নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। সোমবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এ রায় প্রকাশিত হয়। এর আগে রায় প্রদানকারী বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায়ে স্বাক্ষর করেন। আদালত রায়ে বলেছেন, মানুষের জীবন-জীবিকা নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবজাতি টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। নাব্য সংকট ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সংকটে পড়তে বাধ্য।
‘নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সরকার আইন প্রণয়ন করে নদীকে বেদখলের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে। নদী রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে জাগরণ শুরু হয়েছে। এখন সবারই ভাবনা-পরিবেশের জন্য নদী রক্ষা করতে হবে।’ একইসঙ্গে আদালত তার রায়ে তুরাগ নদকে ‘লিগ্যাল পারসন’ ঘোষণা করে বলেন, ‘অবৈধ দখলদাররা প্রতিনিয়তই কমবেশি নদী দখল করছে। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে নদী। এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরাগ নদকে লিগ্যাল/জুরিসটিক পারসন (আইনগত ব্যক্তি) হিসেবে ঘোষণা করা হলো।’ হাইকোর্ট বলেন, ‘আমাদের দেশের সব নদীকে রক্ষা করার সময় এসেছে। যদি তা না করতে পারি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
তুরাগ নদসহ দেশের সব নদ-নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’, ‘আইনি ব্যক্তি’ ও ‘আইনি সত্তা’ হিসেবে ঘোষণা করে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই রায়ের ফলে দেশের সব নদ-নদী-খাল-বিল-জলাশয়ও পরস্পর সম্পৃক্ত বা একীভূত সত্তা হিসেবে একই সাংবিধানিক অধিকার ও মর্যাদা পেল। নদ-নদী বিষয়ক এই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতির মর্যাদা অর্জন করল। বাংলাদেশে তুরাগ নদের এই স্বীকৃতির আগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে কলম্বিয়ার ‘আত্রাতো’ নদী, ২০১৭ সালের মে মাসে নিউজিল্যান্ডের ‘হোয়াঙ্গানুই’ নদী এবং ভারতের উত্তরাখণ্ডের ‘গঙ্গা-যমুনা’ নদী এরকম ‘জীবন্ত সত্তা’ বা ‘আইনি সত্তা’র স্বীকৃতি লাভ করে। প্রবলভাবে শিল্পায়িত এই বিশ্বসভ্যতায় নদীবিষয়ক এই রায়গুলো প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রশ্নে মানবজাতির আগামীর পথচলার দিকনির্দেশনামূলক।
রায়ে আরও বলা হয়, ঢাকার চারপাশে বহমান চার নদী রক্ষায় এর আগে আদালত থেকে কোনও নির্দেশনা দেওয়া না হলে এত দিনে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর হয়তো বহুতল ভবন দেখা যেত। অথবা তুরাগ নদে অবৈধ দখলদারদের হাউজিং এস্টেট থাকত। তবে এত রায় ও নির্দেশনার পরও তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে বিবাদীরা কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। আদালতের নির্দেশনা সঠিকভাবে প্রতিপালন হলে তুরাগ নদ রক্ষায় হাইকোর্টে আরেকটি মামলা করতে হতো না। আদালত বলেন, ‘শুধু যে তুরাগ নদই আক্রান্ত তা নয়; গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪৫০টি নদ-নদীও অবৈধ দখলদারদের দ্বারা আক্রান্ত। এখন এসব নদী রক্ষায় আমরা (আদালত) কি হাজারখানেক মামলা করার ব্যাপারে উৎসাহ/অনুমতি দেব? নাকি অবৈধ দখলের হাত থেকে সব নদী রক্ষায় এই মামলা ধরে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেব? যে নির্দেশনার আলোকে নদী দখলমুক্ত করার মামলা আর আদালতের সামনে আসবে না।’ পাশাপাশি দেশের সব নদ-নদী-খাল-জলাশয় ও সমুদ্র সৈকতের সুরক্ষা এবং তার বহুমুখী উন্নয়নে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাধ্য থাকবে বলেও রায়ে উল্লেখ করেছেন আদালত।
প্রসঙ্গত, এর আগে দেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে নদ-নদী দখল সংক্রান্ত বিষয়ে এক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। পরে ওই রিটের ওপর জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত ৩ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণাকালে হাইকোর্ট এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সূত্র: দৈনিক যুগান্তর ও দেশ রুপান্তর।
কিশোরগঞ্জের প্রাণ প্রবাহ নরসুন্দাকে বাঁচাতে আসুন সবাই ঐকবদ্ধ হই
নদীকে রক্ষা করা বর্তমান সরকারের চ্যালেঞ্জ: নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী