নদীটা চুপসে গেছে। রতন হালদার মন খারাপ করে বাউলার ভেক ধরেছে। জাল বুনতে বুনতে সে গুনগুন করে। হাঁসগুলো দল বেঁধে যেতে যেতে হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে। দু’এক জোড়া উল্টো দিকে মাঝনদিতে ছুটে যায়।নীল রঙের মাছরাঙা উড়ে এসে ছোঁ মেরেই পালায়।পানকৌড়ি ডূব মেরে সাঁতরে ছুটে পালায়।নিরিবিলিতে হংসমিথুন দেখতে দেখতে বাউলা রতন গান ধরে,
প্রেমপূজারী বাউলা একা একা দেহতত্বের পাঠ নেয়।জল চিকচিক করে। নৌকায় বাঁধা বাঁশের মাথায় সাদা সাদা মাছরাঙা চড়ুই পাখির মতো প্রেম করে উড়ে যায়। বাঁশির সুরে নদী গান গায়।বটের বাঁকে নদী ঘুরপাক খেয়ে অন্য পথ ধরে।
নদীতে ভেসেই দেখেছি বাঁকে বাঁকে নদী দহ ফেলে যায়।পলিমাটি উপচে পড়ে। সাদা বালির চরে ঘাসফুলেরা লাল, নীল, হলুদ, সবুজ প্রদীপ জ্বালে। রাত নামলেই জোনাকিরা বেড়িয়ে যায়। আকাশেওর তারারাও নদিকে দেখে। আমাদের গাঁয়ে ঘরে বিকেল হলেই মাঠের ধুলো উড়িয়ে গরুর দল ফিরে আসে, গাঁয়ের বধূ ঘাট ছেড়ে কলসি ভর্তি জল নিয়ে ওঠে, সূর্য পাটে নামে, ঝিঁঝিঁ ডাকে, ডুমুর কদম অর্জুনে বাদুড় ঝোলে, বাঁশবনে কটাস ডাকে, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা বাড়ি ফেরে। বাউলার মন সাপের মতো জিভ নেড়ে নেড়ে শব্দ খোঁজে।
নারকেল বাগানে শ্রীমতী বন্দি হয়ে আছে। মেঘলা দুপুরে ছাদে নেচে নেচে তার পা দু’খানি ব্যাথায় কাতর। তাই জানালা খুলে সে ক্যানভাসে রং ঢালছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বুকে নিয়ে শ্রীমতী কান্নায় ঝরো ঝরো। ভোরবেলা আকাশ ভেংগে কালবৈশাখী নেমে ছিল। হুড়মুড়িয়ে কড়াকড় করে আমবাগান তছনছ করে দিয়ে গেছে। শ্রীমতীর বুকে বুলডোজার চালিয়ে সব গন্ধরাজ আর টগরের কুঁড়ি ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। রক্তাক্ত শাড়িখানি আকাশে উড়িয়ে দিয়ে ভিজে ভিজে একশা মেয়ে প্রতিবাদে গান গেয়ে উঠেছিল আর তাই শুনে দুপুরের রোদ হঠাৎ ঝলমল করে ষাঁড়ের মতো ছুটে এসেছিল।
আমি তখন টাংগন ছাড়িয়ে পুনর্ভবার স্রোতে নেমেছি। নদী গল্প বলছে, তিস্তার স্বচ্ছতোয়া স্রোত শাল শিমুলের টানে লুকিয়ে লুকিয়ে মাটির ভেতর শেকড় গেড়েছিল।কোন এক চাঁদনি রাতে সে স্রোত মাটি ফুঁড়ে তারাদের ডাকে সাড়া দিয়ে করতোয়ার ছদ্মবেশে ছলকে উঠেছিল। তারপর রাত যত গভীর হয়েছে চাঁদের আলোয় করতোয়া ততই সুন্দরী হয়েছে।ভোরের আলোয় করতোয়া ভৈরবী রাগে নাচতে নাচতে সাদা বালি গায়ে চাপা দিয়ে মাটিতে মুখ লুকিয়েছে। তারপর সারাদিন ভৈরবের সাথে তার পাতাল ভ্রমণ। হঠাৎ হঠাৎ বুদবুদের মতো চোখ খুলে পিটপিট করে চারপাশটা দেখতে গিয়ে নদী অকারণেই জলাশয়ের পর জলাশয় ফেলে গেছে। নদীতে বাঁশ ডোবে না কিন্তু খালবিলে বাঁশ ডুবে যায়, পাতাল থেকে পৌরাণিক পলিমাটি উঠে আসে।
সারেং বলছে, “এদিকের সব নদীর জল ব্রহ্মপুত্রে যায়। আসে সেই হিমালয় থেকে করতোয়া হয়ে।”
আমি করতোয়ার যাত্রাপথে ছুটছি।বৈকুন্ঠপুরের শালের জংগল, সরস্বতী চা-বাগান, আমবাড়ি হয়ে রাজবংশী পলিয়াদের দু’দিকে রেখে দক্ষিণে বয়ে এসেছে। জল হাতে করে ছুটতে ছুটতে খালবিল ভরিয়ে নাগর, কুলিক, শ্রীমতী, টাংগন, পুনর্ভবা, ঢেপাকে জল দিয়ে অবশেষে আত্রেয়ী হয়ে নেমে গেছে। পুব দিকে বুড়িতিস্তা আর যমুনেশ্বরী সেই তিস্তারই জল টেনে এনে ছোট যমুনা দিয় আত্রেয়ীতে ফেলেছে।সে কি আজকের কথা! ভূষন্ডির কাকও এ সব দেখে গেছে।
-কোন ভূষন্ডির কাক?
