী?
শেখ রোকন : তুলনা করা কঠিন। কারণ ভিন্ন ভাষা ও প্রেক্ষিতে ভিন্ন দেশে বই প্রকাশ হয়। কিন্তু অনেকে হয়তো পছন্দ করবেন না, তবু বলি। আমাদের দেশের নদী বিষয়ক প্রকাশনাগুলো পড়তে গিয়ে আমাকে যে বিষয়টি হতাশ করে, তা হচ্ছে কাট কপি পেস্ট প্রবণতা। আপনি হয়তো দশটি বইয়ে একটি নদী সম্পর্কে বর্ণনামূলক বা তথ্যমূলক লেখা পড়ছেন, দেখবেন নতুন কোনো তথ্য পাচ্ছেন না। একই কথা। একই তথ্য একই বিশ্লেষণ এক বই থেকে আরেক বইয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনও পেয়েছি, নদী বিষয়ক ঢাউস বই প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু ষাটের দশকের বা সত্তর দশকের নথি থেকে কাট-পেস্ট করা হয়েছে। অথচ নদীটির তখনকার অবস্থার সঙ্গে বর্তমান অবস্থার মিল নেই। কিন্তু বর্তমান বইয়েও কয়েক দশক আগের তথ্যই নতুন করে প্রকাশ হচ্ছে। এমনও দেখেছি, তখন হয়তো একটা ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল, সেটা আর কেউ যাচাই করেনি। ওই একই তথ্য প্রকাশ করে যাচ্ছে।
রিভার বাংলা : এর কারণ কী?
শেখ রোকন : সিম্পল। পরিশ্রম করার মানসিকতার অভাব। অন্যদের কথা শুধু বলছি না। আমার নিজেরও পরিশ্রমের মানসিকতার অভাব রয়েছে। যেমন ওপার বাংলার নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের একটি ছোট্ট বই আছে, একেবারে পুস্তিকা। নাম, গঙ্গা-ভাঙন কথা। সাইজে ছোট, দুই-তিন ফর্মার বেশি হবে না। কিন্তু ওই বই খুবই কাজের। পড়লে ফারাক্কা ব্যারাজ ও এর বিরূপ প্রভাব আপনার চোখের সামনে পানির মতো পরিস্কার হয়ে যাবে। এমন বই এখনো এখানে পাইনি। আমি নিজেও লিখতে পারিনি।
রিভার বাংলা : আমাদের দেশের প্রকাশনার মান কেমন?
শেখ রোকন : নদী বিষয়ক বইয়ের কথা বলতে পারি। ভাষা সম্পাদনায় আরও জোর দিতে হবে। নদী বিষয়ক বইগুলো নদী সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের দেখিয়ে নেওয়া যেতে পারে। তাতে করে কারিগরি ভুল কমবে। আর আমার মতে, নদী বিষয়ক বইয়ে শুধু টেক্সট নয়। পর্যাপ্ত ছবি ও মানচিত্র থাকা উচিত। তাতে করে পাঠকের জন্য কানেক্ট করা সহজ হয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রকাশনা শিল্প এখনো খানিকটা পিছিয়ে।
রিভার বাংলা : আপনি নিজেও এর আগে নদী বিষয়ক বেশকয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন?
শেখ রোকন : আমার এই বইগুলোকে ঠিক গুরুত্বপূর্ণ বলতে চাই না। এগুলোও প্রাথমিক পঠন-পাঠন সংক্রান্ত। এর মধ্যে একটি বই একেবারে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে, মেঘনা পাড়ের সংকট ও সংগ্রাম। বিষয় নদী নামে আরেকটি বই আসলে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাতের নদী বিষয়ক সাক্ষাৎকার। নিয়েছি আমি। এই বইয়ে তার নদী বিষয়ক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি বহুলাংশে ধরা যায়। নদ-নদী তার বলা চলে নখদর্পনে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, নিশাত স্যার সাধারণ পাঠকের উপযোগী কোনো বই লেখেননি। তার বই না লেখা আমাদের জন্য জাতীয় দুর্ভাগ্য।
রিভার বাংলা : অন্যান্য বই প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?
শেখ রোকন : এর বাইরে আমার সম্পাদিত বই নদী প্রসঙ্গ। যৌথভাবে সম্পাদিত নথিবদ্ধ বড়াল। নদীচিন্তা বইয়ের কথা তো আগেই বলেছেন। নিজের বইগুলোর মধ্যে নিসর্গের নোটখাতা বইটির প্রতি আমার আলাদা স্নেহ আছে। আমার সন্তানের নামও নিসর্গ। সেখানে ছোট ছোট লেখায় অনেকভাবে নদীর কথা এসেছে। সত্যি বলতে কি, নদী বিষয়ক যে বইগুলো আমি লিখতে চাই, তা এখনো লেখাই হয়ে ওঠেনি।
রিভার বাংলা : কেন লেখা হয়ে উঠছে না?
