ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক জেলে পরিবারের সুপেয় পানির সমস্যা সমাধান করলো নদী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার’। ১৭ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার ২০২৩ বিকালে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাউন্দিয়া বাগেরআক্রা শ্মশানঘাটে আরডিআরসি’র উদ্যোগে স্থাপিত পানির পাম্পটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ এর সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আমিন বাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রকিব আহমেদ, ক্লাইমেট এক্সপার্ট মনির হোসেন চৌধুরী, চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নির্বাহী সদস্য ইবনুল সাঈদ রানা, তুরাগ নদী সুরক্ষা কমিটর সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হক সরদার, দৈনিক প্রথম আলো’র সিনিয়র রিপোর্টার আরিফুর রহমান, পরিবেশ সংগঠক আমিনুর রসুল, কাউন্দিয়া পুলিশ পাড়ির ইনচার্জ সাব-ইন্সপেক্টর সুব্রত দাশ ও মোহাম্মদ রুমেল প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আমিন বাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রকিব আহমেদ বলেন, হিন্দুদের আদি নিবাস ছিল আমিন বাজারসহ তার পাশবর্তী এলাকাগুলোতে। সেখান থেকে হিন্দুরা স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে মাঝিরদিয়া, কাউন্দিয়া, বাগিচারটেক, ঈশাখাঁবাদ সহ পাশবর্তী অন্যান্য গ্রামগুলোতে। বর্তমানে আমিন বাজার ইউনিয়নে কোন হিন্দুর বসবাস নেই। আমরা কয়েক পূর্বপুরুষ থেকে আমিনবাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমরা কখনো হিন্দু-মুসলিম বৈষম্য করিনি। কাউন্দিয়া ইউনিয়নের হিন্দু-মুসলিম জেলেদের সার্বিক উন্নতির জন্য কাউন্দিয়া চেয়ারম্যানের সাথে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবো। রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারকে নদী ও নদীর পাড়ের মানুষকে সহয়তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।
ইবনুল সাঈদ রানা বলেন, আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, তাহলে তুরাগ ও তার প্রকৃতিক দৃশ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে, তুরাগ পাড়ে অবস্থিত কাউন্দিয়া বাগেরআক্রা শ্মশান ঘাট হবে উল্লেখযোগ্য স্থান। আমি রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার-এর এই মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।
ক্লাইমেট এক্সপার্ট মনির হোসেন চৌধুরী বলেন- যে জনগোষ্ঠীর কৃষ্টি, সংস্কৃতি যত উন্নত সে জাতি ততবেশি উন্নত। খাবার, গান-বাজনা একটি জনগোষ্ঠির সংস্কৃতির অংশ। তুরাগ নদীর পাড়ের জেলে জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি নদীর সাথে সম্পর্কিত। নদীর পানি দূষিত হওয়ার কারণে নদীতে মাছ নেই, জেলে পেশা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, বর্তমানে সংস্কৃতি ধরে রাখা কষ্টকর হচ্ছে। তুরাগ নদীর পাড়ে অবস্থিত ফ্যাক্টরিগুলো নদীর পানি দূষিত করছে। আমাদের নদীর পানি দূষণ রোধে প্রধান বাঁধাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। নদী দূষণ রোধ করতে পারলে নদীতে মাছ বৃদ্ধি পাবে, এর সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষ আরো উন্নতি করতে পারবে এবং নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে পারবে। একটি ছোট উদ্যোগের মাধ্যমে সবাইকে একত্রিত করার জন্য এবং এই জনগোষ্ঠির সাথে সংহতির প্রকাশের জন্য রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারকে ধন্যবাদ জানাই।
মাসুদুল হক সরদার বলেন, আরডিআরসি’র এই মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তুরাগ নদী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, তুরাগ নদীর পানি দূষণের কারণে নদীর পাড়ের জেলেরা বছরের ছয় মাস বেকার থাকে। এদের অনেকে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। তাই আমরা তুরাগ নদী দূষণ রোধে কাজ করে যাচ্ছি।
