শফিকুল ইসলাম খোকন
আমাদেরকে যেমন বলা হয়ে থাকে মাছে-ভাতে বাঙ্গালি! নদীমাতৃক বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ। প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য মাছ ও ভাত। তাই বাংলাদেশি মানুষকে বলা হয় ‘মাছে-ভাতে বাঙ্গালি’। তেমনি বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ; আমাদের দেশ বিশ্বে নদ-নদীর দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও, এখানে প্রতিবছরই নদ-নদীর সংখ্যা কমছে। দখল, দুষণে শুধু নদী খালই মরছে না, এখন দেশও ধ্বংসের পথে। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে দেশের নদ নদী রা করতে হবে। নদ নদী বেচে না থাকলে,দেশও ধ্বংশ হতে বাধ্য।
আমাদের দেশ বিশ্বে নদ-নদীর দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও, এখানে প্রতিবছরই নদ-নদীর সংখ্যা কমছে। টিকে থাকা নদীর আয়তন তথা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দুটোই কমছে। ফলে বর্তমানে বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা কত আর জলরাশির আয়তন কত- তার হালনাগাদ তথ্য খোদ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছেই নেই। এমনকি নদীরা কমিশনের কাছেও সঠিক তথ্য নেই। ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। যদিও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০১৩ সালের তথ্যে বলা হয় এ সংখ্যা ৩১০টি। আবার জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে নদ-নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৮টি।
যে দেশের প্রতিটি জনপদ গড়ে উঠেছে নদ-নদীকে ঘিরে, সে দেশে নদ-নদীর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি নদীর প্রতি উদাসীনতা। যদিও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দেশ, যেখানকার আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা বা লিভিং এনটিটির স্বীকৃতি দিয়েছে। এশিয়ার ড্রেন হিসেবে পরিচিত বিশ্বের বৃহৎ ব-দ্বীপ বাংলাদেশের শিরা-উপশিরার কাজ করছে নদ-নদীগুলো। আর এই শিরা-উপশিরায় ব্লক সৃষ্টি করছে নদীর ওপর নির্মিত স্থাপনাসমূহ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের জন্য অভ্যন্তরীণ পরিবেশগত বিপর্যয় যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। নদ-নদী দখল-দূষণের মাধ্যমে পরিবেশকে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে। আমাদের জীবন-জীবিকা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য তথা অস্তিত্বের ওপরও আঘাত হানা হচ্ছে। দখল-দূষণের শিকার হয়নি দেশে এমন নদী নেই।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডে চিরচেনা ও পরিচিত বেশির ভাগ নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয়, তিব্বত, আসামের বরাক ও লুসাই পাহাড়ে। এগুলো শেষ পর্যন্ত বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। মানুষের যাতায়াত ও পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব নদী জীবনকে সহজ ও গতিশীল করেছে। আবহমানকাল ধরে এ নদীপথের সাহায্যেই এ দেশের মানুষ তাদের জীবন-জীবিকা গড়ে তুলেছে। কৃষিকাজে জল সেচের প্রধান উৎস এসব নদ-নদী। দেশের মাছের চাহিদার একটি বিরাট অংশ এ নদীগুলো থেকে সরবরাহ হয়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ওপর এসব নদীর প্রভাব অপরিসীম। তাই বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়।
বাংলাদেশের নদীগুলো দেশের জন্য আত্মপরিচয়ের সবচেয়ে বড় রূপ এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের নদীগুলো দেশের ইতিহাস, প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অগণিত গ্রামীণ বাংলাদেশীর জীবন-জীবিকা নদীর উপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ মানুষ তাদের একমাত্র প্রাণীজ প্রোটিন গ্রহণের জন্য নদীর পানির উপর নির্ভরশীল। জিডিপিতে আমাদের মৎস্য খাতের অবদান প্রায় ৩.৬১ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১১ শতাংশ মৎস্য খাতে নিয়োজিত। পানীয় জলের ১৮ শতাংশ আসে আমাদের নদী থেকে। নৌপথ আমাদের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের জন্যও অপরিহার্য এবং আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে সাহায্য করছে।
বাংলাদেশটি হলো নদী বেষ্টিত। নদী ও জলাশয়ে রয়েছে অনেক সম্পদ। কথায় বলে, পরিবেশ বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচবো। আমাদের অসচেতনতার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জীবনধারণের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ক্রমে দেশের নদ, নদী ও খাল দখল হচ্ছে, পরিবেশ রায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ উদ্যোগে, নিজের স্বার্থে নদীকে বাঁচাবার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু আইন প্রয়োগে খুব বেশি সফলতা আসবে না। পরিবেশকে বিবেচনায় না রেখে একটি সুন্দর পৃথিবীর অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। পরিবেশ আর উন্নয়নের মধ্যকার সম্পর্ক পরস্পরবিরোধী নয়। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। পরিবেশকে রক্ষা করে দেশের উন্নয়ন না করলে তা টেকসই হবে না। এজন্য শুধু সরকার বা বিভিন্ন সংস্থাকে কাজ করলে চলবে না, সমাজের প্রত্যেক মানুষকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করত হবে। পরিবেশ বাঁচিয়েই অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সম্ভব করতে হবে।
মানুষের হৃদপিন্ড না থাকলে বাঁচবে না, তেমনি নদী না থাকলে দেশও বাঁচানো সম্ভব নয়; যেভাবে নদী মরছে, আর যেভাবে নদীগুলো কাঁদছে, তাতে একদিন ধ্বংশ হয়ে যাবে দেশ। দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নদীগুলো রক্ষা করতে হবে। একটি দেশকে বাঁচাতে হলে এবং টেকসই উন্নয়ন করতে হলে নদীগুলো সংরক্ষণ করার বিকল্প নেই। এ জন্য দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনাও জরুরী। বাংলাদেশে ভূমি আইন, বন আইন, পরিবেশ আইন, পানি আইন, আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ আইন, জীববৈচিত্র নিয়ে আইনসহ নানা আইন রয়েছে। কিন্তু এ আইনের কোন কার্যকর বা বাস্তবায়ন নেই। আইন বাস্তবায়ন, পরিবেশ সুরক্ষা, নদী রক্ষা, জলাভূমি রক্ষা যাই বলিনা কেন সব কিছুই আমাদের মানসিকতার উপর নির্ভর করে, এছাড়াও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর নির্ভর করে। প্রথম আমাদের রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক নেতাদের আন্তরিক হতে হবে এবং তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনগোষ্ঠিকে এসব কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের দেশ বাঁচাতে হলে নদীগুলো বাঁচাতে হবে, আমাদের বাঁচতে হলে নদী রক্ষা করতে হবে। আসুন আমরা নিজেদের বাঁচাতে দেশ রক্ষা করতে নদী সুরক্ষায় এগিয়ে আসি।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক
আরও পড়ুন.. চুনতি বন সংরক্ষণের দাবিতে ধরা’র মানববন্ধন