নদী!
নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে মানব বসতি, সেই আদিকাল থেকে। আদিকালের রূপ রস গন্ধ পার হয়ে আমরা প্রবেশ করেছি চরম আধুনিক আর দখলের যুগে। আমরা, বাঙালিরা দুনিয়ায় একটি অবাক জাতি। আমাদের ভবিষৎ আমরাই ধ্বংস করি। চোখের সামনে আমাদের নদীগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে, দখল হয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে নদীগুলো- আছে মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক, মন্ত্রনালয়, আছে প্রশাসন- সবার চোখের সামনে নদী খেকোরা খেয়ে যাচ্ছে নদী মুড়ি মুড়কির মতো, রসে চুবানো আড়াই প্যাচের জিলাপির স্বাদে- কেউ দেখার নেই। নেই রক্ষা করার কেউ। মনে হচ্ছে নদী গনিমতের মাল, একাত্তরের রাজাকারদের মতো, যে যেভাবে পারছে দখলে নামছে। মানুষের জীবনের, সভ্যতার স্বাভাবিক প্রবাহকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। নগদ ভোগ ও দখলই মোক্ষ, ভবিষৎ জীবনের কোনো নোঙর বা ভাবনা নেই।
এ দেশের অনেক মানুষের মতো মীজানুর রহমানও নদী ভালোবাসেন। মীজানুর রহমান সেই ভালোবাসার দায় থেকে ১৯৯৯ -২০০০ বছরে প্রকাশ করেন, তাঁর নামীয় ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক’ পত্রিকার নদী সংখ্যা। বাংলাদেশে তো বটেই নদী নিয়ে এমন বিপুল সম্ভারের কাজ এই অঞ্চলে প্রথম। নদীর বিচিত্র বিষয় ও আকর নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হওয়ায় পাঠক সমাজে বিপুল আড়োলন তোলে। লেখক ও লেখার তালিকার দিকে চোখ রাখলে, বিচিত্র সম্ভারের ঠিকুজির সন্ধান পাওয়া যাবে।
শামসুর রহামানের ‘একজন নদীর উদ্দেশে’ কবিতা দিয়ে শুরু হয়েছে পত্রিকাটি। শামসুর রাহমান লিখেছেন :
একজন নদীর ভেতরকার নদী
আমার সুদূর ছেলেবেলা
প্রখর যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের ধূসরিম, ভেজা
মাটি ছুঁয়ে ছেনে
কাহিনীকাতর হয় খুব। আমি তার গল্প শুনি
কোনও কোনও ভোরবেলা, দুপুরে অথবা
গোধূলিবেলায় আর কখনও কখনও
সন্ধ্যারাত পেরিয়ে নিশীথ হয়ে যায়।…
আরো যারা লিখেছেন নদী ধারণ করে চেতনায়, সেই বিশাল লেখক তালিকা ও লেখার বিচিত্র অনুসঙ্গ পাঠ করলেই বোঝা যায়, সম্পাদক মীজানুর রহমান কতোটা সাধক ছিলেন, কাজের ব্যাপারে, নদীর প্রতি! কলিম খান : ঝর্নাধারা থেকে সৃষ্টিধারা, শহীদুল্লাহ মৃধা : বাংলাদেশের নদ নদীগুলির অতীত, বর্তমান ও ভবিষৎ, মনিরুজ্জামান নিশাত : নদী -ভাঙ্গনের ভূরূপতত্ত্ব, সৈয়দ মাজহারুল হক : নদী ও বন্য, রেজা খান : আমাদের নদী- আমাদের প্রাণী, আনিসুজ্জামান খান : নদ নদীর জীব বৈচিত্র, খসরু চৌধুরী : সুন্দরবনের নদী, সেলিনা হোসেন : আমার দেখা নদী, বিলু কবীর : নদী সংগ্রহ, সমীর রায় চৌধুরী : যে নদী কবির মানচিত্রে, রদীদ হায়দার : আমাদের ছোট বড় নদী, খালেদা এদিব চৌধুরী : বাংলাদেশের নদী ও সাহিত্য, রেজা খান : নদী ও আমি, আজহার ইসলাম : রবীন্দ্র সাহিত্যে নদী. প্রমথনাথ বিশী : শিলইদহ শাজাতপুর পতিসর- নদ নদীই যেখানে রাজপথ, নিজাম খান : আমাদের ছোট নদী, মুশফিকুর রহমান : নদীর মৃত্যুঘন্টা, যতীন্দ্রমোহন