অতিমারির দাপটে ধরিত্রীর এই শুদ্ধিকরণ অধ্যায়ে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসটি আবার পড়তে গিয়ে চমকে উঠলাম।বহু বছর আগে পড়েছিলাম। কিন্তু তখন যে ভাবনাটি আমার মনোজগতে ছায়া ফেলেছিল তা ছিল অতি সাধারণ। কয়েকটি সকরুণ চিত্র। মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছিলাম, মরণাপন্ন একটি নদী, যার নাম বাঁকাল, তার কূলে গড়ে ওঠা কুমুরডাঙ্গা নামে কোন এক গ্রাম। তবারক নামের একজন ব্যক্তি পুঁথিপাঠের মত বলে চলেছে সেই গ্রামের নানা গল্প। সে গল্পের সুতো ধরে এসেছে অনেকগুলো চরিত্র। কেউ সবাক। কেউবা আড়ালমুখি এবং নির্বাক। তবে সব চরিত্রকে ছাড়িয়ে বড় হয়ে উঠেছিল বাঁকাল নদী। এ নদীর বুকেই সঞ্জীবিত হয়ে আছে এ গ্রামের প্রাণভোমরা। তাই বাঁকাল নদীর মৃত্যু মানেই কুমুরডাঙ্গার মৃত্যু।
পড়তে গিয়ে একটি বিষয়ে অদ্ভুত লেগেছিল তখন, নদী কী কাঁদে? আমিও তো নদী পারের এক ছোট্ট শহরের মানুষ, কখনো তো নদী মধুমতি’র কান্না শুনতে পাই না! সকাল-সন্ধ্যা বন্ধুদের সাথে তো নদীর কাছেই ঘুরঘুর করি। কখন কাঁদে নদী? তবে কি রাতদুপুরে!আমরা যখন ঘুমিয়ে পড়ি গভীরগহন সুষুপ্তিতে, তখন?
বয়েসাক্রান্ত প্রাচীন মুরুব্বিরা আমাদের বলতেন, বাছা নদীও কাঁদে! এ মধুমতি কী আর সে মধুমতি আছে! এ যে বালুতে মুখ থুবড়ে পড়া ধুঁকনি মধুমতি। শক্তি কই যে কাঁদবে! এর সব কান্না যে শেষ হয়ে গেছে! তাই তো তোমরা শুনতে পাও না মনা ।
একদিন ড্রেজার এলো। ফ্যাকাশে লাল তারগায়ের রঙ। মাস্তুলে বাঁধা লালসবুজ পতাকা। আমরা অবাক, উত্তেজিত। উল্লসিত হয়ে ছুটে বেড়াই এপার ওপার। কিন্তু প্রাচীনদের চোখে ছিল উপায়হীন হতাশ দৃষ্টি। তাঁরা কথাও বলছিল নিয়তির কাছে হার মানা ম্রিয়মান সুরে। কারণ এ ড্রেজার আগেও এসেছে। অনেক বার। নদীর বুক খুঁড়ে কাদামাটি তুলতে তুলতে বুড়ো হয়ে গেছে বেচারা ড্রেজার।
পলিমাটির স্তর জমাট বেধে গেছে মধুমতির বুকে। খুব ছোট অতি সাধারণ লঞ্চও আজকাল আটকে যাচ্ছে চরায়। সে সব কেটে গভীর করা হবে নদীকে। দুইপারে মানুষের ভিড়। তারা গল্প করছে। আর তখন জানতে পারলাম মরা মধুমতির সেই ভয়াল যুগের কথা। এক সময় ষ্টীমার চলত এ নদীর বুক চিরে। সাজানো বজরা, বিশাল নৌকাও যেত। নদীতে ছিল হাঙ্গর, কুমির, শিশু(ডলফিন) আর অসংখ্য মাছের খনি। আমরা স্বাধীনতার পরের প্রজন্ম শুধু দেখেছিছোট ছোট লঞ্চ, টাবুরে নৌকা, এপার ওপার পাড়ি দেওয়ার জন্য ক্ষুদ্রতর খেয়া নাও। ড্রেজার এর কর্মীরা জানালো এইই শেষবার। আর আসবে না তারা। এ নদী কখনো বেঁচে উঠবে না।
