বড়খালের আদ্যকথা ।। সৈয়দ কামরুল হাসান

বড়খাল

কিশোরগঞ্জ শহরতলির মনিপুর মহল্লার গা ঘেঁষে যে স্রােতধারা পাটগুদাম, সিদ্ধেশ্বরী কালিবাড়ীর পাশ দিয়ে যশোদল বাজার হয়ে আরো দূর প্রান্তরে আরেক স্রােতধারায় বিলীন হয়েছে তা এখানকার মানুষের কাছে ‘বড়খাল’ নামে পরিচিত

একদা, তা প্রায় চার-পাঁচশো বছর তো হবেই; শহর থেকে সামান্য দূরবর্তী মারিয়া গাঁ-সংলগ্ন জলাভূমি উথারিয়ার বিলে এই খালটির জন্ম হয়েছিলো। এককালের সেই বড় খালের দাপট ছিলো। এই স্রােতধারা বড় বড় মহাজনী নৌকা বুকে নিয়ে গৈ-গাঁয়ের ভেতর দিয়ে, কারুর বাড়ির সদর দহলিজের সামনে দিয়ে, কারুর বা খিড়কির ছায়াময় অন্ধকার প্রান্ত ছুঁয়ে, দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ চিরে এঁকেবেঁকে নিজের পথ করে নিয়ে নিকলীর সাগরে (সায়র-হাওড়) গিয়ে পতিত হয়েছে।

তবে একা যায়নি; পথে খুঁজে পেয়েছে আরো সাথী। প্রথম সাথী মিলেছিলো শৈশবেই, মনিপুর ঘাটের গোড়ায়। এখানে বড়খালের সাথে মোহনা তৈরি করেছিলো শহরের ভেতর থেকে আসা আরেকটি কাটা খাল। এটি আসলে একটি কৃত্রিম সংযোগ খাল যা কিশোরগঞ্জ শহরের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত নরসুন্দা (যার প্রকৃত নাম-কাওনা )-র সাথে বড়খালকে যুক্ত করে নৌচলাচল ও ব্যবসার ক্ষেত্রে বৃহত্তর সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছিলো।

হোসেনপুরের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র থেকে সৃষ্ট নরসুন্দা বা কাওনা কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে পুরান থানা সংলগ্ন বড়বাজারের কাছে বাঁক নিয়ে , রেলওয়ে ব্রীজের তলা দিয়ে করিমগঞ্জের চৌগাঙ্গা অভিমুখে পাড়ি জমায়। সেকালের বিখ্যাত ও দূরদর্শী মোগল নৌ সেনাপতি আশ-শায়েখ আবদুল করিম মীর-ই-বহর সপ্তদশ শতকের প্রথমদিকে (আনুমানিক ১৬২৫ সাল) নিজ উদ্যোগ ও অর্থায়নে খালটি খনন করে কাওনাকে বড় খালের সাথে যুক্ত করেন।

বলা বাহুল্য , এই খালের কাটা অংশটির দুই তীরে গড়ে-উঠা জনপদ আজও ‘কাটাখালি’ নামে পরিচিত। মনিপুর মোহনায় উথারিয়া খালের সাথে মিলিত দুই সাথী এক অভিন্ন স্রােতধারায় ‘বড়খাল’ নামে পরিচিতি নিয়ে যে আরো নাব্য ও বেগবান হয়ে উঠেছিলো তাতে আর সন্দেহ কী! বরষায় সেই খাল রীতিমত ছোটখাটো নদীর চেহারা পেতো, এমনকী শরত-হেমন্ত-শীত-বসন্তেও ব্যবহার উপযোগী পানি থাকতোই এখানটায়। বড়খালের সেই যৌথ ধারা [ইদানিংকালে এটাকে সবাই নরসুন্দা নামে ডাকে] তারাপাশা, নধার, ভূবিরচর, কালিকাবাড়ী, স্বল্প দামপাড়া, দামপাড়া, চিকনীর চর, গোপ জিনারাই প্রকাশ বড়খালেরপাড়, রৌয়ারপাড়, কানকাডি, চারুয়াকান্দি হয়ে বাম দিকে মোড় নিয়ে আবার ডানদিকে গিয়ে ডানপাশে কোদালাটিয়া এবং বামপাশে কানকাডিকে রেখে সিংগুয়া নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