রায় : ঢাকার নদ নদী, নাজির হোসেন : বুড়িগঙ্গা, মুনতাসীর মামুন : নদী ও বাংলাদেশ, রবিউল হুসাইন : নদী ও জীবন, মোহাম্মাদ হানিফ পাঠান : বাংলা প্রবাদে নদী, স্বরোচিষ সরকার : প্ররাণে নদী, ফরিদুর রহমান : বাংলা চলচ্চিত্র- নদীর নামে নাম, নজরুল ইসলাম : নদী ও চিত্রকলা। নদী কেন্ত্র করে বাংলার কবিরা অনেক গান রচনা করেছেন। সেইসব গানের জন্য আলাদা কয়েকটা পৃষ্ঠায় ‘নদী- গানে গানে কতো সাজে, সাজিয়েছেন মীজানুর রহমান। কারা গান লিখেছেন? গীতিকারদের তালিকা : কাজী নজরুল ইসলাম, লালন শাহ, জসীমউদ্দীন, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, আবু জাফর, পরেশ ধর, ফজল এ খোদা। কাজী নজরুল ইসলামের দুটি গানের প্রথম অন্তরা : মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম নদীর চরে, যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে…। দ্বিতীয় গান : পদ্মার ঢেউ রে… ও মোর শূন্য হূদয়ে পদ্ম নিয়ে যা যা রে
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙা পা
আমি হারায়েছি তারে…
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সেই বিখ্যাত গান : ও নদীরে… একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে
বল কোথায় তোমার দেশ
তোমার নেই কি চলার শেষ…
মীজানুর রহমান সম্পূর্ণ সম্পাদক। তিনি নদী সংখ্যাটিকে পরিপূর্ণ করার জন্য নদী সংক্রান্ত বিচিত্র লেখা সংগ্রহ করেছেন। গানের পাশাপাশি কবিতা, গল্পও রেখেছেন। কবিতা লিখেছেন- রশিদ চৌধুরী, ওবায়দুল ইসলাম, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, রেজাউদ্দিন স্টালিন। গল্প লিখেছেন মনি হায়দার: কচা নদীর অট্টহাসি, খোবন কায়সার : সিকসিত পুরাণ, আকমুল হোসেন নিপু : পংকি নাইয়া। নদীকে নিয়ে ছোটদের জন্য সাজিয়েছেন মজার ছড়ায় কয়েকটি পৃষ্ঠা। এই পর্বের লেখকেরা : সুকুমার রায়, আহসান হাবীব, হাসান জান, লুৎফর রহমান রিটন।
আরো লিখেছেন- সুনীল সেন শর্মা : ও গঙ্গা তুমি বহিছো কেনো?, মাহববু আলম গোরা : মরা পদ্মার বুক : স্মৃতির ভেলায়, সৈয়দ মহিবুল আমীন : মনুপারের কথকতা। আগেই লিখেছি, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক মীজানুর রহমান প্রবলভাবে সচেতন মানুষ। যেহেতু বিষয়টি নদী, নদীর ইতিহাস আদ্যপান্ত তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টার অনুসঙ্গ হিসেবে তিনি নদী সংখ্যায় যুক্ত করেছেন, ‘গঙ্গা নদীর পানি বন্টর চুক্তি’। গঙ্গা নদীর পানি বন্টন চুক্তি আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গ। সেই চুক্তিটি পাঠকেদর সামনে হাজির করে সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করেছেন মীজানুর রহমান।
