নদী বিধৌত জেলা পটুয়াখালীতে আমার জন্ম হলেও আমাদের বাড়ির আশেপাশে কোনো নদী নেই। তবুও মনের দিক থেকে নদী ছিলো আমার অসম্ভব পছন্দের। শৈশব-কৈশোরে নদীকে ঘিরে অনেক স্বপ্নও ছিলো আমার। কিন্তু শৈশব-কৈশোরের সব স্বপ্নকী সবার পুরণ হয় ? সে যা-ই হোক অন্যদের কথা না-ইবা টানলাম।
আমার সে সব স্বপ্ন আজও অধরাই পরে রইলো। তবে খাল-বিল, নদী কিংবা জল ও মাছের প্রতি অসম্ভব রকমের টান আজও আমার রয়েছে। কিন্তু কি আর করার শহরে বসবাস। আচ্ছা সেই শৈশবেই আবার ফিরে যাওয়া যাক। ঘুরে আসি কতক্ষণ সেই ছেলেবেলার কথকতা নিয়ে। যা বলছিলাম যে আমাদের বাড়ির আশেপাশে কোনো নদী নেই। তবে ৪/৫কিলো মি. দুরে একটি নদী রয়েছে। তার নাম লোহালিয়া।
লোহালিয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ৯৩ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩২৫ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ণ বোর্ড (পাউবো)’র তথ্যানুযায়ী লোহালিয়া বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দুরগাপাশা ইউনিয়ন এলাকায় প্রবহমান তেঁতুলিয়া নদী হতে উৎপত্তি লাভ করেছে। অতঃপর এই নদীর জলধারা একই জেলার দুধাল, কবাই, কাছিপাড়াা, হানুয়া, মুরাদিয়া, লোহালিয়া, আমখোলা, গজালিয়া, গোলখালি ও ডাকুয়া ইউনিয়ন পেরিয়ে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার চালিতাবুনিয়া ইউনিয়ন পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে রাবনাবাদ নদীতে নিপতিত হয়েছে।
নদীটির উজানের তুলনায় ভাটির দিক অধিক প্রশস্থ। নদীতে সারাবছর পানিপ্রবাহ পরিদৃষ্ট হয় এবং ছোটবড় নৌযান চলাচল করে। তবে বর্ষাকালে নদীটিতে স্বাভাবিকের চেয়ে পানির প্রবাহ অধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এ সময় নদীর তীরবর্তী অঞ্চল বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। নদীটি জোয়ার ভাটার প্রভাবে প্রভাবিত। এই নদী বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তৃতীয় শ্রেণির নৌপথ হিসেবে স্বীকৃত।
লোহালিয়া বাংলাদেশের দক্ষিণ জনপদের জেলা পটুয়াখালীর বাউফল ও দুমকি উপজেলাকে সমান দুই ভাগে ভাগ করে বয়ে গেছে। মূলত পটুয়াখালী এই এই লোহালিয়া নদীর তীরেই অবস্থিত। পটুয়াখালীর পায়রার সাথে মিশেছে এটি। হ্যাঁ, সেদিনের খরস্রােতা লোহালিয়ার বুকের ওপর দিয়ে তুমুল আলোড়ন তুলে চলত ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে পটুয়াখালী ও খুলনাগামী বড় বড় সব লঞ্চ-স্টীমার।
গভীর রাতে ষ্টীমারের শব্দ আমরা বাড়ি থেকে শুণতে পেতাম। এমনকি বগা লঞ্চঘাটে ভেড়ানোর সময় এর সার্চ লাইটের আলো আমাদের বাড়ি অব্দি পৌঁছত। এই লোহালিয়াকে ঘিরে রয়েছে অনেক না বলা কথা। রয়েছে অনেক না বলা শৈশবস্মৃতি। যা আজ প্রাণখুলে বলতে চাই। এই নদীতীরবর্তী কোন এক বাড়িতে বিয়ে হয় আমার বড় ভাইয়ের। আহা বিয়েতো বড় ভাইয়ের আর অসীম আনন্দ আমার মনে। কারণ একটাই, আর তা হলো ওই নদী। এই নদীর কারণেই আমি ঘুরে ফিরেই ঐ বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। দুপুরের জোয়ারের সময় সবাই মিলে একত্রে নদীতে গোসল করতে যেতাম। নদীর জলে সাঁতার। সে কি উচ্চাসিত মন। নদীতে ডুবিয়ে মাছ ধরতাম। অনেক সময় যাত্রীবাহী লঞ্চ আসতে দেখলে আমরাও কিনার থেকে সাঁতরে নদীর মাঝ অব্দি পৌঁছে যেতাম। আহারে সে কি আনন্দ আর জৌলুসময় সময়ই পার করেছি শৈববে। যে স্মৃতি কখনও ভুলবার নয়।
গ্রামের বাড়িতে যখন যাই, জীবনের দৈনন্দিনতাটুকু আড়াল হলেই কল্পনায় আজও শুনতে পাই দশদিক কাঁপিয়ে স্টীমারের ভোঁ বেজে উঠছে। বগা লঞ্চঘাটে অসংখ্য যাত্রীর ওঠানামায় কলমুখর হয়ে উঠেছে সেই লোহলিয়ার তীর। দারুণ নস্টালজিয়া ভর করে। কল্পনায় ছুটে যাই নদীর তীরে। কখনও কখনও মনেভাসে গালিভার্স ট্রাভেলসের সেই নদী তীরে পরে থাকার গল্প। স্মৃতির সেই লোহালিয়ায় আজও ভাসে মন।
তবে এক সময়ের প্রবল খরস্রােতা এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্ববহ নদীটি নাব্যতা হারিয়ে আজ ধুকে ধুকে চলছে। নব্যতা হারিয়ে স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত হয়ে ধীরে ধীরে সরু হয়ে গেছে। তবু আজও যেমন ঢাকা-পটুয়াখালী রুটের যাত্রীবাহী সব বড় বড় লঞ্চ ভাসে এই নদীতে তেমনি স্মৃতির সেই লোহালিয়ায় আজো ভাসে মন। কারন আমার জীবন প্রবাহের সাথে বহতা লোহালিয়া নদীটি একাকার হয়ে মিশে আছে। যেখানেই যাই বুকের ভেতর এই নদীটির কল কল গর্জন শুনতে পাই। আমার জীবনধারা ও জন্মভূমির দূত হয়ে আমার সত্ত্বার সাথে মিশে থাকে প্রাণের দোসর লোহালিয়া।
বছরে এক-আধবার যখন গ্রামে ফেরা হয় তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রাণভরে দেখা হয় শৈশব স্মৃতি বিজড়িত এই লোহালিয়াকে। তখন নদীও যেন আমাকে ডাকতে থাকে দুহাত বাড়িয়ে।
মো.ইউসুফ আলী: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।