সেদিন থেকে বুঝতে পারলাম প্রকৃতির নিয়মে অন্তিম শয়ানে শুয়েছে মধুমতি। অনেকটা যেন বাঁকাল নদীর মত। আমরা যারা নদীপারের মানুষ তারা জানি, নদী ডাকে। বানে ভাসায়। বন্যায় ডুবিয়ে দেয়। বর্ষায় মেতে ওঠে ভাঙ্গনের খেলায়। তবে কেন কাঁদবে না? নিশ্চয় কাঁদে। যেমন কাঁদে বুড়িগঙ্গা নদী। মনুষ্য সৃষ্ট পলিথিনের আবরণে ঢেকে গেছে বুড়িগঙ্গার প্রাণ। দখলে সংকুচিত হয়ে গেছে উদ্বেলিত বিশাল বুক। প্রকৃতি নয়। এ হত্যাযজ্ঞ চলছে মানুষের দ্বারা। নদীপারের মানুষরা জানে, তারা শুনতে পায়, কাঁদছে তাদের প্রিয় বুড়িগঙ্গা।
যশস্বী কথা সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ শুনতে পেয়েছিলেন কুমুরডাঙ্গার বাঁকাল নদীর কান্না। তিনি তাঁর এই কান্নার সঙ্গী করে নিয়েছিলেন এ উপন্যাসের সাদাসিধে নারী শিক্ষিকা সখিনাকে । ক্রমে সখিনা থেকে কুমুরডাঙ্গা গ্রামের আরও অনেকেই শুনেছিল বাঁকালের কান্না। শুনতেই হবে। মানুষ যে প্রকৃতির সন্তান।
পড়ুন রুখসানা কাজল এর আরও লেখা…
আমার নদী মধুমতী ।। রুখসানা কাজল
নদী কীর্তিনাশা ।। রুখসানা কাজল
সভ্যতার ইতিহাস জানতে গিয়ে দেখা গেছে, সভ্যতার ক্রমবিকাশে নদীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত নদীকে কেন্দ্র করে পত্তন হয়েছে সভ্যতার। বাংলাদেশে ২৪১৫৫ দীর্ঘ নদীপথ আর প্রায় ৭০০টি নদী আছে। এই নদীগুলোর উৎস ভারত, চীন, মেঘালয়ে। এরমধ্যে কতগুলো নদী মরে গেছে। কিছু নদী মরনোন্মুখ। আবার ক্ষমতাসীন হার্মাদদের কব্জার ক্যারিকেচারে কিছু নদী বুজে গেছে। দখলে হাঁসফাঁস করছে নদীর হৃদয়। প্রকৃতিগতভাবে পলি পড়ে বা চর জেগে কিছু নদী হারিয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।
‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে যে খরতোয়া বাঁকাল নদীতে ষ্টীমার আসা যাওয়া করত সে নদীতেও টিউমারের মত এখানে সেখানে চর জেগেছে। চোখকান খোলা উকিল কফিলউদ্দিন চরজাগার কথাকিছুতেই বিশ্বাস করেন না। চরজাগার কারণে ষ্টীমার বন্ধের ঘোষণার ভেতর তিনি ইংরেজ সরকারের যড়যন্ত্রের গন্ধ পান।
আমি অবাক হয়ে ভাবি, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এর অসাধারণ লেখনি সত্ত্বাকে নিয়ে। কী অতল গভীর অনুভূতি তাঁর সত্ত্বার। কি ক্ষুরধার অবলোকন! মাত্র তিনটি ( কদর্য ঐশীয় ফাল্গুন- ২০০৬, মরণোত্তর ) উপন্যাস লিখে বাংলা সাহিত্যের রাজ্যে তাঁর অমিত অভিষেক ঘটেছিল যা এখনও বহমান। তিনটি উপন্যাসই ব্যতিক্রম। স্বতন্ত্র ধারণা নিয়ে লেখা হলেও তিনটি উপন্যাসেই নারী এসেছে। লালশালু এবং চাঁদের অমাবস্যায় নারী চরিত্ররা সুস্পষ্ট। কিন্তু ‘কাঁদো নদী কাঁদো’উপন্যাসের যে জন নারী তিনি কুমুরডাঙ্গা গ্রামের প্রাণদায়িনী বাঁকাল নদী।
