চূর্ণীকথা : একটি নদীপ্রবাহের উৎসের খোঁজে – গৌতম অধিকারী

রবীন্দ্রনাথের ‘কথা’ কাব‍্যের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতায় ‘গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা’ রটে যাবার সূত্রে আমরা জেনেছিলাম, ‘মৈত্র মহাশয় যাবে সাগরসঙ্গমে/ তীর্থস্নান লাগি।’ মৈত্র মহাশয়ের এই ‘গ্রাম’ কিংবা সংবাদ রটে যাওয়া গ্রামগুলো যে চূর্ণী নদীতীরেরই সব সাধারণ পল্লি, সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ থাকে না। বিশেষ করে এই কবিতাটিতেই যখন তিনি সাগর-তীর্থে শুভযাত্রাকালীন বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখেন, শুভক্ষণে দুর্গা স্মরি নৌকা দিল ছাড়ি/ দাঁড়িয়ে রহিল ঘাটে যত কূলনারী/ অশ্রুচোখে। হেমন্তের প্রভাত শিশিরে/ ছলছল করে গ্রাম চূর্ণীনদীতীরে

‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার সমাপনী কাহিনিটি বড়োই করুণ। সাগরতীর্থ থেকে ফেরার পথে বিধবা মোক্ষদার শিশুপুত্র রাখালকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল। কেননা, সাগরতীর্থে যাত্রাকালে মায়ের সঙ্গী হতে নাছোড় রাখালকে বিরক্ত ও ক্রোধে বলেছিল, ‘চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে।’ সাগরতীর্থে পুণ‍্যস্নান শেষে মৈত্র মহাশয়ের নৌকাটা যখন স্বদেশ-অভিমুখী, তখন অসময়ের সমুদ্রের তুফান যেন সাবধানবাণী উচ্চারণ করে, ‘দেবতার ধন কে যায় ফিরায়ে লয়ে এই বেলা শোন..।’ প্রথানুগত‍্য, ও সংস্কারে আবদ্ধ মৈত্র মহাশয় মোক্ষদাকে চিহ্নিত করে বলেন, ‘এই সেই রমণী/ দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে/চুরি করে নিয়ে যায়।’এরই পরিণতিতে মাঝি-মাল্লারা রাখালকে মায়ের বুক থেকে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে সমুদ্রের জলে। কিন্তু মুহূর্তে ঘটে গেল অন‍্য ঘটনা। নিরুপায় অনাথ অন্তিমের ‘মাসি ! মাসি !’ চিৎকারে মৈত্র মহাশয়ের ‘মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ‍্যুতের কশা।’ সংস্কারের সমস্ত দংশন-ভীতি অগ্রাহ‍্য করে ‘ফিরায়ে আনিব তোরে’- কহি ঊর্ধ্বশ্বাসে/ ব্রাহ্মণ মুহূর্ত মাঝে ঝাঁপ দিল জলে।/ আর উঠিল না! সূর্য গেল অস্তাচলে।’

রবীন্দ্রনাথ জানতেন, বস্তুবিশ্ব নির্দ্বান্দ্বিক নয়, দ্বন্দ্বহীন নয় মানবমনের গতিও। ভাবনার বিচিত্র রহস্যময়তা, সযত্ন অথবা অযত্নলালিত  সংস্কার মানব-বিশ্বের নানা আহ্বান প্রতিনিয়ত মানুষের মনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। দ্বন্দ্বমুখর মানবমনে বস্তুবিশ্বের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ারই ছায়াপাত। বস্তুবিশ্বে যেমন অণু-পরমাণুর দ্বন্দ্বই বস্তুর গতিময় অস্তিত্বের ভরকেন্দ্র, তেমনই চেতনার অন্তর্নিহিত সংঘাতই মানবমনের গতির নিয়ন্ত্রক। ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার মৈত্র মহাশয় ধর্মীয় সংস্কারের শৃঙ্খলে বাঁধা মানুষ। আবার তারই মধ‍্যে মানবিক অনুভূতি ও কর্তব্যবোধের জগত। দায়বদ্ধতার নিবিড় উপলব্ধি থেকে তিনিও শোনেন মানবিক বিশ্বের অমোঘ আহ্বান। যে আহ্বান শুনে প্রাণবিসর্জনের আশঙ্কাতেও তাঁর মনে কোনো দ্বিধা থাকে না। প্রকৃত প্রস্তাবে এই দ্বন্দ্বটাই ইতিহাসের গতিপথের নিয়ন্ত্রক। ‘ছলছল করে গ্রাম চূর্ণী নদী তীরে’ বলে কবি ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার সূচনায় এঁকে দিলেন যেন দ্বান্দ্বিক ইতিহাসেরই কোনো করুণ ঘটনার ছায়া। সেই ইতিহাস করুণ হলেও সহৃদয়ের হৃদয়সংবেদী, সংস্কারে নির্মম হলেও পরিণতিতে মহৎ।একদিকে সীমাবদ্ধতা, অন‍্যদিকে জীবনের মহত্তর উপলব্ধিতেই ধরা চূর্ণী ও তার তীরবর্তী জনপদের ইতিহাস।

