মড়া নদীর নাম দিয়ে কাম কী- শেখ রোকন

নোট: সাংবাদিক, নদী গবেষক ও লেখক শেখ রোকন এর এই লেখাটি দৈনিক সমকাল থেকে নেয়া হয়েছে।

এই এপ্রিলের গোড়ায় গিয়েছিলাম গাইবান্ধা। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নদীকর্মীদের কর্মশালায় অংশ নিতে। আগের বিকেলে সৈয়দপুর থেকে গাইবান্ধা যাওয়ার পথে চিকলী, যমুনেশ্বরী, ঘাঘট পেরোতে পেরোতেই ঠিক করেছিলাম পরদিন সকালের গন্তব্য। আলাই নদী দেখতে যাব।

আগে একবারই আলাই দেখেছিলাম। ছোট্ট শান্ত এক নদী বয়ে চলছে। প্রথম ও শেষবার সেই দেখার পর দেড় দশক কেটে গেছে। কেমন আছে আলাই? সাতসকালে, কর্মশালা শুরু হওয়ার আগে, উন্নয়নকর্মী মুনির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে আলাইয়ের দিকে বেরিয়ে পড়েছিলাম।

মনে পড়ল প্রথম ও শেষবার আলাই দেখার সময় গাইবান্ধা শহর থেকে বালাসী ঘাটের দিকে যাচ্ছিলাম। পুরাতন বাজার মোড় থেকে একটি ‘মেশিন রিকশা’ ডাক দেই। গন্তব্য জানতে না চেয়েই বলে ‘ওটেন’। ডিবি রোড ধরে আমরা এগিয়ে যেতে যেতে বলি, ‘নদী দেখতে যাব।’ বছর চল্লিশের, কিন্তু শ্রমঘন জীবনের ভারে আরও বেশি দেখানো রিকশাওয়ালা চটপটে বলেন- ‘বুঝছম, পুলবন্দি যাইমেন।’ মনে পড়ল, জায়গাটার নাম ‘পুলবন্দি’ বটে। দেড় দশক আগে, যখন কৌতূহল আরও গাঢ় ছিল- তখন একজন বলেছিলেন, কোনো এক কালে এখানে কাঠের সাঁকো ছিল বলে এমন নাম। ‘পুল দিয়ে বন্দি নদী’ কথাটার মধ্যে এক ধরনের দার্শনিকতা রয়েছে। উত্তরবঙ্গীয় বৈশাখের মিষ্টি সকালে রিকশার মৃদু ঝাঁকুনি সহযোগে যেতে যেতে ভাবি।

বহু বছর আগে থেকেই কাঠের সাঁকোর স্থানে কংক্রিটের সেতু। জানতাম যে, আলাই নদীকে অবশ্য সত্যিকার অর্থে বন্দি করেছে নব্বইয়ের দশকে নির্মিত একটি স্লুইসগেট। এও জানতাম, এর অবস্থান ঘাঘট ও আলাই নদীর মিলনস্থলের কয়েকশ’ গজের মধ্যে। কিন্তু জানা ছিল না, কোনদিকে, কোন রাস্তায়।

‘পুলবন্দি’ সেতুর পাশেই কংক্রিটের ফলকে নদীর নাম লিখে রেখে দায় সেরেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কষ্ট করে হলেও নামটি পড়া যায় এখনও। রিকশাওয়ালা বলেন, এই যে ‘মড়া নদী আলছেন’।

তাকিয়ে দেখি, সত্যিই নদীটি মৃতপ্রায়। নদীর বুকেই ধান চাষ হয়েছে। সেতুঘেঁষে একটি বাড়ির ভিটা তৈরি চলছে, নদীর মাটি দিয়েই। সেতুর বুকেই একটি বাড়ি, ইউক্যালিপটাস ঘেরা। সেখানে মাথা উঁচু করে থাকা সোলার প্যানেলও সেতুর পাটাতনের সমান হতে পারেনি। এই খাত যে একসময় নদী ছিল, লম্বা ডোবার মতো কয়েক জায়গায় পানি জমে থেকে সেই মহিমা কীর্তন করছে।

