কালনির স্নিগ্ধতায় আমার ছেলেবেলা ।। আলম মাহবুব

কালনির

কালনি! এই কালনি নামের সাথে মিশে আছে হাজার বছরের ইতিকথা। আমি বলছিলাম কিশোরগঞ্জ জেলার হাওর বেষ্টিত অষ্টগ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনার শাখা কালনি নদীর কথা। আবহমান গ্রামবাংলার নদীর আত্মপ্রকাশে চিরচেনা এই ভাটির জনপদের কালনি নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে বহু জনপদ, আছে অনেক রত্নগল্প। যা আজ কিছুটা তুলে ধরতে চেষ্টা করছি।

কিশোরগঞ্জের সীমান্ত ঘেঁষে থাকা এই নদীটি কোন একসময় খরস্রোতা নব যৌবনায় ভরপুর ছিলো। বিস্তীর্ণ হাওরের বুকের প্রশস্ত সবুজে কৃষকের ক্লান্তি, হতাশার একমাত্র অবলম্বন এই কালনি। যার উৎপত্তি কিশোরগঞ্জ জেলা ও বি- বাড়িয়া জেলার সীমান্ত নির্ধারণকারী মেঘনার শেষ ভাগ হতে যা হাওরের বুক ছিঁড়ে হবিগঞ্জ হতে আসা বরাক নদী ও রতনাস্তাই নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।

লোকমুখে প্রচলিত, এই সেই নদী যার স্রোতের তীব্রতায় চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্য জাহাজ পথভ্রষ্ট হয়ে ঘোড়াউত্রা নদীতে বিপদাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, কালের বিবর্তনে বহু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও বিশাল হাওরের একমাত্র খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত হচ্ছে এই নদীর পানি দিয়ে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো- ২০০৪ সালে আমি যখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলাম তখন পাড়ার সকল ছেলে মিলে একত্রিত হলাম আর ভাবলাম সকলে নদীতে গিয়ে মাছ ধরব। যেই কথা সেই কাজ। কার্তিকের ভরদুপুরে স্রোতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করেই সাঁতার দিলাম চরের দিকে। নদীতে নামতেই এক ঝাঁক বালকের দল যেন রাজহাঁসের মতো লাফিয়ে অতিক্রম করছে কালনির স্রোতালো ঢেউ। সকলের পাত্রে মাছ ধরা পড়ল। সময় হলো বাড়ি ফেরার। সকলেই বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম।

মাঝ নদীতে আসতেই স্রোতের প্রতিকূলে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় নিশ্চিত মৃত্যুর কবলে, বীন জালের জেলেদের হাতে আমার হাত। মহান রাব্বুল আলামীনের অশেষ রহমতে সেই দিন নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বেঁচে যাই। বীন জাল হলো নদীতে রাখা বড় আকৃতির একধরনের জাল। যার সম্মুখ থেকে শেষ প্রান্তের ব্যবধান হলো ৫০-৬০ হাত বা এর চেয়েও বেশি। যে জালের ভেতরে একবার ঢুকলেই আর বের হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এই যৌবনা কালনি সেইদিন আমার জীবন নাশের মন্ত্র নিয়ে আমাকে ভাসিয়েছিলো তার রসালো স্রোতের অনুকূলে। আজও মনে হলে শরীর শিহরে উঠে।

শান্ত কালনি নদীর বুকে সাঁতার কাটছে একদল হাঁস।ছবি: রিভার বাংলা।

সেই দিন হতে এখনো পর্যন্ত এই নদীতে আমার সাঁতার দেয়া হয় না। সময়ের সাথে সাথে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে, এখন আর সেই স্রোত তেমন দেখা যায় না। কালনিকে জানতে যখন আমার নানার কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম ঠিক তখনই বের হয়ে আসলো এক বিষ্ময়কর তথ্য। ১৯৩৯ সালের কথা। ততকালীন ব্রিটিশ ভারতের শাসনামলে এই হাওরাঞ্চলে নাকি প্রায়ই চলে আসতো বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম। নানার ভাষ্যমতে তিনি তখন ষোল বছরের টগবগে যুবক। শুধু তাই নয়, লোকমূখে শোনা যায় হাওরাঞ্চলের নদীর উপর অনেক গানও তিনি রচনা করে গেয়ে গেছেন।

অনেক খুঁজাখুঁজি ও বাউল সম্রাট আব্দুল করিমকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেল কালনি নিয়ে তার একটা গানও আছে। যেই গান এখনো হাওরের বুকে বর্ষায় মাঝিদের ভাটিয়ালি সুরে শোনা যায়। এক পর্যায়ে নানা ভাই বললো, বাউল এখানকার কাস্তুল জনপদে এক নারীর প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। কিন্তু বেশি দিন অতিবাহিত হওয়ার আগেই ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বাউলের কালনি মৃত্যুবরণ করেন। ঐ রমনির নামও ছিলো কালনি যিনি বাউল ভক্ত ছিলো। তার মৃত্যুর পর শাহ আব্দুল করিম আর এদিকে আসেননি।