ইতিহাসের যেমন একটি সূচনা থাকে, তেমনই থাকে ‘সূচনা’র-ও সূচনা। যাকে বলা যায়, সলতে পাকানোর ইতিহাস। ইতিহাসের সেই পৃষ্ঠাগুলো উল্টালে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, চূর্ণী ব-দ্বীপ অঞ্চলের কোনো স্বাভাবিক নদী নয়। একটি কৃত্রিম নদী চূর্ণী। নদী-বিশেষজ্ঞদের অভিমত ও ব‍্যাখ‍্যাতেও এই সিদ্ধান্তের সমর্থন মিলে যায় অনায়াসে। বাংলা-আসামের ডিরেক্টর অব সার্ভেস মেজর এফ. সি. হার্স্ট তাঁর ‘Interference of Human Agency with the Rigme of Nadia Rivers’ শিরোনামের রিপোর্ট বা প্রতিবেদনে লিখেছেন,
“বহুকাল ধরে মানুষের খেয়ালের বশে
এইসকল নদীর মরা-বাঁচা নির্ভর করছে।
এটা সুস্পষ্ট যে মাথাভাঙা নদীর পূর্বগামী
ধারায় মানুষের হাত পড়ায় চূর্ণী নদীর সৃষ্টি
হয়েছে।” ( অনুবাদ : লেখক )
হার্স্ট তাঁর প্রতিবেদনে যে ‘Human Agency’-র কথা বলতে চেয়েছেন, চূর্ণীর সৃজন-ইতিহাসে সেই Agency-র মুখপাত্র হলেন দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র। ১৭৪৩ সালে কৃত্রিম নদীপ্রবাহপথ চূর্ণীর তিনিই আদি রূপকার।

আদিনিবাস হুগলি জেলার কোন্নগর, জন্ম বর্ধমানের দাঁইহাটের নিকটবর্তী চাণ্ডুলী গ্রামে। কৈশোরে দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হয়ে উঠেছিলেন নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সর্বক্ষমতাসম্পন্ন দেওয়ান। ইতিহাস বলে, ১৭৪০ সালে নবাব আলীবর্দী খাঁ রাজ-সিংহাসনে বসবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বারো লক্ষ টাকা নজরানা বকেয়া থাকার অভিযোগে কৃষ্ণচন্দ্রকে কারারূদ্ধ করেন। সদর্থক উদ‍্যোগ গ্রহণ করে রঘুনন্দন মিত্র কৃষ্ণচন্দ্রকে কারামুক্ত করেন। ১৭৪২ সাল থেকে বর্গীর হাঙ্গামা শুরু হয় বঙ্গদেশে। তখন রাজপরিবারের নিরাপত্তা ও ধনৈশ্বর্যকে সুরক্ষিত রাখার জন্য দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্রের পরামর্শ অনুযায়ী রাজ‍্যের অন‍্যতম নিভৃত স্থান বর্তমানে শিবনিবাস নামে পরিচিত স্থানটিতে রাজধানী স্থাপন করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। রাজপুরীকে বর্গী আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করবার পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর চারপাশে পরিখা খনন করে তাকে জলপূর্ণ করা হয়। অনেকেই মনে করেন, এই প্রয়োজন থেকেই চূর্ণীর সৃষ্টি। তবে আমাদের এটাকে সর্বাংশে সত‍্যি বলে মনে হয় না। কারণ নিছক সুরক্ষাবলয় তৈরি করার জন্য হলে রঘুনন্দন রাজপুরীর চারপাশে বদ্ধ জলাশয়-খাত খনন করেই কর্তব্য সমাপ্ত করতে পারতেন। তা না করে তিনি রাজপুরীর পাশ দিয়ে স্রোতবতী নদীকে বইয়ে দিয়েছিলেন। কারণ রাজা হিসেবে প্রজাদের প্রতি দায়িত্বপালনে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রভূত সীমাবদ্ধতা থাকলেও দেওয়ান রঘুনন্দন ছিলেন স্বপ্নদর্শী মানুষ। নবপ্রতিষ্ঠিত নগরীকে বাণিজ্যিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, প্রজাদের জীবন-মানের উন্নয়ন প্রভৃতির স্বার্থেই স্রোতবতী বহতা নদীর স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। স্বপ্নের কারিগর মানুষটি তাই আজও  নদীয়ার লোকপ্রবাদে সম্মানিত হয়ে থাকেন,-
“শিবনিবাসী পুণ‍্য কাশী হায় রে নদী কঙ্কণা।
কোথা হতে এলে তুমি রাঢ়ের রঘুনন্দনা।।”

চূর্ণীনদী

পুরাণে কথিত আছে সুরধুনী গঙ্গাকে পৃথিবীতে এনে পৃথিবীকে পাপমুক্ত ও সুজলা-সুফলা করেছিলেন ভগীরথ। নদীয়ারাজের দেওয়ান রঘুনন্দন মিত্র মাথাভাঙা থেকে গঙ্গা পর্যন্ত প্রসারিত চূর্ণী ধারাকে উন্মুক্ত করে এক সম্পন্ন জনজীবনের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই অঞ্চলের মানুষ সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতির বিকাশের ইতিহাস। প্রচলিত লোকপ্রবাদের সাক্ষ‍্য থেকে বোঝা যায় চূর্ণীর এই উৎসস্থলে নাম ছিল কঙ্কনা।১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয় কবি ও নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রের ‘সুরধুনী কাব‍্য’। সেখানেও বেশ কয়েকটি ছত্রের মাধ্যমে কঙ্কনাকে চূর্ণীর আদি উৎসরূপে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ,-
গঙ্গার চরণে করি সাহসে প্রণতি।
উত্তর করিল চূর্ণী মাথাভাঙা সতী।।
শীকারপুরের কুটি তাহার উপরে।
ছাড়িয়ে এসেছি পদ্মা লহরী নিকরে।।
তিনজন একাসনে কিছুদুর এসে।
কুমার চলিয়ে গেল মাগুরা প্রদেশে।
দুইজন আইলাম কৃষ্ণগঞ্জ ধামে।
তথা হতে ইছামতী চলি গেল বামে।।
সঙ্গিনী বিচ্ছেদ ভাবি নয়নের জলে।
একা আইলাম শিবনিবাসের তলে।
যথায় বিরাজে আজি রাজ নিকেতন।
পাতিত করেছে কিন্তু কাল পরশন।।
এক্ষণে গঙ্গেশচন্দ্র রাজা তথাকার।
কৃষ্ণচন্দ্র অংশ তায় করিছে বিহার।।
কঙ্কনের মতো আমি এসেছি ঘুরিয়ে।
তাই সে থাকে মোরে কঙ্কণা বলিয়ে।।

এই বর্ণনা থেকে বোঝা যায় পদ্মার শাখা নদী মাথাভাঙা কৃষ্ণগঞ্জ এর কাছে এসে দ্বিধাবিভক্ত হয়।বামমার্গী ইছামতী এবং দক্ষিণ বাহিনীর নাম হয় কঙ্কণা। কেননা, মেয়েদের হাতের চুড়ির মতই প্রায় বৃত্তাকার ছিল তার প্রবাহপথ। অনেকে বলেন এই নামটি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রদত্ত ।

