মুক্তগদ্য >> বৃষ্টিদিনে আমার একটা নদীর কথা মনে পড়ে। আমার নদী। আমার বাড়ির উঠোনের এক নদী। অনেকবার তাকে নাম দিতে গেছি। সে মুখ নামিয়ে নিয়েছে। ঠিক যেন মনে হবে নাম বুঝি মুখে পরিয়ে দেওয়া হয়। মুখ নামিয়ে নেওয়ার মানে কি? আমি আর নদী কি এক স্কুলে পড়তাম?
সকলের চোখের আড়ালে গিয়ে আমি তো তাকে আমার প্রিয় কোনো নাম দিতে চাই নি। নাম প্রিয় হয় বুঝি? নাকি মানুষটা প্রিয় হয় আর নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার সেই মুখটা ভেসে ওঠে। যখন বলি নামটা প্রিয় ততক্ষণে চোখের সামনে ভেসে ওঠা মুখটায় অনেকবার আদর হয়ে গেছে। যতবার মুখে নাম উচ্চারণ করি ততবার প্রিয় মুখের ঠোঁট দুটো ভিজে যায় বৃষ্টিতে। এই বৃষ্টি থামে না। ঝরে যায় রাতদিন। চৌকাঠ পেরিয়ে সিঁড়িতে পা ফেলতেই নদী দুলে ওঠে। নদী যে আমার নাম নিতে চায় নি তাহলে এই দুলে ওঠা কার টানে? গায়ে এসে পড়ে বৃষ্টির দানা। বৃষ্টিদিনের ভোরের ছাই ছাই আকাশ। তারও কি কোনো নাম আছে ? বৃষ্টিদিনের ভিজে যাওয়া পথ, কোন নামে তার ভিজে শরীরে পৌঁছানো যাবে? নাম তো একমুখী পথ।
সোজা চলে যাও গানের পথ ধরে। এমন পথে নদীকে স্থির রাখা যায় ? সে তো নিজেও জানে না কখন সে হাঁটু ধুলোর পথে পা বাড়িয়েছে। চলতে চলতেই তো সে ঘুমিয়ে পড়ে। আমরা তাকে ঘুমের দেশে এত অনায়াসে ছেড়ে দিতে পারতাম ? অথবা সেই সময়টা যখন সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও ছড়িয়ে দেয় শরীর। এত অবাধ স্বাধীনতায় আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে সদর দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতে পারতাম ? অথবা সারাদিনের মেঘলা আকাশের মনখারাপ করা রঙের ওপর সে যখন একটুখানি দাঁড়াবার জায়গা তৈরি করার জন্যে দুপুরের তুলি ছোঁয়াতে যেত তখন আমরা তার সাহসের দুপায়ে একটুও নজর দিতাম না ?
আমি যখন কথা বলায় ব্যস্ত তখন তো নদী উঠোন পেরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। কেন নদী ফেলে দিল আমার কথা, আমি তো শুধু তাকেই ডাকতে চেয়েছি আমার কথায় ——- এইভাবে যখন নদীকে সামনে রেখে কথার পিঠে কথা সাজাচ্ছি তখন নদী দুপুর পেরিয়ে বিকেলের সেই দীর্ঘ মাঠে পা দিয়েছে। এমন একটা ছলাৎছল জলে কোন নাম ভাসবে ? তার চেয়ে আমার মুখের কথা একটু চুপ করে বসুক, দু’চোখ চেয়ে দেখুক নদী কিভাবে নিজের মনে গান গাইতে গাইতে পথের বাঁকে হারিয়ে গেল। কিন্তু তখনও তো সে যায় নি। বুকের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে বসে গেছে একটার পরে একটা পায়ের ছাপ। মাথা দোলাতে দোলাতে সে ভুলেই যাবে তার মনের ইচ্ছার কথা।