-জানো না বাল্মীকিরও আগে যে রামায়ণের গল্প শুনিয়েছিল?
পৌন্ড্রবর্ধনের ইতিহাস ভেসে উঠল। মাথার ওপর দিয়ে ট্রেন ছুটে গেল। হালদার পাড়ার মানুষগুলো মাছ ধরে স্নান করছে। আমাকে দেখেই পূর্বজন্মের আত্মীয়তার সূত্র আবিষ্কার করে ফেলল। আত্রেয়ীর কথা জিজ্ঞেস করলাম। তারা বললে, “সে আত্রেয়ী আর নাই। দেখবেন পতিরামের কাছে কত কত চর পড়েছে।”
-সে সব কি আগে থেকে ছিল না?
-ছিল দু একটা, কিন্তু এত চওড়া ছিল না।তবে পুনর্ভবার চাইতে একটু ভালো।
-ধীরে ধীরে নদী এভাবেই করুণ ইতিহাস হয়ে ওঠে।
আমার মন বলছে, নদিটা রাতদিন সূর্যের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তার বুকে যন্ত্রণার পাহাড়। শ্রীমতীর করুন মুখটা ভেসে উঠল। বেচারি বালুরঘাট শহরে জানালা খুলে বসে আছে। তার চোখে অকাল বর্ষায় ভেজা আকাশ আর সম্ভ্রম বাঁচাতে পারছে না। শ্রীমতী নিজের ভেতরে আগুন খুঁজছে।
বিকেলের আলোয় আমার আত্রেয়ীতে ফেরা। বালুরঘাট কোর্টের পিছনেই নৌকা ভাসছে। একটা রাজমিস্ত্রি কাজ সেরে বাড়ি ফেরার আগে স্নান করছে। তাকে ঘিরে আবছায়া তরংগ। উল্টো দিকে বাঁশবনের মাথায় সূর্য নেমে এসেছে। নদী বড় শান্ত। যেন সে নির্জলা হয়ে মরীচিকা দেখছে। আমি ভাবছি, শ্রীমতী এলে নদীটাও বাঁচত।
নৌকা ছুটল দক্ষিণ-পুবে, তারপর সাপের মতো হেলতে দুলতে সোজা দক্ষিণে। নদী গেছে বাংলাদেশের সূক্তিগছ হয়ে পুবদিকে।সারেং বলল, “ব্রহ্মপুত্রে মিশবার আগে বাংগালী নদির সাথে মিশেছে। সেখানে নদীর নাম কিন্তু গুমানী।”
-গুমানী কেন?
-আত্রেয়ী আর মহানন্দার মাঝখানে বিরাট বিল। গুমানী অনেক জল নিয়ে আসে।
-আর বাংগালী নদীর ব্যাপারটা কি?
-চার পাঁচশ বছর আগেও তিস্তার জল এদিক দিয়েই বইত। বুড়ি তিস্তার নাম শুনেছেন?
-সে তো হলদিবাড়ির দিকে।
-ভূমিকম্প না বন্যায় যেন তিস্তা সরে গেছে। তখন চাউলি আর টালমা আর বুড়ি তিস্তা দিয়েই হিমালয়ের স্রোত নেমে আসত। ভেবে দেখুন করতোয়ার সেই তেজ!
-শুনেছি মুসলমানরা প্রথম দিকে করতোয়া পেরোতেই পারেনি। তাই রংপুর আসাম সব স্বাধীন ছিল।
-সেই কথাই তো বলছি।আত্রেয়ী পুনর্ভবা কি এমনি এমনি এত গভীর।
-এ সব পৌরাণিক নদী।
– কত প্রাচীন জায়গা! জানেন তো কৈবর্ত্যরাই রাজ করত?