শহীদুল্লাহ মৃধা চাকরি করেছেন আনবিক শক্তি কমিশনে। কিন্তু মানুষটি ছিলেন নদী ও নদীর জলস্রোতে বহমান তৃষ্ণার্ত নাবিক। নদী ও সমুদ্র নিয়ে অনেক মৌলিক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন তিনি। এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি বইও ছিল শহীদুল্লাহ মৃধার। একটি প্রবন্ধবই ‘বাংলাদেশের নদ নদীগুলির অতীত, বর্তমান ও ভবিষৎ’। চমৎকার দক্ষতায় বাংলাদেশের নদ ও নদীর ইতিহাস তুলে ধরেছেন তিনি গোটা বই জুড়ে। যে কোনো মনষ্ক পাঠকদের জন্য প্রবন্ধটি জরুরী মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের নদীর ভবিষৎ সর্ম্পকে লিখতে গিয়ে শহীদুল্লাহ মৃধা লিখেছেন- ‘ভারতের উজানে নির্মিত তিস্তা- মহানন্দা ব্যারেজের কারণে উত্তরাঞ্চলের নদীসমূহ শুস্ক বালুচরে পরিনত হয়েছে। পঞ্চগড় জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত সকল নদীর উজানে ভারত একতরফাভাবে বাঁধ নির্মাণ করায় সকল নদী নাব্যতা হারাচ্ছে। জেলার সীমান্তবর্তী তেতুলিয়া থানার শেষ সীমান্ত বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের বিপরীতে ভারতের ফুলবাড়ি এলাকায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তিস্তা মহানন্দা এবং করতোয়া নদীর ওপর রাঁধ নির্মাণ করায় বিস্তীর্ণ এালাকা মরুভূমি হতে চলেছে। আর সে কারণেই করতোয়াসহ চাওয়াই, কুরুম, হাতুড়ি, নাগর, টাঙ্গন, চিলকা প্রভৃতি নদীতে বর্ষা মৌসুমেও কোনো পানি থাকে না। ভারত তাদের ব্যারেজে আটকানো পানি ফিডার ক্যানেলের সাহায্যে উত্তরবঙ্গের হলদিবাড়ী, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও বিহারে সেচকার্য চালাচ্ছে। ফলে, বাংলাদেশের নদীগুলো মুমূর্ষ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। নদীগুলোকে আর নদীই মনে হয় না। এগুলোর স্থানে গেলে মনে হবে পগার বা ডোবা। আর বেশির ভাগই শুকনো।’
শহীদুল্লাহ মৃধা এই ভাষ্য রচনা করেছেন আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে। এখন অবস্থাটা কতো কঠিন আর নির্মম আমাদের নদী ও নদী মাতৃক বাংলাদেশের জন্য, ভাবলে শিউরে উঠি। কিন্তু আমাদের করনীয় কর্তারা অবাক নীরব। বাংলাদেশ যে ক্রমশ মরুভূমির পথে যাত্রা করছে, কেউ দেখছে না। মীজানুর রহমান আমাদের সেই দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করেছিলেন,‘নদী সংখ্যা’ সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে। দেখিয়েছেন, বসে থাকার সময় নেই। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে, সবার আগে নদী বাঁচাতে হবে। নদীূ আমাদের ধমনীর রক্ত প্রবাহ। কিন্তু সবাই চুপ।
আমাদের অন্যতম কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার লিখেছেন নদীর স্মৃতিসম্ভার ‘আমাদের ছোট বড় নদী’ শিরোনামে নদীর জীবন ও যন্ত্রনায় মাখানো চমৎকার রচনা। লেখাটার শেষের দিকে তিনি নদী ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অসম্ভব শ্রদ্ধায় নিয়ে এসেছেন। শুরুতে পদ্মার শৈশবের স্মৃতি মেলে ধরেছেন। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে পদ্মায় সাঁতার কাটতে গিয়ে প্রবল পাকে প্রায় পরেছিলেন। কিন্তু বেঁছে গেছেন। তিনি পদ্মাকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে লিখেছেন- ‘আমরা অনায়াসে কল্পনা করতে পারি রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে বোটে গড়াই, পদ্মা ও ইছামতী হয়ে পৌঁছে যেতন শাহজাদপুরে, পতিসরে। আর মূল পদ্মা? সেতো রবীন্দ্রনাথের স্মতি ভান্ডারের অন্যতম উজ্জ্বল সম্পদ। পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণকারী, মহানগর কলকাতার বাসিন্দা পদ্মাকে চিনিয়েছেন পূর্ববঙ্গবাসীকে, তাঁর মতো চেনানো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষেও সম্ভব হয়নি। মানিকের চেনানো খণ্ডিত।’