এ প্রসঙ্গে একটি গল্প এতদাঞ্চলে মুখে মুখে প্রচলিত আছে। এক সময় মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নসরত খাঁ নামক জনৈক দুর্ধর্ষ দস্যুকে ধরবার জন্য তাকে অনুসরণ করছিলেন। প্রাণ ভয়ে নসরত খাঁ মাথাভাঙা ইছামতী নদীর কাছাকাছি এক গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে। দস্যুর এই বেড়টি তার নামে অর্থাৎ নসরত খাঁ-র বেড় নামে পরিচিত ছিল। স্থানটির চারপাশে প্রায় বৃত্তাকার বেষ্টনী আকারের এক জলরাশির অবস্থান, যা বেড়টিকে নিভৃত ও সুরক্ষিত করেছিল। এই স্থানটিতে দেওয়ান রঘুনন্দন এর পরামর্শে নতুন রাজধানী স্থাপনের সম্মত হলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এই প্রচলিত গল্প কথার সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠীর অন্যতম গদ্য লেখক রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় রচিত ‘মহারাজা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র চরিত্রং’ গ্রন্থেও। ১৮১১ সালে লন্ডন থেকে মুদ্রিত এই গ্রন্থে বলা হয়েছে
“মহারাজা সপরিবারে নূতন করিয়া সকল
পুরী দেখিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া পাত্রকে
রাজপ্রাসাদ দিলেন.. রাজা শুভক্ষণে পুরী
মধ্যে প্রবেশ করিলেন আহ্লাদের সীমা নাই
পুরীর শিবনিবাস, নদীর নাম কঙ্কনা
রাখিলেন।”

কিন্তু বিতর্কের বিষয় এই যে, এই কঙ্কনা থেকেই কি চূর্ণী নদীর ধারা প্রবাহিত? কেননা, শিবনিবাস পত্তনের পর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের উদ্যোগে এবং রঘুনন্দনের কর্মকুশলতায় দুটি খাল খনন খবর জানা যাচ্ছে। মূলত শিবনিবাসের চতুর্পার্শ্বের জলরাশিতে প্রবাহ সৃষ্টি করাই অন্তত এসময়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল।
দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায় আর ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’ গ্রন্থে লিখেছেন –
“চতুর্দিকে যে জলাশয় ছিল তাহার পূর্ব
দিক হইতে সহস্র হস্ত পরিমিত(১/৩ মাইল)
এক খাল কাটিয়া ইছামতী নদীর সহিত ও
পশ্চিম দিক হইতে তিন ক্রোশ (৬ মাইল)
আর এক খাল কাটিয়া হাঁসখালির উত্তরে
‌‌   অঞ্জনা নদীর সহিত মিলিত হওয়ায় ওই
জলাশয় প্রবাহবিশিষ্ট হইল। কঙ্কন সদৃশ্য
গোলাকার ছিল বলিয়া রাজা তাহার নাম
রাখিলেন কঙ্কণা।”

এই উদ্ধৃতির প্রথম বাক্যাংশ প্রমাণ করে , চতুর্দিকে যে জলাশয় ছিল সেটি ‘কঙ্কনসদৃশ্য গোলাকার ছিল বলিয়া রাজা তাহার নাম রাখিল কঙ্কণা’। আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে বর্তমান চন্দননগর (পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার একটি গ্রাম) খেয়াঘাটের পাশে যে তীরে শিবনিবাসের অবস্থান শিবনিবাসকে বামদিকে রেখে যে বিস্তৃত কঙ্কণা বিল নামে পরিচিত জলাশয়টি রয়েছে সেটি চূর্ণীর আদি উৎস কঙ্কনা। এই বিলের পাড় এবং গঠনও সাধারণ বিলের মতো চ্যাটালো নয় বরং এক পাশে দাঁড়ালে অন্য পাড়ের খাড়া অংশকে নদীপাড়ের কিনার বলে মনে করা যায় ভালো ভাবেই। দেওয়ান রঘুনন্দন বর্তমান চন্দননগর খেয়াঘাটের কাছাকাছি অবস্থান থেকে কঙ্কণা আর মুখে একটি খাল কেটে মাথাভাঙা- ইছামতীর সংযোগস্থলে নিয়ে যান। এই ধারাটি বর্তমানে চূর্ণী নামে ওই অংশে পরিচিত। তখন অন‍্য মুখ অর্থাৎ কঙ্কণার একটা অংশ থেকে আর একটি ধারা হাঁসখালির উত্তর দিকে অঞ্জনার সঙ্গে মিলিয়ে  দিয়ে তিন ক্রোশ (৬ মাইল) সেদিন কাটা হয়েছিল সেটিঈ ছিল মাথাভাঙা-কঙ্কনা থেকে গঙ্গা পর্যন্ত প্রবাহিত চুর্নির মূলধারা পথ। এবং দীর্ঘদিন এই ধারাপথ স্রোতবতী  ছিল । যেহেতু মাথাভাঙ্গা থেকে কাটা খালটির অবস্থান কঙ্কনার মুখ থেকে উজানে তাই প্রধান জলধারা কালক্রমে কাটাখাল পথে প্রবাহিত হয়ে মূল কঙ্কনাকে দুর্বল করতে থাকে।