নদী কি নারী নয় ? এউপন্যাসে নদীকে আমার নারী বলেই প্রত্যয় হয়েছে। বাংলাদেশের অন্যান্য গ্রামের মত কুমুরডাঙ্গাও একটি সাধারণ গ্রাম। এখানে যড়যন্ত্র যেমন আছে তেমন আছে হিংসা ঈর্ষা ঝগড়া প্রতিশোধের সম্পর্ক। আছে মুহাম্মাদ মুস্তাফার মত চিন্তাশক্তিতে অচল এক দমবন্ধ মানুষ। অনিশ্চয়তা যার অস্তিত্বে সর্বদা ঘিরে থাকে। কখনও কখনও আমার মনে হয়েছে মুহাম্মাদ মুস্তাফা যেন বাঁকাল নদীর মতই অদৃশ্য ডুবোচরে ঘেরা এক বিভ্রান্ত মানুষ। স্রোতহীন। আবদ্ধ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে যখন উপন্যাসটি পড়তে বসেছি তখন আশ্চর্য হয়ে দেখেছি মুহাম্মাদ মুস্তাফার মত বাংলাদেশের মানুষও বিভ্রান্ত আবদ্ধ। যেখানে নদীবিজ্ঞানীরা বার বার সতর্ক করছে, বিশ্বের জলবায়ু গবেষকরা সমূহ আশঙ্কা প্রকাশ করছে, আগামী বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। খরা পীড়িত হয়ে উঠবে আমাদের ধরিত্রী। মাত্র ১৩ থেকে মতান্তরে ১৭ ভাগ বনভূমি রয়েছে আমাদের। গাছ নিধন করে, নদী, খালবিল, জলাশয় ভরাটকরে বর্তমানে বাংলাদেশ যে সভ্যতার সৃষ্টি করেছে তা দ্রুত মরুভূমি্র থাবার নিচে মরতে প্রস্তুত হয়ে আছে।
বাংলাদেশের রাজশাহী দিনাজপুরে মরুভূমিয়ানের প্রাকৃতিক চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। দিনাজপুরে ফুটেছে মরুভূমির ফুল সূর্য শিশির। পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। বৃষ্টি কমে গেছে। দিনে গরম রাতে শীত পড়ছে। নাব্যতা হারিয়ে মরা চোখে চেয়ে আছে অনেক নদি। বাঁকাল নদীর মত এ নদীগুলোও কাঁদছে। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ যে অমোঘ সর্বনাশ নিয়ে রচনা করেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্আজ ২০২১ সালে সে সর্বনাশের বাস্তব রপ দেখতে পাচ্ছি। যে কারণে অন্যদুটি উপন্যাসের চাইতে এই উপন্যাসটি আমার কাছে একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যদ্রষ্টা হিসেবে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। আর একথা তো সর্বজন স্বীকৃত কবি লেখক উপন্যাসিকরা ভবিষ্যৎ দেখতে পান।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ তাই কেবল বাংলা জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশের নদীখোর দখলবাজদের হাতে জিম্মি সরকার, আমলা, জনপ্রতিনিধি এবং অসচেতন বাঙ্গালী জাতি ও নদীবিজ্ঞানীদের জন্যে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’র মতো একটি আয়না রেখে গেছেন। স্বল্প জীবনের অধিকারী শক্তিশালী উপন্যাসিকের জন্যে রইল আমার অপরিসীম শ্রদ্ধা এবং মুগ্ধতা।