সম্পাদক মীজানুর রহমান সাড়ে পাঁচশত পৃষ্ঠার নদী সংখ্যা করবেন, সেই সংখ্যায় নদীর কবি জীবনানন্দ দাশ থাকবেন না, তাও কি হয়? জীবনানন্দ নিয়ে ‘নদীর ঘ্রাণ মাখা কবি : জীবনানন্দ’ বিশেষ আয়োজন রেখেছেন। সম্পাদক লেখার শুরুতেই দাররুণ একটা তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন-‘ বাংলার হিন্দু মুসলমানদের মিলনের স্বপ্নদ্রষ্টা চিত্তরজ্ঞন দাশের তিরোধান উপলক্ষে তর্পণ করতে গিয়ে জীবনানন্দ লিখেছিলেন : বাংলার অঙ্গনেতে বাজায়েছ নটেশের রঙ্গমল্লী গাঁথা
অশান্ত সন্তান ওগো, – বিল্পবিনী পদ্মা ছিল তব নদী মাতা।
আর কোনো উপমা নয়, প্রমত্ত পদ্মাকেই বেছে নিয়েছিলেন জীবনানন্দ।’ জীবনানন্দ দাশের নদীমাখা দশটি কবিতা উপস্থাপন করে নতুন একটা মাত্রা সংযোজন করেছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতাগুলোর নাম : নদী, নদী নক্ষত্র মানুষ, আবার আসিব ফিরে, একদিন জলসিঁড়ি নদীটির তীরে, অনেক নদীর জল, নদীরা, আমাকে সে, কখনো মুহূর্ত, গল্পে আমি পড়িয়াছি। জীবননান্দ দাশকে বুঝতে হলে নদীর উপাখ্যানের এই কবিতাগুলোর পাঠ জরুরী।
বুড়িগঙ্গা আমাদের কাছে কিংবদন্তী। সেই শৈশব থেকে বুড়িগঙ্গা বুড়িগঙ্গা বুড়িগঙ্গা শুনে এসেছি। পাঠ্যপুস্তকে পাঠ করেছি- ঢাকা কোন নদীর তীরে অবস্থিত? বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। যতোদিন ঢাকায় আসতে পারিনি, কেবল নাম শুনে বুড়িগঙ্গাকে ধারণ করেছি, সেই বুড়িগঙ্গা আমার চোখে, মনের কল্পনায় অনেক বিশাল একটা বিস্তার নিয়ে ছিল। কারণ, এই বুড়িগঙ্গার তীরে আমাদের রাজধানী। আমার বাড়ি বরিশালের পিরোজপুরের ভানডারিয়া উপজেলার বোথলা গ্রামে। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল কচা নদী। এই পার থেকে ওই পারে ধূ ধূ দেখা যায়। আর ভাঙ্গনের ঘটনা কি বলবো? মনে হয় কচানদীর ভয়াবহ ভাঙ্গন এখনও চলছে। আমাদের বাড়িও কাছে এসে গেছে কচানদীর। তো সেই চোখ দিয়ে এক সকালে লঞ্চে সদরঘাটে এসে যখন চোখ খুলে যখন বুড়িগঙ্গা দেখলাম, খুব হতাশ হয়েছিলাম।এতো খাল! যাই হোক, বুড়িগঙ্গাতো! অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী। কিন্তু বুড়িগঙ্গার এখন ত্রাহি মদুসূধন অবস্থা।
নাজির হোসেনের ‘বুড়িগঙ্গা’ লেখাটায় বুড়িগঙ্গা নদীর আদ্যেপান্ত উঠে এসেছে। তিনি বুড়িগঙ্গা নদীর ইতিহাসের পাশাপাশি নদীর বর্তমান পরিস্থিতিও উপস্থাপন করেছেন। যদিও লেখটা নাজির হোসেনের‘ কিংবদন্তীর ঢাকা’ গ্রন্থ থেকে নিয়েছেন সম্পাদক, কিন্তু লেখাটি এখনও প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। সেই প্রাসঙ্গিকতা থেকে লেখাটার কিছু অংশ পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করছি। তিনি ‘পরিবেশ বাঁচাও জীবন বাঁচাও’ পর্বে লিখেছেন-‘ বুড়িগঙ্গার পানি আজ ঘোলা, বিষাক্ত ও আবর্জনাময়। উপর থেকে দাঁড়িয়ে দেখলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে সূর্যালোকের মতো। পুরোনো ঢাকাবাসীর জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিসহ। নদী তীরবর্তী এলাকার পরিবেশ হয়ে উঠেছে অস্বাস্থ্যকর। প্রায় দেড়শো বছর আগে থেকেই বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বাঁধা গ্রস্থ হয়েছে। ১৮৮৬ সালের একটি পত্রিকার রিপোর্টে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়েছে। পত্রিকাটি আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছিল, বুড়িগঙ্গার গভীরতা ও প্রবাহ প্রবর্তনের উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।… তারপর কেটে গেছে অনেক দিন। ঢাকার জনসংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুন। বুড়িগঙ্গার প্রবাহে ভাটা পড়েছে। অথচ পয়ঃ, বর্জ্য নির্গমনের পরিমান বেড়েছে। সুতরাং পানির স্তর কতোটা নীচে অবস্থান করেছে, বলার অপেক্ষা রাখে না।’
একজন নাজির হোসেন বুড়িগঙ্গা নিয়ে অনেক আগে থেকে ভেবেছেন। ভাবনা থেকে লিখেছেন। কিন্তু কোথাও কি কেনো কাজ হচ্ছে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করবার বিষয়ে? আদৌ নয়। বছর কয়েক আগে একজন মাননীয় মন্ত্রী খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়ে এসেছিলেন। বুড়িগঙ্গার তলদেশে যে ময়লা, পলিথিন জমেছে সেইসব পরিষ্কার করা হবে। বিশাল ক্রেন নিয়ে বিশাল আয়োজন করে কাজের উদ্ধোধন করেছিলেন মাননীয় মন্ত্রী। ভাবলাম বুড়িগঙ্গা বেঁচে গেছে। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু। পরের দিন থেকে কাজ বন্ধ। বুড়িগঙ্গার তলদেশের ময়লা আর পলিথিন ওঠেনি কূলে। প্রকল্পের টাকার কী হয়েছে, জানি না। জানাও সম্ভব নয়। যেহেতু ক্ষমতাই সকল ক্ষমতার উৎস। বুড়িগঙ্গা বয়ে চলেছে যাবতীয় দখল আর বিষাক্ত দ্রবনের লবন নিয়ে।
কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইন ‘নদী ও জীবন’ প্রবন্ধে লিখেছেন- ‘নদীর ব্যবহার আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের দেশ এবং আমরা অতি ভাগ্যবান যে এখানে এতগুলি পৃথিবীখ্যাত নদ নদী বিরাজ করছে। এই নদীর জন্যই এই দেশ সুজলা সুফলা। ধান পাট রবিশষ্য এ কারণে এই পলিমাটি বাহিত জনপদে সহজেই ফলে। কিন্তু সেই উপকারী নদীকেও আমরা দূষিত করে তুলি।’ কবি রবিউল হুসাইন সঠিক কথাই লিখেছেন। আমরা, বাঙালিরা আত্মঘাতি মনোভাবের মানুষ। আমরা আমাদের বিনাশ করতে দারুন উৎসাহি। নইলে, আমাদের ‘বন ও পরিবেশ’ মন্ত্রনালয় আছে কিন্তু কাজের নামে অষ্টরম্বা। এবং আমরা দেখছি, কেবল দেখছি, কে কতোটা আমাদের কতোভাবে নষ্ট করতে পারে, ধ্বংশ করতে পারে।