আমিনুল রসুল বলেন, নদী পাড়ের জেলেদের জীবন একরকম আবার সাগর পাড়ের জেলেদের জীবন আরেক রকম। জেলেরা মৎস্য আহরণের মাধ্যমে মাছের যোগান দিয়ে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে থাকে। কিন্তু জেলেদের কোনো পরিসংখ্যন নেই। যুগ যুগ ধরে নদীর পাড়ের জেলে জনগোষ্ঠী নিগৃহীত ছিল। রাষ্ট্রের নিকট তুরাগ পাড়ের জেলেদের তথ্য নেই বলে তুরাগ নদী পাড়ের জেলেদের কোন রেশনের ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত গবেষণা নেই বলে কতজন জেলের পেশা পরিবর্তন হয়েছে তার কোন তথ্য নেই। তাই নিজেদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
আলোচনায় জাকির হোসেন খান বলেন, আরডিআরসি তাদের কাজের মাধ্যমে নদী, পানি ও সম্পৃক্ত মানুষের সমস্যা তুলে ধরেছে। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য সারাজীবন প্রকৃতি থেকে যে পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করে তার মূল্য আট হাজার কোটি টাকা। সভ্যতার উন্নয়ন হলেও পানি, বায়ু ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। তুরাগ নদীর পানি নষ্ট করার মাধ্যমে মানুষ অকৃতজ্ঞতা ও আত্মঘাতীর পরিচয় দিয়েছে। মানুষ নিজেদের উন্নতি করতে গিয়ে পরিবেশ সবসময় দূষিত করছে। প্রাচীন সভ্যতাগুলো ধ্বংস হয়েছে মানুষের নিজেদের কারণে। তাই পরিবেশ দূষণ রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। নেতৃস্থানীয়দের নিকট আমার আকুল আবেদন তুরাগ পাড়ের জেলেরা যাতে সুরক্ষা পায়।
কাউন্দিয়া পুলিশ পাড়ির ইনচার্জ সাব-ইন্সপেক্টর সুব্রত দাশ বলেন, প্রাগঐতিহাসিক সময় থেকে নদীর মাছ আহরণের মাধ্যমে নদীর সাথে জেলেদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। নদী টিকে থাকলে মানুষ টিকে থাকবে। তাই সবাইকে একসাথে নদী দূষণ রোধে এগিয়ে আসতে হবে।
জেলে ব্যবসায়ী নিত্য রাজবংশী, সুসেন রাজবংশী, নিরঞ্জন রাজবংশী ও গৃহিনী কমলা রাজবংশী তাদের নিত্য জীবনের নানা সমস্যা উল্লেখ করে বলেন, একসময় তুরাগ নদীর পানি খাওয়া ও রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার হতো এবং নদীতে অনেক মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন ফ্যাক্টরী থেকে বর্জ্য এসে নদীর পানি দূষিত হওয়ার কারণে মাছ মারা যায়। ছয় মাস মাছ না পাওয়ার কারণে বেকার থাকতে হয়। এতে সংসার চালাতে কষ্ট হয়, ঋণ নিতে হয়। একসময় তুরাগ নদীর পানি খাওয়া যেত কিন্তু এখন নদীর পানির স্পর্শ করা যায় না। নদীর পানি দূষণের কারণে মাছ পাওয়া যায় না তাই এখন অনেকে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয়। নদী দূষণের পাশাপাশি শ্মশান ভেঙে পড়ছে। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি নদীকে দূষণমুক্ত করা এবং শ্মশান রক্ষার জন্য অনুদান প্রদান করা। আমাদের একটাই দাবি আমরা তুরাগ নদী দূষণ মুক্ত চাই। আশা করি সরকার আমাদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে।
আরডিআরসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমরা তুরাগ নদীর পানি দূষণের কারণে নদী পাড়ের জেলে ও বেদে জনগোষ্ঠীর জন্য খাবার পানি সরবরাহের জন্য পানির পাম্প স্থাপন করে তাদের সাথে সংহতি জানাচ্ছি। আমরা আরো দু‘টি পাম্প স্থাপনের আশ্বাস দিচ্ছি।
তিনি আরো বলেন-তুরাগ নদীর গবেষণায় আমরা লক্ষ্য করি নদীর পাড়ে বাইশটি জেলে গ্রাম রয়েছে। সাভার উপজেলায় অবস্থিত দশটি জেলেগ্রাম হলো: মাঝিরদিয়া, বাগিচারটেক, ঈশাখাঁবাদ, মেলারটেক, কাউন্দিয়া, গোলারটেক, কোটবাড়ি, বারয়ানি, বরাদপুর ও বেলতলি। এছাড়া আরো বারোটি গ্রাম গাজীপুরে অবস্থিত। সরকারের নিকট এই গ্রামগুলোর জেলেদের কোন তথ্য নেই কারণ সরকারের নিকট পৌঁছানো হয়নি। জেলে ও বেদে জনগোষ্ঠীর উন্নতিতে সরকারকে কিভাবে যুক্ত করা যায় আমরা সেই চেষ্টা করবো।
আলোচনা সভায় জেলে ও বেদে সম্প্রদোয়ের প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন। সভায় তাদের অনেকে পেশাগত ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে জেলেদের পরিবেশনায় ভিন্নরকম এক সাংস্কৃতিক আয়োজন ছিল।
আরও পড়ুন…
চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর দূষণ ও দখল রোধে গোলটেবিল আলোচনা
অনুষ্ঠিত হলো “মুক্তিযুদ্ধে নদী” নিয়ে আলাপ