শেখ রোকন : আগেই বলেছি, বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে। এমনও আছে, গত দশ বছর ধরে একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি গোছাচ্ছি মাথার মধ্যে। হয়তো বিচ্ছিন্নভাবে এক একটি অধ্যায় লিখে রাখছি। প্রকাশকও প্রস্তুত, কিন্তু পান্ডুলিপি শেষ করা হয়ে উঠছে না। আমি এমনিতে লেখার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে। নদী বিষয়ক লেখার ক্ষেত্রে আরও খুঁতখুঁতে। ফলে সময় লেগে যায়। বলতে পারেন গত ১০ বছর ধরে যে বইটি লিখতে চাইছি, সেটা এখনো লেখা হয়নি।
রিভার বাংলা : আমরা জানি নদী বিষয়ে আপনার বিশেষজ্ঞ কলাম পাঠক সমাজে বেশ সমাদৃত। কিন্তু বইয়ের ক্ষেত্রে আসলে কী ঘটছে? সরাসরি বললে, আপনার বইগুলো নিয়ে পাঠকদের কাছ থেকে কেমন সাড়া পেয়েছেন?
শেখ রোকন : কলাম সমাদৃত কি-না জানি না। বইয়ের ক্ষেত্রে বলতে পারি, একটি বাদে সব বই সম্ভবত আউট অব প্রিন্ট। বিক্রি হয়ে গেছে। কিন্তু এতে আমার কৃতিত্ব নেই। এর মানে এই নয় যে, বইগুলো খুবই ভালো। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন, নদী বিষয়ক বই কখনো অবিক্রীত থাকে না। দেখবেন, বইমেলায় লোকজন নদী বিষয়ক বই খুঁজে নিয়ে কেনে। তার মানে, বাজারে নদী বিষয়ক বইয়ের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। প্রকাশকরা এই বিষয়ে নজর দিতে পারেন। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি, নদী বিষয়ক বই প্রকাশ করে কেউ লোকসানে পড়বেন না।
রিভার বাংলা : আপনার প্রথম বই কবে প্রকাশিত হল? সেই অভিজ্ঞতা কেমন?
শেখ রোকন : আমার প্রথম বই নদী বিষয়ক বই। মেঘনা পাড়ের সংকট ও সংগ্রাম। এটা প্রকাশ হয়েছিল ২০০৬ সালে। তখনও আমি এক অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ক্লাস শেষ, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। আপনার মনে থাকতে পারে, এখন যে সরকার সারাদেশে জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, তার পাইলটিং হয়েছিল চাঁদপুরের ষাটনল থেকে চর ভৈরবি পর্যন্ত ষাট কিলোমিটার এলাকায়। ২০০৪-০৫ সালের দিকে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশ এবং স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা এলআইপিপি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল ওই কর্মসূচি মূল্যায়ন করে পপুলার ল্যাঙ্গুয়েজে একটি প্রকাশনা তৈরি করার। আমার প্রথম বই ওই কর্মসূচির মূল্যায়ণ। যদিও উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে বইটি, আমি পর্যাপ্ত স্বাধীনতা পেয়েছিলাম নিজের মতো করে কাজ করার। মনে আছে, প্রশংসিত হয়েছিল। সহজ বাংলায় মেঘনার ইলিশনির্ভর জেলেদের নিয়ে লেখা। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছিল শিল্পী কনক চাপা চাকমার একটি পেইন্টিংস। আর আপনি জানেন, প্রথম বইয়ের আবেগ কখনো তুলনা হতে পারে না। প্রকাশনা প্রক্রিয়ায় যদিও আমার দরকার নেই, তবু প্রত্যেকটি পর্যায়ে গিয়ে বসে থেকেছি। মেকআপের সময়, ছাপার সময়, বাঁধাই হওয়ার সময়।
রিভার বাংলা : আমরা জানি, আপনি নদী বিষয়ক একটি সাময়িকী সম্পাদনা করতেন। এর নতুন কোনো সংখ্যা দেখি না।
শেখ রোকন : ধন্যবাদ, ভালো প্রসঙ্গ তুলেছেন। এর নাম ‘নদী’। এটা রিভারাইন পিপলের মুখপত্র। মোটে তিনটি সংখ্যা প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় সাড়া ফেলেছিল। পরে একটি সংখ্যার সব কাজ সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও আর প্রকাশ হয়নি সময়, সঙ্গতি ও সঙ্গীর অভাবে। এ প্রসঙ্গে আমি বলে থাকি, সংগঠন ও বুদ্ধিবৃত্তি একসঙ্গে চলে না। রিভারাইন পিপলে বেশি মনোযোগ দিতে গিয়ে আমার নিজের লেখালেখি, সম্পাদনার কাজ নিশ্চিতভাবেই বিঘ্নিত হয়েছে। আপনি জানেন, রিভরাইন পিপল অলাভজনক সংগঠন। কেউ যদি স্বতস্ফূর্তভাবে নদী প্রকাশনায় আমার সঙ্গে কাজ করতে চায়, তাহলে প্রকাশনাটি সহজ হতো। অবশ্য আমরাও এখন প্রকাশনাটি নিয়মিত করার কথা ভাবছি। এ বছরেই হয়তো একটি সংখ্যা প্রকাশ হবে। অন্তত বার্ষিক প্রকাশনা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে চাই।
রিভার বাংলা : এই মেলায় প্রকাশিতব্য বইটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে আরেকটু বিস্তারিত বলবেন?