মীজানুর রহমানের অনন্য সম্পাদনার বৈশিষ্ট হচ্ছে, বিশেষ সংখ্যার বা সাধারণ সংখ্যার যে কোনো লেখা তিনি খুঁটিয়ে খুটিঁয়ে পড়েন। পড়ার পর তিনি ফুটনোটে সেই লেখার প্রসঙ্গে অন্য অনেক তথ্যও সংযুক্ত করে দিয়ে লেখাটাকে আরো সর্বাঙ্গিন করে তোলেন। ফলে, লেখাটি পরিপূর্ণতা অর্জণ করতো বা সম্পূর্ণ হয়ে উঠতো। ঠিক সেইভাবে নদী সংখ্যায় তিনি অসংখ্য নদী কণিকা শিরোনামে প্রচুর লেখা বা তথ্য সংকলন করেছেন। এই সংকলনের কারণে নদী ও নদীর বিচিত্র তথ্য উঠে এসেছে। পাঠকের চাহিদা তিনি যেমন বুঝতে পারতেন, সেইভাবে পাঠ রুচি তৈরীতেও তিনি রেখেছেন অসাধারণ ভূমিকা। গোটা নদী সংখ্যায় এগারোটি নদী কণিকা যুক্ত করেছেন। একটি ‘নদী কণিকা ’ একাশি পাতায়- ‘তিতাস একটি নদীর নাম। এ নদী বর্তমানে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলাকে বুকে আগলে ধরে বসে আছে। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার গোকর্ণঘাট গ্রামের অদ্বৈতমল্ল বর্মন [১৯১৪- ১৯৫১] তিতাস নদীর তীরের মানুষের জীবন নিয়ে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শীর্ষক কালজয়ী উপন্যাস রচনা করেন। অনেক ঐতিহাসিকের মতে তিতাস ছিল প্রাচীনকালে সাবেক কুমিল্লা জেলার একটি বিশিষ্ট নদী। কি ভূমি গঠনে, কি মানুষের জীবনযাত্রায়- তিতাস নদীর প্রভাবের কথা অস্বিকার করা যায় না।ঐতিহ্য,সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্র নির্মাণে ও তিতাসের ভূমিকা ছিল অনন্য।’
এইভাবে মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকার ‘নদী সংখ্যা’ ক্রমশ নদী ও নদী তীরবর্তী জীবনের বিভিন্ন আখ্যান, গল্প আর রূপকথায় পরিপূর্ণতা অর্জণ করেছে। সম্পাদক মীজানুর রহমান সম্পাদকীয় লিখতেন না, তিনি লিখতেন কড়চা। সম্পাদকের কড়চা। নিজের একটা রচনা শৈলী ছিল, আর ছিল গ্রামীণ অপ্রচলিত কিছু শব্দের অবাক ব্যবহার। মীজানুর রহমানকে কবি শামসুর রাহমান সম্পাদকদের সম্পাদক আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি যর্থাথই সন্মান দিয়েছিলেন।
নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সম্পাদক মীজানুর রহমান সম্পাদকের তুলনাহীন কড়চায় লিখেছেন- ‘বদর বদর বলে মাঝি নৌকা ছাড়ে। আকাশ ভাল, মেঘের দল পশ্চিমে একঠায় বিরাম নিচ্ছে। দেখতে দেখতে পুকুর পার হয়ে ধান খেতের সোহাগী আলপথে নৌকা এগোয়। রাঙামিলিয়া–কুচিয়ামোড়ার খাল বেয়ে ইছামতীর বুকে পড়তে ঘোরা হয় বলেই খেতের প্রান্তর ভাঙা। সিদ্ধিবাবার থান পেরিয়ে অবশেষে সকালের প্রথম নরম রোদ সারা গায়ে মেখে নৌকা ইছামতীর বুকে পড়ে। এবার পাল খাটাবে মাঝি। উজানিস্রোতে শুধু বৈঠায় সন্ধ্যা বসার আগেই মামার বাড়ি পৌঁছানো যাবে না। ভালুকা বাঁশের শক্ত মাস্তল লাগানই ছিল। বাদাম লাগাতেই পত পত শব্দে বেগে ধায়। বর্ষার জলে একূল ও কূল ছাপিয়ে একরত্তি নদীটির এখন গা ভরা।’।
‘দেখতে দেখতে পুকুর পার হয়ে ধান খেতের সোহাগী আলপথে নৌকা এগোয়’ এই বাক্যের মধ্যে একটা শব্দ ‘সোহাগী’। এই শব্দটি এখন আর বাংলা ভাষায় তেমন ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু সম্পাদক মীজানুর রহমান ‘সোহাগী’ শব্দটাকে এমন যুৎসই ব্যবহার করেছেন, গোটা চিত্রকল্পটাই মনের আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে ওঠে। আবার আর একটি লাইন- বর্ষার জলে একূল ও কূল ছাপিয়ে একরত্তি নদীটির এখন গা ভরা।’ লাইনের শেষ কয়েকটি শব্দে অনন্য একটি চিত্রকল্প তৈরী করেছেন- ‘একরত্তি নদীটির এখন গা ভরা’।