আরেকটি বিষয় চোখে পড়ল, নদীর পাড় ভালোভাবে বাঁধানো। তৈরি হয়েছে কংক্রিটের কেদারা। সামনে ওয়াকওয়ে। রয়েছে সুদৃশ্য ল্যাম্পপোস্টের মাথায় লাল-নীল বাতির টোপর। কিন্তু নদীর অবস্থা দেখলে সবই শ্রীহীন মনে হয়। আমরা বলি, এদিকে একটা স্লুইসগেট আছে না? রিকশাওয়ালা বলেন, ‘ও তোমরা সুইচ গেট যাইমেন!’ রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে পুলবন্দি এলাকা থেকে আরও উজানের দিকে যেতে থাকেন।

পুলবন্দি এলাকার স্লুইসগেট এলাকাতেও নদীর পাড় ধরে লাল-নীল বাতি, বসার জন্য কংক্রিটের আসন, ওয়াকওয়ে। সেখানেও নদী মানে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ডোবা। আলাই নদী যেখানে ঘাঘট নদীর সঙ্গে মিশেছে, সেখানে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত। ক্ষেতের পরে ইউক্যালিপটাসঘেরা বাড়িও চোখে পড়ে। প্রবাহ চলে গেছে অন্যদিকে। রিকশাওয়ালার কাছে ঘাঘট দেখিয়ে জানতে চাই, ওইটা কোন নদী। তিনি দ্বিধাহীন বলেন, ‘মড়া নদী’।

ফেরার সময়ে শহরের মধ্যে ধনুকের মতো বাঁকানো ঘাঘটের পুরনো প্রবাহ পথে পড়ে। এটাই ছিল মূল প্রবাহ। নব্বইয়ের দশকে শহরের বাইরে নদীটিকে কেটে ‘সোজা’ করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে এই অশ্বক্ষুরাকৃতি প্রবাহ। একই ‘কাজ’ হয়েছে আলাই নিয়েও। আঁকাবাঁকা নদী কেটে সোজা করা হয়েছে শহরের কাছে। দুই ক্ষেত্রেই অভিমানী প্রবাহ নিজের পথ বেছে নিয়েছে অন্যদিকে।

ঘাঘটের পুরাতন প্রবাহের কাছে গিয়ে বলি, এটাও তো ঘাঘট। রিকশাওয়ালা বলেন- ‘হ, মড়া নদী।’

শ্রী ও স্রোতহীন নদী থেকে এমনিতেই বিরক্ত ছিলাম। একটু উষ্ফ্মার সঙ্গে বলি- ‘সব নদীকেই মড়া বলছেন কেন! নদীর নাম নাই?’

রিকশাওয়ালা বিনীত হাসি দিয়ে বলেন- ‘মড়া নদীর নাম দিয়ে কাম কী?’

কথাটা বুকের মধ্য দিয়ে ধক করে লাগে। রিকশাওয়ালার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে এর তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করি। ভরসা পেয়ে তিনি বলে চলেন- ‘নদী মরি গেলে, ডোবানালার সমান। এই যে মোর নাম মমিন। আজ বাদে কাল মরি গেলে, মোক আর মমিন কয়া কাঁয় ডাকবে?’

আমি তাকিয়েই থাকি। গাইবান্ধা শহরের আলাই নদী তীরবর্তী মিস্ত্রী পাড়ার দার্শনিক আব্দুল মমিনের দিকে। তার পেছনে ঘাঘটের পুরানো প্রবাহের কালচে পানিতে প্রতিফলিত হতে থাকে সকালের সূর্য।

লেখক: নদী গবেষক। সূত্র: সমকাল।

সংশ্লিষ্ট বিষয়