বিশ্ব নদী দিবস ও আমার কিছু কথা 

Tapas Das
মুখে মাস্ক, হাতে ঘন ঘন জীবাণু নাশক তরল আর চেনা-পরিচিতর মৃত্যুর খবর। একেই অনেকে বলতে চাইছেন ‘নিউ নরমাল’। নদী বাঁচাও জীবন বাঁচাও আন্দোলনের সাথী-দাদা ত্রিলোকেশ কুণ্ডু বেশ মজার মজার উদাহরণ দিয়ে কঠিন কথা বোঝাতে পারেন। সেদিন বলছিলেন, ‘কোন ছুতোর মিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়ে হাত কেটে গেলে দেখবেন ক্ষততে গালার প্রলেপ দেবেন, পান বিক্রেতা চুন, গেরেজের মিস্ত্রী পোড়া মোবিল, আর গৃহস্থালি কাজে হাত কাটলে মা-বোনেরা এক মুঠো চিনি দিয়ে চেপে ধরেণ। সহজলভ্যতা আমাদের উপশম দেয়
অর্থাৎ যে যেমন পরিবেশে আছেন তার বাঁচার রসদ সেখান থেকেই আসে। আবার অপর দিকে বহুজাতিক সংস্থার আগ্রাসন নানা ভাবে বাড়িয়ে চলে যে কোন অবস্থাতেই। তাদের কাছে সাধারণ মানুষের বিপদ শোষনের হাতিয়ার। যেমন এই করোনা অতিমারীকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষকে ক্রীতদাস বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে। সব থেকে বিপদের হল প্রাচীন যুগে ক্রীতদাসেরা জানতেন তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ক্রীতদাস। সেই জানার মধ্যদিয়ে তারা মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানের ব্যবস্থাপনায় মানুষ বুঝতে পারে না স্বাধীন কৃষক, কারিগর থেকে থেকে  কন্ট্রাক্টচুয়াল জব, ঠিকা শ্রমিক থেকে চুক্তি চাষী হয়ে উঠছেন। এই নিউ নরমাল আমরা চাই না
তবে ‘নিউ নরমাল’ এই শব্দবন্ধ অনেক দিন ধরে ব্যবহার করছিলেন পরিবেশ কর্মীরা তাঁর বারবার বলছিলেন ‘জলবায়ু সংকট’ তার জন্য একই সঙ্গে অতি বৃষ্টি, ঝড়-সাইক্লোন, আবার খরা। সবুজ প্রাকৃতিক জঙ্গলের হ্রাস। মরু অঞ্চলের বৃদ্ধি। আর সেই সংক্রান্ত সমস্যা। কিন্তু সেই কথা রাষ্ট্র পরিচালকদের কানে পৌঁছায়নি।
বিশ্ব সংসারে এখনো পর্যন্ত আবিস্কৃত একমাত্র ‘জল গ্রহ’ পৃথিবী। জল তার প্রাণ প্রবাহ। একদা বিগ ব্যাং এ তৈরি অগ্নিপিণ্ডতে প্রাণ সঞ্চারিত হয়েছিল অনু-পরমাণুর মিশ্রণে তৈরি হয়েছিল ‘জল’। এহেন জলের সংকট বিচলিত করে ছিল রাষ্ট্র সংঘকে ২০০৫ সালে তাই ঘোষণা হল ‘জীবনের জন্য জল দশক’(water for life decade)। বিশিষ্ট পরিবেশবিদ মার্ক এঞ্জেলোর প্রস্তাব মত ঠিক হল সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার পালন হবে ‘বিশ্ব নদী দিবস’। নদী মিষ্টি জলের প্রধান বাহক। সেই নদীর কথা বলার দিন এসে গেল। আগামীকাল ২৭ তারিখ অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার।
সকলের প্রিয় পরিবেশ কর্মী দাদা, কল্লোল রায় বলেন কোনো দিবস পালন অর্থাৎ সেই বিষয় বা বস্তুর গুরুত্ব আমাদের জীবন থেকে শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তা তো হওয়ার নয় নদীমাতৃক ভারত-বাংলাদেশসহ কৃষিজীবী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নদীর গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়ার কোন কারণ সভ্যতার নেই। কিন্তু নদীকে কেমন ভাবে মনে রাখাবো এই সময় সেই কথা বলতে ‘নদী দিবস’র গুরুত্ব নদী কর্মীদের কাছে অপরিসীম।
নদীকর্মী তাপস দাসের আরও লেখা-
ভৌগলিক ভূখণ্ড থেকে শত শত দেশে বিভক্ত বিশ্ব আজ শুধুই ‘অর্থনৈতিক বিশ্ব’। আজ দেশের পরিচয় তার সীমারেখা , তার সমাজ, ভাষা, দর্শন নয়। তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তার পরিচয় হয়ে উঠেছে। বৃহত্তর অর্থনৈতিক তালিকায় তার স্থান কত নম্বরে। চীন, আমেরিকা বা ইংল্যান্ডর থেকে বেশী পরিচয় হয়ে উঠেছে কত ট্রিলিয়নের বাজেট। কত অর্থে বাৎসরিক ব্যবসা করেছে সেই দেশের বাজার। মানুষ আজ শুধু বাজারের প্রয়োজনে সংখ্যা।
ভারত-বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক টিকে আছে এখনো। প্রকৃতির সাথে বন্ধুত্বের বোঝাপড়া ও তার থেকে  উদ্ভুত সহস্র বছরের অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞান ব্যবহার করে বাসযোগ্য থেকেছে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল। অসংখ্য জীব-বৈচিত্র্য তাদের খাদ্য সুরক্ষা দিয়েছে, জীবিকায় স্থায়িত্ব এনেছে। কিন্তু এই রাষ্ট্র শাসকের অর্থনৈতিক শক্তি সঞ্চয়ের নেশা, দেশের মানুষের জীবনে নিয়ে এসেছে, ‘পরিযায়ী’ হয়ে ওঠার তাচ্ছিল্য। এক সময় মানুষ ছোট ছোট গোষ্ঠীতে যাযাবর হয়ে জীবন কাটাতো। তারাই একদিন নদীর পাড়ে স্থায়ী বসবাস গড়ে তুলেছিল। শিখেছিল নদী-জলাশয়ের সঙ্গে সখ্যতা বজায় রেখে তার পাড়ে গ্রাম-সমাজ গড়ে তুলতে। সেই জলের সাথে সমন্বয়-যোগাযোগ বিছিন্ন হতেই মানুষ হয়েছে পরনির্ভরশীল। গ্রাম-সমাজ তার আত্মনির্ভরশীলতা হারিয়েছে।
তাই এই সময় ‘বিশ্ব নদী দিবস’ এর গুরুত্ব অপরিসীম। করোনাকালে মানুষ তার প্রাণ প্রবাহের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এই বিপদকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। মানুষের সমাজ জীবনে জল-নদী-আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার জ্ঞানকে ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্ব নদী দিবস জিন্দাবাদ।।
২৬.০৯.২০২০, কলকাতা, ভারত

আরও পড়তে পারেন….
আগামীকাল বিশ্ব নদী দিবস
নদী দিবসে ইকরিমিকরির আয়োজন- আলোকচিত্র প্রদর্শনী
মহাদেব ও ইছামতীর গল্প ।। সুজয় চক্রবর্তী

 

সংশ্লিষ্ট বিষয়