বিশ্ব নদী দিবস : নদী সুরক্ষায় তৃণমূল পর্যায়ে পদক্ষেপ চাই

তৃণমূল

মো.ইউসুফ আলী >> আজ বিশ্ব নদী দিবস। নদীকে রক্ষা করতে বিশ্বের বহু দেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটি উদযাপনের ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এ বছর বাংলাদেশের জন্য প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘দূষণমুক্ত নদী, সুস্থ জীবন’।

দিবসটির সূচনা আশির দশকে কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রাজ্যে হলেও বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে ২০১০ সাল থেকে। বাংলাদেশে নদী দিবস পালন একটি ভিন্ন তাৎপর্য। যেখানে নদী আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার অংশ। সেখানে নদী দিবস পালন করে এর গুরুত্ব মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে! এই পরিস্থিতি একদিনে হয়নি। নদীর আশীর্বাদে আমাদের ভূ-প্রকৃতি, সভ্যতা, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ও উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবেশ-প্রতিবেশ গড়ে উঠলেও দুর্ভাগ্যবশত আমরা প্রতিনিয়তই নদীর প্রতি বিরূপ আচরণ করে আসছি।

যে কোনো বর্জ্য নদীতে ফেলার এক সর্বনাশা সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। এমনকি দাম না পাওয়া কোরবানির চামড়াও আমরা নদীতে ফেলেছি! প্রতিবাদস্বরূপ। ভুক্তভোগীদের এমন প্রতিবাদ সবাই গ্রহণও করেছেন। তবে মাটিতে পুঁতে ফেলে প্রতিবাদ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। কিন্তু নদী কিংবা খালে চামড়া ফেলে প্রতিবাদ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মেনে নেয়ার মতোও নয়। আমরা জানি, নদীর দূষণ সীমানা মানে না। উজানে কোনো নদীতে দূষণ ছড়ানো হলে তার প্রভাব পড়ে ভাটি অঞ্চলে। তাই প্রত্যেক নদী দূষণমুক্ত রাখতে আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে কঠোরভাবে। এজন্য নদী সুরক্ষায় তৃণমূল পর্যায়ে পদক্ষেপ চাই। তবে তা কোনো সংগঠন ভিত্তিক না। নদী সুরক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টিতে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারিভাবে এবং অববাহিকাভিত্তিক।

আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, নদীবাহিত পলি দ্বারাই বাংলাদেশ গড়ে উঠেছে। এই নদীর মাধ্যমে যে পানি আসে এটাই প্রকৃতিকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের উপকূল অত্যন্ত সমতল ও নিচু। উজান থেকে যদি প্রচুর পানি না আসত, তাহলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি অনেক ভেতরে প্রবেশ করত। এ লবণাক্ততাকে ঠেকিয়ে রাখছে নদীর প্রবাহ। জীববৈচিত্র রক্ষা করা, ফসল উৎপাদন- এ রকম অনেক কর্মকাণ্ড সরাসরি নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত। নদীর পানির সঙ্গে যে পলি আসে তা জমির উর্বরতা বাড়ায়। নদীর পাড়ে শিল্পকারখানা গড়ে তোলা হয়। এতে কারখানায় নদীর পানি ব্যবহার করা যায়। বিদ্যুৎ স্টেশন এখনও নদীর পাড়ে গড়ে তোলা হয়। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের গরম হয়ে যাওয়াকে রক্ষার জন্য নদীর পানি ব্যবহার করা হয়। তারপরও নদী নিয়ে আমরা কেন সচেতন নই? কেন নদী বাঁচাতে সরকারি-বেসরকারি নানা উদ্যোগ আমরা আমলে নিচ্ছি না তা বুঝে উঠতে পারছি না। কেবলমাত্র আমাদের কারণেই কিংবা আমাদের দ্বারাই রাজধানীর আশপাশের নদীগুলো দখলে-দূষণে মরে যাচ্ছে।

বিভিন্ন এলাকায় অনেক নদীর বুকে শীতকালে চাষাবাদ হচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলায় পানি মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার পানিতে প্রাণীদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সরকার নদী রক্ষায় বার বার নানা পদক্ষেপ বা ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও তা কোন কাজেই আসছে না। যেসব কারণে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। দূষিত তরল নদীতে ফেলা রোধ করতে হবে। এর জন্য ১৯৯৫ সালের আইন আছে। ১৯৯৭ সালের রেগুলেশন আছে। ২০০০ সালের আইন আছে। ২০১০ সালের আইনের সংশোধনী আছে এবং ২০১১ সালের রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। কিন্তু কই কেহইতো তা আমলে নিচ্ছে না। আমরা এসকল আইনের সঠিক বাস্তবায়ন চাই। প্রয়োজনে আবার নতুন আইন করে হলেও নদী রক্ষায় জোড়ালো পদক্ষেপ গ্রহণ এখন জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ-নদী বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪,১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলে উইকিপিডিয়ার মুক্ত বিশ্বকোষে এ তথ্যে উঠে এসেছে। অপরদিকে শিশু একাডেমি প্রকাশিত শিশু বিশ্বকোষে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা বলা হয়েছে ৭০০-এর অধিক। অশোক বিশ্বাস নদীকোষ শীর্ষক গ্রন্থেও সাত শতাধিক নদীর সংখ্যা উল্লেখ আছে। মোকারম হোসেন বাংলাদেশের নদী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা হাজারটি। মাহবুব সিদ্দিকী আমাদের নদ-নদী গ্রন্থে লিখেছেন নদ-নদীর সংখ্যা সহস্রাধিক। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় লিখেছেন ‘তেরশত নদী শুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে?’

নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম.ইনামুল হক বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক গ্রন্থে সহস্রাধিক নদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। আবার দেশে এমন অনেক নদী আছে, যেগুলোকে সরকারি নদীর তালিকায় আনা হয়নি। তবে জমির পুরোনো দলিলে নদীর উল্লেখ আছে। এ রকম শত-শত নদী চোখের সামনে দখল হচ্ছে। প্রায় সব জেলায় এসব দখলকারী শুধু নদ-নদী নয়, খাল-বিলের জায়গাও দখল করেছে। সেখানে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে স্থায়ী, অস্থায়ী নানা স্থাপনা। একেবারে ওয়ার্ড পর্যায় থেকে বড় শহর সব জায়গায় খাল-নদীতে পড়েছে দখলদারদের থাবা। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের নির্দেশে স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ দখলদারদের তালিকা তৈরি করেছে তবে এ তালিকা পরিপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নদী রক্ষা কমিশন বলছে, এ তালিকা আরো যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে কোনো দখলদারের নাম বাদ পড়েছে কি না। অবৈধ দখল উচ্ছেদে তারা এক বছরের ‘ক্রাশ প্রোগ্রাম’ নেওয়ার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন।

তবে নদী গবেষকরা মনে করেন, একাদশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। তখন নদীগুলো ছিল প্রশস্ত গভীর ও পানিতে টইটুম্বর। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা ‘পাউবো’ বাংলাদেশের নদীগুলোকে সংখ্যাবদ্ধ করেছে এবং প্রতিটি নদীর একটি পরিচিতি নম্বর দিয়েছে। এর ফলে তাদের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫টি। পাউবো কর্তৃক নির্ধারিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ১০২টি , উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী ১১৫টি, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী ৮৭টি, উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নদী ৬১টি, পূর্ব-পাহাড়ি অঞ্চলের নদী ১৬টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের নদী ২৪টি হিসেবে বিভাজন করে তালিকা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই নদীগুলোর মধ্যেও বর্তমানে অনেকগুলো নদী তার চরিত্র সম্পূর্ণ হারিয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।

প্রসঙ্গত একটি প্রশ্ন স্বভাবতই ওঠে, গত এক দশকের কার্যক্রমে এ দেশের কত শতাংশ মানুষ সচেতন হয়েছেন নদী সুরক্ষার ব্যাপারে? এক্ষেত্রে আশাবাদী হওয়ার মতো উত্তর হয়তো মিলবে না। এজন্য আমরা চাইব, নদী সুরক্ষায় বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থার যেসব যৌক্তিক সুপারিশ রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানো হচ্ছে, সেসব আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে সরকার।

তারপরও একটি কথা বলতেই হয় যে, নদী নিয়ে শেষ কথা নেই। কারণ নদী শুধু নদী নয়। নদী আমাদের মায়ের মত। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় নদীর ভুমিকা অপরসীম। কাজেই জীবন যদি বাঁচাতে হয়, পরিবেশ যদি রক্ষা করতে হয়, উর্বরতা যদি বাড়াতে হয়, উৎপাদনশীলতা যদি বজায় রাখতে হয়, প্রাকৃতিক ভারসাম্য যদি রক্ষা করতে হয়, তাহলে নদী সংরক্ষণের বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে শতভাগ সরকারি সদিচ্ছা থাকতে হবে। নদী উন্নয়নই সব উন্নয়নের, বিশেষ করে, টেকসই পরিবেশ উন্নয়নের চাবিকাঠি। নদী সংরক্ষণই উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

মো.ইউসুফ আলী :  লেখক, সাংবাদিক।


আরও পড়তে পারেন…..
হামিদ কায়সার এর গল্প- ডুব
বিশ্ব নদী দিবস ও আমার কিছু কথা 
নদী দিবসে ইকরিমিকরির আয়োজন- আলোকচিত্র প্রদর্শনী

সংশ্লিষ্ট বিষয়