এ মিলিত অংশটিকে স্থানীয় ভাষায় ‘তেম্নি’ (ত্রিমোহনা) নামে ডাকা হয়। এরপর ডানদিকে সারুয়াকান্দি হয়ে এই খাল ভুরভুরিয়া ও ধলা বিল ছুঁয়ে সিঙ্গুয়া নদী নামে নিকলির দিকে প্রবাহিত হয়ে হাওড়ে পতিত হয়েছে। সিংগুয়াও আদি ব্রহ্মপুত্র থেকে সৃষ্ট। এই স্বল্পদৈর্ঘ্য নদী পাকুন্দিয়ার মির্জাপুরের নিকট থেকে উৎপন্ন হয়ে কালিয়াচাপড়া পুলের ঘাট বাজারে একটা জমজমাট নৌ-বন্দর সৃষ্টি করে ভুরভুরিয়া বিলের ঝিকজোড়া পয়েন্টে বড়খালের সাথে আবার গাঁটছড়া বেঁধেছিলো।বড়খাল ও সিংগুয়ার তখন যৌবনকাল। এই আনন্দিত স্রােতস্বিনী অতপর ঝিকড়জোড়া, মহিষবেড়, পাইকপাড়া, ধূলদিয়া সহস্রামের বিস্তীর্ণ প্রান্তর পেরিয়ে নিকলীর হাওড়ে এসে সাগরে পতিত হয়। নদীর যা পরিণতি – খুঁজে নেয় সাগর;তার আপন উৎস।

এ খালের পাড়ের কোন কোন অংশকে মানুষ ‘বড়খালের পাড়’ ডেকে নামটির আদি নামের পরিচয় দিলেও তা, সেই বড়খাল কি আজ আর আছে? কোথায়ইবা জলটলমলো সেই সিংগুয়া নদী, নরসুন্দাই বা আজ আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে? এর উৎসস্থল তারাপাশার মনিপুরঘাট তো সেই মনিপুরি ব্যবসায়ীদের আগমনের স্মৃতিচিন্হ মাত্র তার নামটুকুতেই মাত্র ধরে রেখেছে। সেই ত্রিমোহনায় গড়ে ওঠা ব্যবসা কেন্দ্রে একদা যে ঝুলন মেলা বসতো যার আয়ুষ্কাল ছিলো সপ্তাহ-পক্ষকালব্যাপী, যেখানে দেশ বিদেশের বানিয়া সওদাগরগণ আসতো নানা জাতের নৌকা নিয়ে সে এখন কেবলি স্মৃুতি। নদীকেন্দ্রিক জীবনের সেই ছলছলানি আর নদীর তীরে গড়ে ওঠা নৌ-পথের সেই ব্যবসা বাণিজ্য কেন্দ্র আজ লুপ্ত হয়ে নিয়েছে ভিন্ন চেহারা, নদীর মাছ , নদীর পানিতে সজীব দুই তীরের রবিশস্য, ফসলের খেত, নদীকে কেন্দ্র করে বেঁচে-থাকা মৎস্যজীবী, নদীপাড়ে যুগ-যুগান্তের মানুষের কলরব- সব হারিয়ে গেছে। মুছে গেছে ওরা ইতিহাসের পাতা থেকে। এমনকি নিকট ইতিহাসেরও।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে কিশোরগঞ্জের তারাপাশা ব্রীজ, সিদ্ধেশ্বরীবাড়ী পাটগোদাম মোড়, টেক্সটাইল মিলস সংলগ্ন ব্রিজের গোড়ায় নদী তীরে দাঁড় করিয়ে পাক সেনারা যাদের হত্যা করতো সেই লাশগুলোর কত যে এই বড়খাল দিয়ে ভেসে গেছে- তার কোন শুমার নাই। বেশিরভাগ লাশ পঁচে গলে খালেই বিলীন হয়েছে। আমার সদ্য-সমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক (অপ্রকাশিত) গল্প ‘আরেক রনাঙ্গনে’ সৌখিন ইতিহাসবিদ তরিকুল বহুদিন পর তার নিজ গাঁয়ে ফেরে নিজ এলাকায় সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি নিয়ে একটা আঞ্চলিক ইতিহাস রচনার বাসনা নিয়ে। যুদ্ধের দিনগুলিতে সে কলেজের ছাত্র , বড়খালের তখন যৌবন। বহুদিন পরে এক সন্ধ্যায় ট্রেন থেকে নেমে তরিকুল বড়খালের পাশ-ঘেঁষে ঝকঝকে বাঁধানো রাস্তা ধরে যখন ফিরছে নিজ জন্মভিটায় গল্পে সে-বর্ণনার সামান্য নমুনা:

