বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, নদীমাতৃক দেশে নদীই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। নদীর পলিবাহিত পলি দ্বারা গঠিত হয়েছে এ দেশ। এ জন্য বাংলাদেশকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা এ দেশের চিরায়ত সৌন্দর্যের অন্যতম অনুষঙ্গ নদী। স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এ দেশের অনেক নদ-নদী হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। নগরায়ণ আর আধুনিকায়নের করাল গ্রাসে অধিকাংশ নদ-নদী মৃতপ্রায়। দেশের বেশিরভাগ নদ-নদী দখল, দূষণ আর নাব্যতা সংকটে ধুঁকছে। কী শহর কী গ্রাম সব জায়গাতেই চলছে নদী দখল ও ভরাটের মহোৎসব। নদীমাতৃক তকমাটাই বাংলাদেশে যেন প্রশ্নবিদ্ধ! বাংলাদেশে নদী হারিয়ে কিংবা বিলীন হয়ে যাওয়ার হার পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকে অনেক বেশি। এক কথায় বললে, স্বাধীনতার পর দেশের দুই-তৃতীয়াংশ নদীই হারিয়ে গেছে। প্রধান নদী, শাখা নদী, উপনদী কোনোটাই রেহাই পাচ্ছে না। সরকারি হিসাবে, স্বাধীনতার আগে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ছিল ৭০০-এর বেশি। এখন টিকে আছে মাত্র ৪০৫টি। বেসরকারি হিসাবে নদী আছে ২৩০টির মতো। বাংলাদেশে এমন কোনো নদী খুঁজে পাওয়া বিরল যে নদী দখল ও দূষণের কবলে পড়েনি। নদী-শাখানদী-উপনদীর সমন্বয়ে বিশে^র অন্যতম বৃহত্তম নদীব্যবস্থা গড়ে উঠেছে এ দেশে। কিন্তু অপরিকল্পিত সøুইস গেট, ক্রস ড্যাম, বক্স কালভার্ট নির্মাণ, শিল্পকারখানার দূষণ, দখল, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়া, গুরুত্বপূর্ণ নদীর ওপর ভারতসহ অন্য দেশের বাঁধ নির্মাণ, পানি আগ্রাসন, অপরিকল্পিত নদী শাসন, নদীর সঙ্গে সহাবস্থান না করা ও জনসাধারণ পর্যায়ে নদী সচেতনতা গড়ে না ওঠার কারণে সারাদেশের নদ-নদীগুলো ধুঁকছে। ধীরে ধীরে নদ-নদীগুলো মৃতপ্রায় ও প্রাণহীন হয়ে পড়ছে।
ঢাকার আশপাশের নদ-নদীগুলো ব্যাপক মাত্রায় দখল ও দূষণের শিকার। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু, ধলেশ^রীর মতো বৃহৎ নদ-নদীতে প্রাণ নেই বললেই চলে। প্রভাবশালীদের থাবা আর কলকারখানার দূষণ নদীগুলোকে বিপন্ন করে তুলেছে। এখনই উদ্যোগ না নিলে নদীতীরবর্তী শহরগুলোই এক সময় হুমকির মুখে পড়বে। অপরদিকে ভারতের পানি আগ্রাসনের কবলে পড়ে দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদীগুলোর পানি দিন দিন কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো নদী ধুধু বালুচরে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি ব্যাপকহারে কমে যাওয়ার ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের সেচ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর সঙ্গে নৌপথও কমে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সময় দেশে নৌপথ ছিল প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে তা কমে হয়েছে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার। শুষ্ক মৌসুমে এই নৌপথ আবার ব্যাপকভাবে কমে দাঁড়ায় প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার। নদ-নদীগুলো ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় বর্ষা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। নদ-নদীর এ মরণদশায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এ ছাড়া নদীকেন্দ্রিক জীবিকার্জনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
নদী যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ তেমনি অর্থনৈতিক সম্পদও। সেচনির্ভর কৃষি ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় ভরসা নদ-নদীর পানি। এক সময় নদীর পলিবাহিত অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি ফসল উৎপন্ন হতো। কিন্তু বর্তমানে দখল ও ভরাটের ফলে ছোট-মাঝারি নদ-নদীগুলোতে স্রোত ও জোয়ার-ভাটা হয় না বললেই চলে। দেশের এই বেহাল নদ-নদীগুলোর কারণে এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ছে হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল ও ঝিলের ওপর। এগুলোও দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে বর্তমানে নদী রক্ষার সঙ্গে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জড়িত আছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না! নদীর দখল-দূষণ ও ভরাট ঠেকানো যাচ্ছে না। ফলে একটার পর একটা নদী হারিয়ে যাচ্ছে। এখনই যদি দেশের নদ-নদী রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা না যায়, তা হলে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের নদ-নদী রক্ষায় নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে। যথাÑ ১. নদীতে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাঁধ না দিয়ে নদীবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। ২. নদীতে সকল প্রকার দখল-দূষণ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩. নাব্যতা সংকটে ভুগতে থাকা নদ- নদীগুলো ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের (গভীরভাবে নদী খনন) মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে খননের উদ্যোগ নিতে হবে। ৪. নদীতে যত্রতত্র পোল্ডার, সøুইস গেট তৈরি ও অপরিকল্পিত নদী শাসন না করে নদীর সঙ্গে সহাবস্থান করার পদক্ষেপ নিতে হবে। ৫. উজানে যেসব নদীর ওপর ভারতসহ অন্য দেশ যেসব বাঁধ দিয়েছে ও দিচ্ছে, আলোচনা করে সেসব নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে। ৬. দেশের প্রতিটি নদী রক্ষায় একটি করে আলাদা কমিটি গঠন করতে হবে (এই কমিটিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার নদী বিশেষজ্ঞ, যুব সম্প্রদায় ও সরকারের প্রতিনিধি রাখতে হবে)। ৭. সর্বোপরি নদী যে আমাদের মূল্যবান সম্পদ এ ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
সাধন সরকার : কলাম লেখক।দৈনিক আমাদের সময়। প্রকাশ | ২৬ এপ্রিল ২০১৮
আরো পড়ুন….