‘স্বচ্ছবিহারী কালিদাসের কবিকল্পনার কথা ভাবলে বিস্ময় না মেনে উপায় নেই, এ যেন রামগিরি পর্বত থেকে অলকা পর্যন্ত ভারতের এক বিশাল ভূভাগের এক বিরাট প্রতিকৃতি। অনুবাদক সুধাংশুরঞ্জন ঘোষের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, কবি কল্পনা পাঠককে ইচ্ছামতো কখনো বলাকাশ্রেণীশোভিত নীল আকাশে, কখনো স্বর্গে, কখনো সমুদ্রশয়নসুপ্ত বিষ্ণুর পদপ্রান্তে, কখনো পাতালে, আবার পরক্ষণেই হিমালয়ের তুষালশুভ্র ঊতুঙ্গ শিখরে নিয়ে গেছে। আর পাঠক হতচৈতন্যের মত ভূতাবিষ্টের মত সেই কল্পনার অনুবর্তন করেছে। কিন্তু কেবলই কি নীল আকাশে, স্বর্গে, পাতালে, উতুঙ্গ পর্বত শিখরে নিয়ে গেছে? না তো, কালিদাস আমাদের নিয়ে গেছেন ভারতবের্ষর কলস্বনাস্রোতস্বিনীদের কাছেও- সারা পূর্বমেঘ জুড়েই রয়েছে কত নদী- বিন্ধ্যাপর্বতের পাদদেশ ধন্য গ্রীস্মের স্বপ্লতোয়া বেরা, গন্ধবতী, সিন্ধু, বিশ্খাা, নির্মল সলিলা গম্ভীরা, বেগবতী চম্বল, সরস্বতী, ভাগীরথী, গঙ্গা আর অলকার প্রান্তবাহিনী মন্দাকিনী।
এই যে এতোগুলো নদীর নাম করলুম, শুধু নামোল্লেখ নয়, এদের চারিত্র সর্ম্পকে যেসব বর্ণনা পাঠক পাবেন, তাতে করে শুধু কালিদাসের সৌন্দর্যজ্ঞান নয়, একজন নদী বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তাঁর পরিচয় পাবেন এবং তিনি যে সাধারণ ভ্রমনপিপাসু ছিলেন না, তা বোঝা যায় প্রতিটি এলাকার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পড়ে এবং এদিকে দিয়ে বিবেচনা কালিদামকে একজন ভূগোলবিদ বলতেও আমাদের দ্বিধা নেই, দ্বিধা নেই উদ্ভিদ ও পুস্পবিদ এবং আবহাওয়াবেত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে।
আসুন এবার আমরা সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ অনূদিত মেঘদূতদ কাব্যের সেইসব অংশে প্রবেশ করি, যেখানে কালিদাস নদীর জলে অবাধে অবগান করেছেন।- সম্পাদক।’
মীজানুর রহমান কেনো, কবি শামসুর রাহমানের ভাষ্যে, সম্পাদকদের সম্পাদক- আশা করি বুঝে যাবেন। একটা লেখা ছাপার আগে কতোভাবে তিনি লেখাটাকে অনুধাবন করেছেন, পড়েছেন এবং নিজের মনের আগুনে জ্বলসে- টিকা ভাষ্য রচনা করে লেখাটা প্রকাশ করেছেন।
ছোট্ পরিসরে মীজানুর রহমানের নদী সংখ্যার বিশ্লেষণ প্রায় অসম্ভব। নদী নিজেই একটি সর্বগ্রাসী চরিত্র। সেই নদী কেন্দ্র করে এতো লেখা, এতো তথ্যের আােয়াজন কি এই ছোট লেখায় আটানো সম্ভব? অনেক বছর পর ‘নদী সংখ্যা’ নিয়ে এমন লেখার মধ্যে দিয়ে জানান দিতে চাই, আমাদের একজন মীজানুর রহমান ছিলেন, যিনি ছিলেন স্বপ্ন বোনার মানুষ ছিলেন। তিনি মাছ সংখ্যা, মুক্তিযুদ্ধ সংখ্যা, নারী সংখ্যা , ফুল সংখ্যা করতে চেয়েছিলেন। বাঁচতে চেয়েছিলেন একশো দশ বছর। কিন্তু…। না, এমন নির্লোভ অহংকারহীন সাধারণের মধ্যে অসাধারণ মানুষটি কাজের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকবেন…। আর নদী সংখ্যা নদীর পক্ষে, প্রকৃতি আর বাংলার মানুষের পক্ষে চিরকালের আকর হয়ে থাকবে।
মনি হায়দার : কথাশিল্পী।