“আকাশের আলো আছে, এবার দুইপাশে খোলামেলা , অনেকখানি ছড়ানো খেত। কেবল ঘুমন্ত অথবা মৃত খালটি আর রিকশার গতির সাথে পাল্লা দেয়না – বুনো আগাছায় বুঁজে গেছে তার শীর্ণ ধারা। তরিকুল মনে করতে পারে যুদ্ধের দিনগুলির কথা -এই ঢালু পথে, এই খাল বেয়ে প্রতিদিন ২/৪/১০টা লাশ ভেসে আসতো সদরের নদী থেকে। ভোর হলে বাজারের গা ছুঁয়ে , মানুষ, শেয়াল ও শকুনের চোখ ফাঁকি দিয়ে লাশগুলি যেন পালাতে চাইতো আরো দূর ভাটিতে – বাওড়ের তীর-ছোঁয়া তরিকুলদের গ্রামে। ক’টা লাশ, কারা ,কাদের লাশ অইগুলি -কীভাবে ওরা মারা পড়েছিলো, ওরা কি পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলো, নাকি ধরা দিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মারা পড়েছিলো – একেকটা লাশের সাথে একেকটা গল্প,এক এক টুকরো ইতিহাস – এখন খালের ভাঁজে ভাঁজে নিষুপ্ত সেই গল্প! আর কোনোদিন কি জানা যাবে! মৃতের মোট সংখ্যা থেকে কিভাবে পৃথক হবে সেই আলাদা আলাদা এক একটি জীবন! এখন লজ্জায় কি ওরা মুখ লুকিয়ে আছে মৃত খালের গভীর অতলে! ভাবতে ভাবতে আনমনা তরিকুল তার রঘুখালী গ্রামে যুদ্ধের দিনগুলিতে ফিরে যায়।”
এমন কত খাল ও নদীর অতলে ঘুমিয়ে আছে কত জনপদ,পালিয়ে আছে কত লাশ,হারিয়ে গেছে কত ইতিহাস!

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: কিশোরগঞ্জের নদী-গবেষক ও ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলামের পরিচালনায় ও উপস্থাপনায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ২০১২ সালে প্রচারিত ‘নদী নিরবধি’ অনুষ্ঠানমালা এবং তাঁর লেখা ‘নরসুুন্দা নয় কাওনা: একটি গবেষণা প্রবন্ধ’’ মাসিক আল হাসান ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা নভেম্বর ১৯৯২ সংখ্যা ।]

আরও পড়তে পারেন…..
ঢাকার নদীর সীমানা নির্ধারণে বসানো ১৪২৩টি পিলারই ভুল জায়গায়- আরডিআরসি 
আজ রিভার বাংলা’র জন্মদিন
জীবন-নদী যাত্রা ।। তাপস দাস

সংশ্লিষ্ট বিষয়