শেখ রোকন : এটা আসলে নদী বিষয়ে আমার নিজের সাক্ষাৎকার সংকলন। মনে আছে, ২০১২ সালে বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে বিবিসি বাংলা আমার একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করেছিল। তারপর গত সাত-আট বছরে নদীরই নানা প্রেক্ষিত নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছি বা কথা বলেছি। পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টালে। এতে যেমন উঠে এসেছে আন্তঃসীমান্ত বা অভিন্ন নদীর প্রসঙ্গ, তেমনই উঠে এসেছে নদী সংস্কৃতির চিত্র। দখল, দূষণ, ভাঙন, বা বালু উত্তোলন নিয়ে যেমন, তেমনই বলতে চেয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধে নদীর ভূমিকার কথা। স্বাভাবিকভাবেই নদীর কথা বলতে গিয়ে রিভারাইন পিপল ও এর নানা কর্মসূচির কথা এসেছে। আমি ও রিভারাইন পিপল আসলে অনেকটা অভিন্ন হয়ে গেছি। রিভারাইন পিপল বাদ দিয়ে আমার নদী বিষয়ক চিন্তা ও তৎপরতা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কোনো কোনো সাক্ষাৎকারে আমার নিজের জীবনেও নদীর প্রভাবের কথা উঠে এসেছে। শৈশবের কথা, কীভাবে নদী নিয়ে কাজে আকৃষ্ট হলাম, সেসব কথা। আমার নদীবিষয়ক জীবন, চিন্তা ও তৎপরতার কথা উঠে এসেছে বলে এক ধরনের আত্মজৈবনিক নাম দিয়েছি- ‘নদীময় জীবন’।
রিভার বাংলা : এর প্রকাশক কে?
শেখ রোকন : আদর্শ। আদর্শ আমার পছন্দের প্রকাশনাগুলোর একটি। তারা আমার আরও অন্তত দুটি বই প্রকাশ করেছে। জলবায়ু জিজ্ঞাসা ও নিসর্গের নোটখাতা।
রিভার বাংলা: আপনার বইয়ের সফল প্রকাশনা ও প্রচার কামনা করি। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
শেখ রোকন : আপনাকেও ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। রিভার বাংলা খুবই ভালো করছে। আরও সমৃ্দ্ধি কামনা করি। আমার নদীময় শুভেচ্ছা সবসময়ই আপনাদের সঙ্গে থাকবে।
আর ও পড়তে পারেন…
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় নদী সংকেত দেয়
আলী আকবরের নস্টালজিয়া : সৈয়দ কামরুল হাসান
লেখক ফয়সাল আহমেদ’র জন্ম- ২৬ জানুয়ারি ১৯৮৪ খ্রি, কিশোরগঞ্জ জেলায়। বর্তমান বসবাস ঢাকায়। তিনি গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত আছেন। সম্পাদনা করছেন অনলাইন ম্যাগাজিন নরসুন্দা ডট কম ও নদী বিষয়ক অনলাইন পত্রিকা “ রিভার বাংলা” ডট কম। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করছেন বই বিষয়ক পত্রিকা “এবং বই”।
লেখকের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চারটি। এরমধ্যে তিনটি গল্পগ্রন্থ। প্রথম গ্রন্থ ‘স্বপ্ন ও একটি গ্রাম’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালে, দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘সেদিন বৃষ্টি ছিল’- ২০১৫ ও ২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘চিরকুট’। সর্বশেষ প্রকাশিত হয়েছে জীবনী ভিত্তিক বই ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম: মহাজীবনের প্রতিকৃতি’।
ছাত্র জীবনে যুক্তছিলেন ছাত্র আন্দোলনের সাথে। পালন করেছেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।