-তা জানি না, তবে পাল আমল থেকে কুমোরেরা ব্যবসা বাণিজ্যে ভালই করেছে।
-পালেদের দিন শেষ। এখন আর গাওয়ালে যায় না।
-গাওয়াল! সেটা আবার কি?
-জানেন না পালেরা হাঁড়িপাতিল নিয়ে নৌকায় ভেসে ভেসে ব্যবসায় করতে যেত?
-না শুনি নি।
-খালবিলে ঢুকে যেত।গাঁয়ের মানুষ ধানচাল দিয়ে হাঁড়িপাতিল কিনত।
-বিনিময়?
-ঠিক, কথাটা কিছুতেই মনে আসছিল না। আগে তো টাকা পয়সায় লেনাদেনা হত না।
আমার মনে পড়ছে দেবেশ চক্রবর্তীর ষোলঘড়ি কথা উপন্যাস, বাহিনের আশিঘর পাল পরিবার আর সেই নাগর নদীর উপকথা। হাঁড়ি পাতিল নিয়ে মানুষ আসছে-যাচ্ছে, খাটছে-মরছে, ইতিহাস ছুটছে। এমন সারেং পেয়ে আমি ধন্য। বিনি পয়সায় ইতিহাস ভূগোল জানা হয়ে যাচ্ছে। নদীর দু’দিক স্বর্গের মতো সেজে উঠেছে। সূর্য এখন হলুদ। বাঁ দিকের ধুসর-লাল আকাশে নীল আভা লাইটহাউসের আলোর মতো ছুটছে। নদির জলে আকাশের অদ্ভুৎ শোভা। আমার মন নেচে উঠল। আমি হারিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ নদী গতিমুখ বদলে ডানদিকে ঘুরে গেল।
নৌকায় চেপে দেহাতি মানুষেরা পারাপার করছে। নীল জলে সোনার তরঙ্গ। পশ্চিম আকাশে আগুনের স্রোত। নদীর স্রোতে সোনালি ঝিলিমিলি। আমার মনে আগুন লেগে গেল। কেউ যেন আগুন হাতে নেচেই চলেছে। সব মিলিয়ে অলৌকিক দৃশ্য। শ্রীমতীর মুখটা ফুটে উঠল। সে যেন ডোরাকাটা লালজামা গায়ে দিয়ে ভাসতে ভাসতে ডুবছে উঠছে। জলঢাকা নদী পাহাড় ছেড়ে নামলে পানকৌড়িরা যেমন করে লুকোচুরি খেলে। শ্রীমতীর সাথে জলকেলির স্বপ্ন দেখে আমি রাতের পাখিদের মতো পিউ কাঁহা পিউ কাঁহা চিৎকার করে শ্রীমতীর দিকে হাত বাড়িয়ে ছুটছি। আত্রেয়ী কি এক দুষ্টুমি ভরা চোখে আমাকে দেখেই শ্রীমতীর গায়ে বুকের আঁচল ছড়িয়ে দিল। যেন কৈবর্ত্য চাচা নিপুন হাতে জাল বিছিয়ে মাছ ধরছে। আমি সেই থেকে শ্রীমতীকে চোখে হারাই। নীল অন্ধকারে সে হারিয়ে গেছে। তার গায়ে নীল নীল ডোরাকাটা জামা জেলখানার গরাদের মতো সেঁটে বসে গেছে। আমি সাঁঝতারার কাছে হৃদয়ের যত কথা সব জমা রেখে দিলাম।
সারেং বলছে, ‘করতোয়া এখন বিল ছেড়ে উঠতেই পারছে না।’ গৃহবন্দী শ্রীমতীর মতো নদীও বাঁধা পড়েছে। আমার ভাবতে ভালো লাগছে না। সারেং আপন মনে বলেই চলেছে, ‘তাও ঢেপার বিল থেকে বেরিয়ে নদীটা আসছিল, কিন্তু মোহনপুরে সেই যে রাবার ড্যাম দিল ব্যাস শেষ হয়ে গেল। সেই জলও নাই আর মাছের যে কী দুর্দশা সে তো দেখতেই পাচ্ছেন।’ নদীর সাথে সাথে জনজীবনও বিপন্ন। সারেংয়ের দুঃখ ভাগ করে নিয়ে বললাম, ‘এ ভাবেই পৃথিবী পালটে যায়।’
-মানুষ পালটে গেছে তাই।
সারেং চুপ করে ভাবছে। আমিও ভাবছি, নৌকা চলবে কি করে? মাছ বাড়বে কি করে? সারেং বাবার মুখ খুলল, ‘জানেন এ সময় আগে তিন মানুষ জল থাকত। এখন মাত্র একমানুষ জল নিয়ে নদী বইছে।’ দেখতে দেখতে নৌকা বালুচরে থমকে দাঁড়াল। তার গতর টেনে তোলা দায়। সারেং বাঁশের লগি মেরে কসরত করছে। নদীর দুদিকে শেয়াল ডেকে উঠল। আবহ বদলে গেছে। বাঁশঝাড় আর গ্রাম্য গাছপালায় গা ছমছম করা অন্ধকার। চুপ করে আত্রেয়ীর কান্না শুনছি। সারেং ঠেলে ঠেলে নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে। আমরাও বাংলাদেশের সীমানার দিকে চলেছি। বাঁশের মাচায় দুপদাপ করে ব্যস্ত মানুষ ছুটছে এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে।সারেংকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত মানুষ কোত্থেকে কোথায় যায়?’