আমাদের এই বক্তব্যের সমর্থন মিলবে ১৯২৮ সালে প্রকাশিত পাদ্রী রেভারেন্ড এইচ. হেবার রচিত ‘ Narrative of Journey Through Upper Province Of India’ (Vol.8)। ঢাকা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে ১৯২৪ সালের ১৫ ই জুন হেবার কলকাতা থেকে জল পথে রওয়ানা হন। ১৬ ই জুন পৌঁছান চন্দননগর বর্তমান হুগলি। ১৭ জুন বেলা দেড়টায় শিবপুর মোহনায় পড়েন, যেখানে চূর্ণী গঙ্গায় মিশেছে। সেদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় হেবার পৌঁছান রানাঘাটে। সেখান থেকে পরদিন অর্থাৎ ১৮ জুন বেলা সাড়ে পাঁচটায় তিনি শিবনিবাসে পৌঁছান। হেবারের বর্ণনা প্রসঙ্গে ‘নদীয়া কাহিনী’র সুখ্যাত লেখক কুমুদনাথ মল্লিক জানিয়েছেন “বেলা সাড়ে পাঁচটায় শিবনিবাস পৌঁছিলেন। রেনেলের ম্যাপ হইতে ইহার অবস্থিতি এতটা ভিন্ন যে হেবার মনে করিলেন মাঝিরা ভুল করিয়া শিবনিবাসে পৌঁছিয়াছে বলিতেছে। রেনেলের নকশা অনুযায়ী ইহা আরো দক্ষিণে ও নদীর অপর পাড়ে অবস্থিত।

এই বর্ণনা অনুযায়ী বলা যায় গঙ্গা থেকে পূর্বমুখী যাত্রাপথে চন্দননগর এবং সেখান থেকে মাথাভাঙা পর্যন্ত যে ধারাকে অনেকে মূল নদীর উৎস বলেন, তাঁরা আদৌ ঠিক বলেন না। তার দক্ষিণদিকে শিবনিবাসের অবস্থান । অথচ হেবার যখন নদীপথে ঢাকা যাচ্ছিলেন তখন তিনি মন্দির ও নগরীকে দেখলেন উত্তর দিকে অর্থাৎ যাত্রাপথের বামদিকে । অর্থাৎ বর্তমান চন্দননগর খেয়া ঘাটের কাছাকাছি জায়গা থেকে কঙ্কনার ধারা ধরেই হেবারের নৌকা মাথাভাঙায় পৌঁছেছিল। বোঝা যায় এই কঙ্কণার খাত শুকিয়ে যাবার ফলে বর্তমান সময়ের চূর্ণীর প্রবাহপথ রঘুনন্দনের অপর কাটাখালটি। এটি শিবনিবাসের বাম দিক দিয়ে প্রবাহিত। তাকে আমরা উৎস হিসাবে গ্রহণ করি ঠিকই, কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবে তা সত‍্য নয়। বর্তমানের কঙ্কনা একটি বিল আকৃতি জলাশয় পরিণত হতে হতে চাষযোগ্য কৃষি জমির রূপ নিয়েছে। স্থানীয় মানুষ তাকে কঙ্কণার বিল হিসেবে চিনলেও ইতিহাস জানে এই মৃত জলখাতটিই চুর্নীর আদি জননী।

গৌতম অধিকারী : কবি, লেখক ও সম্পাদক, কলকাতা, ভারত।

আরো পড়ুন…

কবি গৌতম অধিকারী’র কবিতা- নদী, নারী ও দেশের কথা

কবিতা : শাখা বরাকের আর্তনাদ- মো. আজাদ বারী শিপু

সংশ্লিষ্ট বিষয়