শুধু কি শাহ আব্দুল করিম, কে না এসেছে এই মেঘনার তীরে হাওর জনপদের বিভিন্ন নদী শাখায়। এসেছেন পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, সুকুমার রায়সহ বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। এই নদী পথে চলাচল করেছেন বাংলার বারো ভূঁইয়ারা। এসেছেন ঈশা খাঁর মতো কালজয়ী বীরেরা। আজও এই হাওর জনপদের বিস্তৃত অঞ্চলের এক সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ এই নদীগুলো। ঋতু বৈচিত্র্যের সাথে সাথে পরিবর্তন হয় এখানকার নদীর রূপ।

যেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী’। আঁকাবাঁকা গ্রামের এই জনপদের সাধারণ জেলেপাড়ার মানুষগুলো শত বছর ধরে তাদের জীবিকার জন্য এই নদীকে আপন করে নিয়েছে। অষ্টগ্রামের কালনি নদী মেঘনার উপশাখা হলেও অষ্টগ্রামবাসী এই নদীর উপরই নির্ভরশীল। শুকনা মৌসুমে এই নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতের বালুময় গতি আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। ছোটবেলা কাটানো আমার এই নদীটি বর্ষায় যেন মিলিত হয়ে যায় সমুদ্র সৈকতের সাথে। শুধু অষ্টগ্রামবাসী নয় সমগ্র বাংলাদেশের পর্যটকরা দেখতে আসে ভাটি অঞ্চলের নদীমাতৃক এই হাওর দ্বীপকে।

কালনি নদী । ছবি: রিভার বাংলা।

এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে পল্লীকবি জসীমউদ্দীন বলেছিলেন, তৎকালীন ময়মনসিংহের হাওরের বুকে যদি আমার জন্ম হতো তবে আমি ধন্য হতাম। মেঘনা তীরবর্তী এই গ্রামের চারপাশের নদীগুলো যে কাউকে মুগ্ধ করবে। যেমনটা আমাকে করেছে। ১৯৮৪ সালে কিশোরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কবি শামসুর রাহমান হাওরে ঘুরতে এসে তাহার ধান ভানলে কুঁড়ো দেবো বইয়ে লিখেছেন, আমি হাওরে থেকে যাব। এভাবেই শত শত জ্ঞানীরা যুগের পর যুগ হাওর বেষ্টিত অষ্টগ্রামের নদ-নদীকে নিয়ে তাদের মনের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন লেখনি, বিভিন্ন পদ্য, গদ্য ও কবিতা দ্বারা।

বিশাল মাঠ ও সবুজের সমারোহে বসন্তের মন মাতানো কালনী নদী যেন মনে করিয়ে দেয় হাওরের বুক চিরে কৃষাণের প্রাণের স্পন্দনে ক্লান্তি দূর করা ভর দুপুরে সাঁতার কাটার সেই ছোটবেলা। তবু মন ভরে না, শান্ত সূর্যাস্তের মাঝে নিজেদের ভুলিয়ে ফেলি অজানা এক ভালোবাসাই। পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের জেলেপাড়ার ঘন জনবসতির মতো হাওর বেষ্টিত অষ্টগ্রাম ও এখনকার জীবন -জীবিকার মাধ্যম এই চিরচেনা নদীগুলো। পদ্মা পাড়ের কুবেরের জীবনের বৈশিষ্ট্যের সাথে এখনকার জনপদের জীবন-জীবিকার বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে কালনি নদীর তীরের মানুষগুলি সবসময় যুদ্ধ করে আসছে।

কথিত আছে যে, হযরত শাহজালালের সফরসঙ্গী ১২ জন সাহাবী এই কালনি নদী দিয়েই অষ্টগ্রামের প্রবেশ করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন, হযরত শাহ কুতুব (রঃ)। যাহার অনেক অলৌকিক ঘটনা অষ্টগ্রামের ইতিহাসে কথিত আছে। স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই নদীগুলো বিশেষ করে মেঘনা, কালনি, ধলেশ্বরী (মেঘনার আরেকটি উপশাখা), ঘোড়াউত্রা পাক হানাদার বাহিনী হতে অষ্টগ্রামকে ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করেছে।

পরিশেষে বলতে চাই যে, মা মাটি ও মাতৃভূমির সাথে মিশে আছে আমাদের নদীগুলো। যে নদীগুলোতে আমরা কাটিয়েছি আমাদের শৈশব, আমাদের যৌবন।যেখানে মিশে আছে মমতার স্নেহ বন্ধন। তাইতো কবিতার ভাষায় বলতে হয়,  “এখনো মন টানে কালো মেয়ের স্রোতের পানে শৈশব কেটেছে আমার সবুজের ঘ্রানে।”

আলম মাহবুব : লেখক, কবি ও শিক্ষক।


আরও পড়তে পারেন….
নদীর নাম মুজনাই ।। শৌভিক রায়
“নদী সেতু হয়ে আছে আমাদের বন্ধুত্বে” 
প্রিয় নদী ।। মনোনীতা চক্রবর্তী

সংশ্লিষ্ট বিষয়