-বাঁদিকে মেরিয়া হয়ে আরো পুবদিকে গেলে ধরেন কলাইবাড়ি গ্রাম। সেখান থেকে উত্তর দিকে ভাটপাড়া হয়ে বালুরঘাট।
-নদীর গা ঘেঁষে রাস্তা নাই?
-একেবারে গা ঘেঁষে নাই, বন্যায় ভেঙ্গে যাবে তো।
-আর পশ্চিম দিকে?
-এটা ধরেন চক ভাতশালা, ঐ বট গাছের নীচে আমাদের ‘বিএসএফ ক্যাম্প’। ডানদিকের খাঁড়ি পেরিয়ে উত্তর দিকে গেলে ফতেপুর পড়বে। এদিকে তেমন রাস্তা নাই, ডুবো জায়গা তো।
-এখানে এত চড়া পড়ল কেন?
-গেল বন্যার সময় ডানদিকের সব ডুবে গেছল। খাঁড়ি দিয়ে সব মাটি এসেছে।
সীমান্তরক্ষীদের সার্চলাইট দেখে বিন্দোলের সেই বটের কথা ভাবছি। তার নাকের ডগায় জল পাখি আলো বাতাস ছুটে যায়, তার কিন্তু ওপারে যাওয়া হয় না। হাত বাড়ালেই বিএসএফ কুচ করে ডালপালা কেটে ফেলে। তার শেকড় তো দিব্যি ওপারে খেলছে। যেমন দু’পারের মানুষের মন দু’দিকেই খেলে বেড়ায়। আমার মতো মানুষেরা যেন জেলখানায় লাফাচ্ছে তড়পাচ্ছে। জেলখানাটা দেশের মতো বড়ো বলেই প্রাচীর গায়ে ঠেকছে না। কিন্তু সীমান্তের মানুষ বড়ো বেশি ভুক্তভোগী। নাকের ডগায় যে কাঁটাতারের বেড়া।
সারেং চুপ করে হাল ধরে আছে। আমিও থম মেরে আছি। নদীর দু’দিকে উলুধ্বনি আর শংখধ্বনি, তুলসী তলায় প্রদীপ দেখাবার সময়। এ বড়ো শান্তির সময়। মানুষ কাঁটাতার দেখছে না, সৈনিকের বন্দুকও দেখছে না, শুরু একটু খানি নিজেতে মগ্ন হবার তাগিদে অন্তঃপুরে মনোনিবেশ করে চলেছে। এ সময় আকাশও বড়ো মোহময়ী। কমলা রঙের স্রোতে গাঢ় নীল মিশেই চলেছে। আত্রেয়ীর বুকে রাত নেমে এসেছে। অন্য রকম শব্দ।নিশিডাক ছুটে এল। শ্রীমতীর জন্য মন কেমন করছে। নদীর মতো তারও যেন বাঁশডুবুনি বিলেই পাতাল প্রবেশ ঘটেছে। তার কি তবে এখন দোজখের বিশ্রাম? আমি তারাদের মাঝে উত্তর খোঁজছি। আমার প্রশ্নগুলো গাঢ় হতে হতে কালপুরুষের মতো ছুটে গিয়ে পুবের আকাশ দখল করে বসল।
সপ্তর্ষিমণ্ডল চুপ করে দেখছে। ধ্রুবতারা বলছে, ‘পথ ছেড় না, মঞ্জিল বহুদূর।’ সারেং আঁকাবাঁকা পথে বালুচর সামলে এগিয়ে চলেছে। শ্রীমতী অন্তরে আলো জ্বালিয়ে মঞ্জিলের মতো ঠায় বসে আছে। সেই আমার স্বপ্নও বটে। তার ছাদে সন্ধ্যা-বাতাসে দুলে দুলে আম পড়ছে। কমলা রঙের বোঁটায় কালো কালো দাগ। শ্রীমতীর বুকেও এমনই তিলের সমাহার। সেই সব তিলের সৌন্দর্য অনুভব করতে চোখ বুজে ছুটলাম। বিরাট বিরাট স্তম্ভের আড়ালে প্রদীপের আলো টিমটিম করে জ্বলছে আর গালিব বাঁ হাতে পাকা আম নিয়ে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ডান হাতে দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটা একটা মুক্তো তুলে আনছে।