নদীর কাছে এলে আমি ঘুমের কথা ভুলে যাই। যেটুকু সময় আমি জীবনে চোখ বুজেছি তার জন্যে আমি নদীর কাছে মাথা নিচু করে বসে থাকি। নদীর শুরুই যেন ঘুমের শেষ দিয়ে। সে সারারাত জেগে বসে থাকে এমন কিন্তু আমার কখনও মনে হয় না। মনে হয় তার সারা শরীরটাই চোখ। সমগ্র দিয়ে যেন সে সভ্যতার দিকে চেয়ে বসে আছে।
কোনো কোনো সময় আমার সারাদিন নদীময় হয়ে থাকে। নদীর কথা কাছে এলেই মনে হয় আমি কতদিন ঝগড়া করেছি অকারণে। কত তুচ্ছ কারণে মন অশান্ত হয়ে উঠেছে। আমার চারপাশের মানুষজন যারা আমারই কথায় বারবার উঠে আসে তারা আমারই কথায় কত দূরে সরে গেছে। বিবাদের কথা মনে এলেই মনে হয় আমি আমার দু’হাত বাড়িয়ে আছি শুধু পাওয়ার অপেক্ষায়। তা না হলে কিসের কলহ ? আমি কেন সকলের সঙ্গে মিশতে মিশতে কিছু একটা প্রাপ্তির ইচ্ছায় মনকে তৈরি করব ? নদী আমাকে বারবার লজ্জায় ফেলে দেয়। নদীর পথ চলাই আমাকে শেখায় সবকিছু নিয়ে চলো। সব তোমার পথে লাগবে। বিভাজনের অধিকার তোমাকে কে দিয়েছে? নদীর চোখে চোখ পড়লেই মনে হয় সে যেন সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে, একেবারে কাঁধে হাত দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
আমি কোনোদিন কারও চলে যাওয়া দেখি নি। বাড়ির কাছে আমার যে নদী সেও তো অনেক দূর চলে গেছে। কত দূর আমি কোনোদিন দেখিনি। আমি তো দূরের দিকে ঠিক তাকাই না। আমি ঘাটের কাছে এসে বসি। এখানে বসলে নদীর সবটুকু ছোঁয়া যায়। মনে হয় যেন আমি নদীর উঠোনে এসে বসলাম। যেকোন সময়েই গল্প শুরু করে দেওয়া যেতে পারে। নদী বাঁক নিলেই মনে হয় আকাশ জুড়ে মেঘ করে এসেছে। এরপর ছাই ছাই রঙ ঘিরে ধরবে আমার চারপাশ। আমার দমবন্ধ হয়ে আসবে।
একদিন তো সকালে চোখ খুলেই বৃষ্টি। বর্ষা কিনা মনে পড়ে না। সেদিন তো আর জানলায় রোদ এলো না। গল্পটা যেন কে কোথায় হাত দিয়ে থামিয়ে দিল। গল্প ছাড়া তো আর দিন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। পায়ে পায়ে সেদিন একেবারে নদীর গায়ে। ইচ্ছা ছিল জল ধরে ধরে চলে যাই কিন্তু নদী আগ্রহ দেখালো না। ছাই আকাশের ছবি নিয়ে নদীও যেন সেদিন গায়ে ছাই মেখেছিল। কিছুতেই আমার কাছে ঘেঁষছে না। নদীর আকাশ দেখতে দেখতে একেবারে নদীর বাঁকে এসে হাজির। আমি তো হারিয়ে যাই। কিছুতেই আর নিজেকে জড়ো করতে পারি না।
মনে পড়ে যায়, এইরকমই এক বর্ষা দুপুরে সাদা বেড়ালটা সেই যে ভাত খেয়ে বেরিয়ে গেল আর ফিরলো না। রাতে খাবার থালায় ওর মুখ না দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বার দুয়েক ডেকেছিলাম। তারপর আবার রোজের কক্ষপথে। যে মনে চলে যাওয়ায় ক্ষতের দাগ নেই সেখানে নদীর বাঁক কি দাগ কাটবে ? এইভাবেই নদী বর্ষা দুপুরের মেঘ আকাশের নাম বৃষ্টি দিয়ে কিছু রাখতে চায় না।
হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় : কবি ও গল্পকার।