কৃষ্ণনগরে পরিবেশ মেলা

নদিয়া (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) থেকে দীপাঞ্জন দে

নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরে তৃতীয় পরিবেশ মেলা অনুষ্ঠিত হলো ২৩ মার্চ, ২০২৪ (শনিবার)। কৃষ্ণনগরে কাজী নজরুল ইসলাম প্রায় তিন বছর (১৯২৬—১৯২৮ খ্রি.) যে বাড়িটিতে সপরিবার বসবাস করতেন, সেখানেই এই পরিবেশ মেলার আয়োজন করা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম হেরিটেজ ভবন হলো এই গ্রেস কটেজ।

কৃষ্ণনগরে পরিবেশ মেলা ২০২৪ সালে তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করল। কৃষ্ণনগরে প্রথম পরিবেশ মেলা হয়েছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ (রবিবার)। দ্বিতীয় বর্ষে গ্রেস কটেজে পরিবেশ শিবির হয়েছিল ৩০ জুলাই ২০২৩ (রবিবার)। আর এই বছর পরিবেশ মেলা হলো ২৩ মার্চ।

২০২৪ সালের পরিবেশ মেলার আয়োজক সংস্থা ছিল গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ, নদিয়া পরিবেশ মঞ্চ এবং সুজন-বাসর। পরিবেশ মেলা সংগঠনে সহযোগিতা করেছিল বিজ্ঞান অন্বেষক পত্রিকা, নদিয়া সেঁজুতি প্রকৃতি বিদ্যাশ্রম এবং কৃষ্ণনগর গবেষণা পরিষৎ-এর মতো সংস্থা।

নজরুল স্মৃতিধন্য কৃষ্ণনগরের গ্রেস কটেজে ২৩ মার্চ ২০২৪ সারাদিনব্যাপী পরিবেশ মেলা চলে। সকাল ১০টা থেকে নাম নথিভুক্তকরণ শুরু হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবেশ ও বিজ্ঞানকর্মীরা এই পরিবেশ মেলায় অংশগ্রহণ করতে এসেছিলেন।

পরিবেশ মেলা ২০২৪-এর আহ্বায়ক ছিলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞান প্রচারক দীপককুমার দাঁ এবং পরিবেশকর্মী দীপাঞ্জন দে। সকাল ১১টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবেশ মেলা শুরু হয়। নজরুল স্মৃতিধন্য গ্রেস কটেজের প্রথা মেনে প্রথমে নজরুল আবক্ষ মূর্তিতে ও নজরুল প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করা হয়। গ্রেস কটেজ প্রাঙ্গণে স্থাপিত নজরুল আবেক্ষমূর্তিতে মাল্যদান করেন পরিবেশ মেলার প্রধান আলোচক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাবু জগজীবন রাম চেয়ার প্রফেসর (ভূতপূর্ব) ড. অনিলকুমার সরকার।

সভাকক্ষে বিরাজমান নজরুল প্রতিকৃতিতে মাল্যঅর্পণ করেন পরিবেশ মেলার প্রধান অতিথি বিজ্ঞানী ড. পরিতোষ ভট্টাচার্য, অবসরপ্রাপ্ত জৈব কৃষি-বিজ্ঞানী, ভারত মন্ত্রক, নিউ দিল্লি। অনুষ্ঠানের সূচনায় সঞ্চালক দীপাঞ্জন দে নজরুল স্মৃতিধন্য এই ঐতিহাসিক ভবন গ্রেস কটেজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং কৃষ্ণনগরে আয়োজিত পরিবেশ মেলা সম্পর্কে আগত সকলকে অবগত করেন।

এরপর মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয় সুজন-বাসরের সভাপতি দীপঙ্কর দাস, বিশিষ্ট কৃষ্ণনাগরিক দেবাশিষ মণ্ডল, এদিনের প্রধান আলোচক ড. অনিলকুমার সরকার এবং প্রধান অতিথি বিজ্ঞানী ড. পরিতোষ ভট্টাচার্যকে।

পরিবেশ মেলায় স্বাগত ভাষণ রাখেন গোবরডাঙা গবেষণা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট বিজ্ঞান সংগঠক দীপককুমার দাঁ। তাঁর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে এই পরিবেশ মেলা সংগঠনের উদ্দেশ্য প্রতিভাত হয়। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিবেশ মেলায় আগত পরিবেশ ও বিজ্ঞানকর্মীদের স্বাগত জানান এবং যাঁদের সহযোগিতায় এই আয়োজন সম্ভব হয়েছে তাঁদের সকলের প্রতি তিনি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