সোনার অক্ষরে গালিব কথার মালা গেঁথেই চলেছে। যেন সম্রাট আকবর জাফরানি আম রানীর মুখে তুলে দিচ্ছে নেশাচ্ছন্ন অধরে অধর মেলাবার লোভে। শ্রীমতী মৃদু হেসে নীল অপরাজিতার মতো ঠোঁট এগিয়ে দিল। হাজার বছর ধরে কুমোর পাড়ার গরুর গাড়িটা শ্রীমতীর বুকের রক্ত দিয়ে আঁকা কলসিখানি বয়ে নিয়ে চলেছে। আচমকা আমি শুনতে পাচ্ছি কেউ গাইছে, ‘নাও ভাসাইও না মাঝি বিষম দইরাতে।’ সারেঙকে বললাম, ‘কে গায়?’ সে নিরুত্তর। চারিদিকে খুঁজছি কে গায়। কিন্তু চারিপাশ নিরুত্তর। খানিকক্ষণ ধরে চুপ করে বসে রইলাম। সারেং হাল তুললে আর নামালে সুন্দর এক সুর খেলে যাচ্ছে। আত্রেয়ীর জলে আমার মন হারিয়ে গেল।
জোছনা একা একা ঢেউ খেলে চলেছে। শ্রীমতীর মুখটা ভেসে উঠল। সে জানে আমি কোথায় হারিয়ে গেছি। হোক সে বন্দিনী, তবুও তো নিত্যদিন গানই শোনে। সেই তার বেঁচে থাকা। তার কথা ভাবতেই বিকেলের আলোয় ফেরা সোনামুখ সেই মেয়েটির হাসি ছড়িয়ে পড়ল যে কিনা আমার হাতে ক্যামেরা দেখেই সূর্যটাকে আড়াল করে ফিক করে হেসে উঠেছিল। একবারই সে হেসে উঠেই বিকেলের পদ্মফুলের মতো গুটিয়ে গেছে। তার গোলাপি ইশারায় শ্রীমতীর দু’চোখ নাচছে। সে গালে লাল রং লাগিয়ে তুলি হাতে ক্যানভাসটার ওপর ছুটে ছুটে চিৎকার করছে, “কোথায় গেলে আমার কানু হারামজাদা?” তার ডাকে সাড়া দিতে চেয়ে যেই না লাফিয়ে উঠেছি সেইমাত্র কি করে যেন বিন্দু বিন্দু শিশিরের মতো আত্রেয়ীর বুকে পড়ে ক’ফোঁটা ছবির মতোন ঘুমিয়ে পড়লাম। নদির পাড় থেকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শ্রীমতী বলছে, ‘পিপীলিকাদের মতো ডানা মেলে ধরা কি তোমার সাজে?’
-এই কি তবে আমার মৃত্যু?
প্রশ্নটা আমার মনে জোয়ার ভাটার মতো খেলছে। আমি বুঝতে পারছি আত্রেয়ী যা চেয়েছে তাই হয়েছে। কিন্তু আমি কথাটা বলে উঠতে পারছি না। কারণ আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। আত্রেয়ীর কাছে এক আঁজলা জলের জন্য হাত পেতেছি। কিন্তু সে একটুও জল দিতে পারল না।মরীচিকার মতো তাকিয়ে তাকিয়ে বেচারি কেঁদেই চলেছে। চারদিকে উল্কা বৃষ্টি শুরু হল। গুটিগুটি পায়ে আমি মঞ্জিলের দিকেই হেঁটে চলেছি। জানি না স্বপ্ন ধরা দেয় কিনা। জানি না শ্রীমতীও মৃত নদীর ছবি আঁকছে কিনা।কিন্তু সেই রাত থেকেই আমার দু’চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রূ ঝরেই চলেছে।
সুদর্শন ব্রহ্মচারী: সাহিত্যিক, প্রকৃতিপ্রেমী।