ছবি- দীপাঞ্জন দে

স্বাগত ভাষণের পর পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। পরিবেশ পত্রিকা ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষাবার্তা’-র নতুন সংখ্যাটি (পঞ্চম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ২০২৪) এদিন প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক অনিলকুমার সরকারের হাত দিয়ে পত্রিকার নতুন সংখ্যাটির আবরণ উন্মোচিত হয়। সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট জনেরা এবং সুজন-বাসরের সম্পাদক ইনাস উদ্দীন, ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষাবার্তা’-র সম্পাদক দীপাঞ্জন দে ও প্রকাশক দীপককুমার দাঁ। পত্রিকার আবরণ উন্মোচনের পর প্রকাশক দীপককুমার দাঁ ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষাবার্তা’-র নতুন সংখ্যাটি সম্পর্কে এবং পত্রিকাটির চরিত্র সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন। অধ্যাপক অনিলকুমার সরকার বাংলা ভাষায় এই ধরনের পরিবেশ পত্রিকার গুরুত্ব সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন এবং এর সাফল্য কামনা করেন।

গ্রেস কটেজে আয়োজিত পরিবেশ মেলায় এদিন বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বর্তমানকালের অন্যতম জনপ্রিয় বিজ্ঞান পত্রিকা ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’-এর নতুন সংখ্যাটিও (বর্ষ ২১ সংখ্যা ২, মার্চ-এপ্রিল ২০২৪) প্রকাশিত হয়। পত্রিকার নতুন সংখ্যাটির আবরণ উন্মোচন করেন বিজ্ঞানী পরিতোষ ভট্টাচার্য। এই সময় মঞ্চে বিশিষ্ট জনেরা এবং ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’-এর সম্পাদক প্রবীর বসু ও প্রকাশক জয়দেব দে উপস্থিত ছিলেন। পত্রিকার আবরণ উন্মোচনের পর সম্পাদক প্রবীর বসুর মুখ থেকে নতুন সংখ্যাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া হয় এবং ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’-এর পথচলা ও আগামী পরিকল্পনার কথাও কিছুটা জানা যায়। এই পত্রিকা দুটি প্রকাশের মধ্যে দিয়ে পরিবেশ মেলার প্রথম পর্ব সমাপ্ত হয়।

‘পরিবেশ মেলা ২০২৪’-এর বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘সমর বাগচী স্মারক বক্তৃতা’। পরিবেশ মেলার দ্বিতীয় পর্বে এই বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছিল। পরিবেশ মেলা কমিটি বাংলার অন্যতম বিজ্ঞান প্রচারক সমর বাগচীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই বছর থেকে এই বিশেষ স্মারক বক্তৃতার সূচনা করলো। প্রথম বছর ‘সমর বাগচী স্মারক বক্তৃতা’-র আলোচক হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. অনিলকুমার সরকারকে (বাবু জগজীবন রাম চেয়ার প্রফেসর, ভূতপূর্ব অধ্যাপক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)। সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট তিনি তাঁর পরিবেশ ভাবনা সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা করেন। সভাকক্ষে উপস্থিত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে পরিবেশকর্মী, বিজ্ঞানকর্মী, গুণীজন সকলে মন দিয়ে এই আলোচনা উপভোগ করেন।

নদিয়া পরিবেশ মঞ্চের পক্ষ থেকে সুব্রত বিশ্বাস এদিন অধ্যাপক অনিলকুমার সরকারকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মাননা জ্ঞাপন করেন। রোশনী হালসানা তাঁর হাতে পুষ্পস্তবক তুলে দেন। গ্রেস কটেজের পক্ষ থেকে লেখক ইনাস উদ্দীন আলোচক অনিলকুমার সরকারের হাতে ‘কাজী নজরুল : গ্রেস কটেজ ও সুজন-বাসর’ শীর্ষক পুস্তিকাটি তুলে দেন। গোবরডাঙা গবেষণা পরিষদের পক্ষ থেকে দীপককুমার দাঁ তাঁর হাতে আঞ্চলিক ইতিহাসের একটি গ্রন্থ তুলে দেন। নবদ্বীপ বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অখিল সরকার চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়ের পিয়ার রিভিউ রিসার্চ জার্নাল ‘এথেনা’-র বিগত সংখ্যাটি এদিন আলোচক অনিলকুমার সরকারের হাতে অনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন।

পরিবেশ মেলার তৃতীয় পর্ব ছিল স্কুল-কলেজগুলি থেকে আগত শিক্ষার্থীদের নিয়ে। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পরিবেশ মেলা কমিটি এবছর পরিবেশ বিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতা এবং আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। কৃষ্ণনগর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বিদ্যালয় ও কলেজগুলি থেকে প্রায় চল্লিশ জন শিক্ষার্থী এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল।

আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন বিজ্ঞানী ড. পরিতোষ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট কবি রামকৃষ্ণ দে এবং লেখক সুজিতকুমার বিশ্বাস। আর সহযোগিতায় ছিলেন রোশনী হালসানা। ছাত্র-ছাত্রীদের কুইজ প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন লেখক ইনাস উদ্দীন, বিজ্ঞান সংগঠক সুব্রত বিশ্বাস এবং পরিবেশ বন্ধু তরুণকুমার সাহা। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে প্রায় দেড় ঘন্টা পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিযোগিতা এবং তাদের পুরষ্কার প্রদান অনুষ্ঠান চলে। আবৃত্তি ও কুইজ প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারী ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে পুরষ্কার হিসেবে গোবরডাঙা গবেষণা পরিষদের গ্রন্থাদি ও পত্র-পত্রিকা তুলে দেওয়া হয়। এছাড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সকল ছাত্র-ছাত্রীকে ‘পরিবেশ মেলা ২০২৪’ শংসাপত্র প্রদান করা হয়। আর সান্তনা পুরস্কার হিসেবে সকল প্রতিযোগীর হাতে এদিন প্রকাশিত পরিবেশ পত্রিকা ‘জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা বার্তা’ ও বিজ্ঞান পত্রিকা ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’-এর নতুন সংখ্যাটি তুলে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের হাতে পুরষ্কারগুলি তুলে দেন লেখক সম্পদনারায়ণ ধর, সাগরময় অধিকারী, দীপককুমার দাঁ, দেবাশিষ মণ্ডল, কবি রতনকুমার নাথ, মমতা বিশ্বাস প্রমুখরা।

গ্রেস কটেজ প্রাঙ্গণে পরিবেশ মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন পরিবেশ ও বিজ্ঞান সংগঠনের প্রতিনিধিরা পরিবেশ বিষয়ক একাধিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। পরিবেশ ও বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, গ্রন্থাদির প্রদর্শনী এবং বিপণনের ব্যবস্থা ছিল। নদিয়া জেলার বাদকুল্লার ‘রাখী পত্রিকা’, উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচরাপাড়া বিজ্ঞান দরবারের ‘বিজ্ঞান অন্বেষক’ পত্রিকা, রানাঘাটের পরিবেশ সংগঠন ‘নেচার ফার্স্ট’ সংগঠনের বার্ষিক পত্রিকা ও তাদের পরিবেশবান্ধব সামগ্রী, ‘লাভ দাই নেচার : রিকানেক্টিং রুটস’-এর বিভিন্ন পরিবেশ সামগ্রী, ‘গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ’-এর পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থাদি, শান্তিপুর নিবাসী বিশিষ্ট জৈব কৃষি প্রচারক শৈলেন চণ্ডীর সংগঠনের তৈরি ত্বক বান্ধব আবীর, সাবান, বিশুদ্ধ ঘি ইত্যাদি বিষমুক্ত সামগ্রী পরিবেশ মেলায় ছিল।

মধ্যাহ্ন ভোজনের বিরতির পর ‘পরিবেশ আন্দোলনে ছাত্র-ছাত্রীদের অংশগ্রহণ’ বিষয়ে সাবলীল বক্তব্য রাখেন নির্মল পরিবেশ প্রচারক তুহিনকান্তি মুখার্জি। তাঁর বক্তব্যের পর পরিবেশ মেলার চতুর্থ পর্বে নদিয়া পরিবেশ মঞ্চের বার্ষিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে নদিয়া জেলাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠনের প্রতিনিধিদের মধ্যে মতবিনিময় হয়।

নদিয়া পরিবেশ মঞ্চের আহ্বায়ক সুব্রত বিশ্বাস এই সভা পরিচালনা করেন। জেলা ও রাজ্য পর্যায়ের তিরিশজন প্রতিনিধি এদিনের গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এই সভা থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কৃষ্ণনগর পরিবেশ মেলার আয়োজকেরা প্রতিবছর এই ধরনের পরিবেশ মেলা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে আগামী প্রজন্মকে প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার প্রতি দায়বদ্ধ হতে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ভাবনার প্রতি তাদের নিয়োজিত করাতে বদ্ধপরিকর। এই বছরের পরিবেশ মেলায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা এবং শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আগামীর জন্য ইতিবাচক বার্তা দেয়।

আরও পড়ুন..

অঞ্জনা বাঁচাও আন্দোলন

সংশ্লিষ্ট বিষয়