‘ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল ছলাৎ ছলঘাটের কাছে গল্প করে নদীর জল’
না, আমার তিস্তা এমন নদী না; গল্প সে করে, তবে সে গল্প নামনাজানা পাহাড়ি ঝরনার, সে গল্প প্রায় ভুলে যাওয়া আদিম জনজাতির। সে গল্প দুরন্ত, চঞ্চল, উচ্ছল। আমার তিস্তা অভিমানী, বেপরোয়া। শীতের বেলায় প্রায় মরা সোঁতা, বর্ষাকালে উপচে পড়া তাথৈথৈ।
আমার বাড়ি তিস্তার পারে ছিল বললে খুব ভুল বলা হবে না। জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়া, সরু একটেরে গলিতে প্রায় শেষে এক ভাড়া বাড়ি। বাঁশের ছেঁচার বেড়া, লঙ্কা জবার গাছ, এগোলে তপনদের খাটাল আর বিষ্ণুদা’দের বাড়ি। নীল অপরাজিতা ফুটে থরে থরে। দেখতে দেখতে দৌড়ে বাঁধ; তিস্তা। তখন তিস্তা দূরে, দোমোহনীর দিক দিয়ে বইছে। মাঝে বড় চর, সেখানে রীতিমত চাষাবাদ, বাড়িঘর। পাটক্ষেতের মধ্যে লুকোচুরি। পেরিয়ে তিস্তা। চোরাস্রোত বইছে তলেতলে, কাঠকুটো ঘূর্ণিস্রোতে ডুবছে আর ভাসছে। চরের বাচ্চাগুলো ঝাঁপ দিয়ে ওই ঘূর্ণি ডিঙিয়ে, স্রোত এড়িয়ে তুলে আনছে ভেসে আসা কাঠ।
এরপরে তিস্তার সাথে মোলাকাত বাবার হাত ধরে ঘুরতে গিয়ে। শিলিগুড়ি পেরিয়ে গেলেই রেললাইন। ঝমঝম শব্দে ট্রেন পেরিয়ে যেত তিস্তার ওপর রেলব্রিজ। রুপোলি ব্রিজ এড়িয়ে চোখ যেত শ্যাওলা-সবুজ বুকে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা সেবক স্টেশনের দিকে। সেসব ছাড়িয়ে আরও খানিক এগিয়ে গেলেই সেবক ব্রিজ। আসলে করোনেশন ব্রিজ, ১৯৩৭ এ জর্জ VI আর এলিজাবেথের রাজা ও রাণী হওয়ার অভিষেক উপলক্ষে এই ব্রিজ; এখন লোকমুখে সেবক। ৩১ নম্বর জাতীয় সড়ক ব্রিজ পেরিয়ে জঙ্গল ফুঁড়ে, চা-বাগানের মধ্যে দিয়ে জলপাইগুড়ি হয়ে আসাম রওনা হয়েছে। ব্রিজ থেকে ওইইই নিচে জল; পাথর ফেললে পড়তে লাগে বহু সময়। আরেকটা রাস্তা বেঁকে গেছে তিস্তা ধরে ধরে সিকিমের দিকে।
দুপাশের সবুজ আর পাথুরে গৰ্জ উপচিয়ে মারাত্মক শব্দে পাথর কাঠ ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে তিস্তা। একবার বাস খারাপ। আমি আর বাবা সেবকের খানিকটা পর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটে কালিঝোরা পিডব্লিউডি বাংলো। কি মায়া যে সে রাস্তায়!!! নিচে তিস্তা, আমরা রাস্তা ধরে গল্প করতে করতে, মানে আমার আজেবাজে প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে বাবা চলেছে। পৌঁছলাম বাংলোয়। গেটের ঠিক পাশ দিয়ে সোজা এক লোহার স্পাইরাল সিঁড়ি তিস্তার চরে। নিচে গেলেই অন্য জগৎ। শুধু তিস্তা, আমি আর আদিম ঝিমধরা সবুজ। বাবা পাশে। তন্ময় কেটে যেত কতটা সময়। প্রচন্ড শব্দ করে বইতো সে।পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তো ডুয়ার্সে, আমার জলপাইগুড়িতে। আজও বিনবিন করে স্বপ্ন বোনে ওই দিনগুলো।
তারপর বাংলো পুড়লো। আর তিস্তার কপালও বোধহয় পুড়লো। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। রাম্ভি, কালিঝোরা, সিকিমের সংকলঙ- একের পর এক ফেজে প্রকল্প গড়ে উঠলো। তিস্তা ডোবা হয়ে গেলো। নতুন মানুষ আজ তিস্তা দেখে অবাক হয়ে ভাবে, আহা কি সুন্দর পান্না সবুজ জল। আজ বাঁধ বেঁধে তিস্তার জল ডোবার জলের মতো সবুজ। আজ কোনো শব্দ নেই, কোনো প্রাণ নেই, নিস্তরঙ্গ সবুজ জল বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে তিস্তা আমাদের যাওয়া আসার পথে। গল্পগুলো স্থির জলের নীচে নিথর।
মেঘনাদ সাহা থেকে বহু বিজ্ঞানী বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপদ বারবার বলে গেছেন। জল স্টোর করে রাখার, জীববৈচিত্র ধ্বংস হওয়ার, আরো বহু বহু বিপদ। আমরা শুনিনি, শুনিনা। হঠাৎ ২০১৬ তে উত্তর সিকিমের তিংভঙ্গের কাছে তিস্তার( সেখানে তার নাম রং ইয়ং) ওপরের পাহাড় ধ’সে সব তছনছ হয়ে গেলো! আমরা থামলামনা।
১৯৬৮ তে এক বিধ্বংসী বন্যা ভাসিয়েছিল জলপাইগুড়িকে। কোজাগরী পূর্ণিমার মাঝরাতে তিস্তা সব ছাপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জলপাইগুড়ির বুকে। এই নিস্তব্ধ, নিথর তিস্তা আবার কোনো আবেগ নিয়ে, তীব্র আক্রোশে, খোদার ওপর খোদকারি করার অপমানে সব ভাসিয়ে দেবে কিনা তা তিস্তাই জানে।
আমি শুধু জানি, আমার তিস্তা আমার বুকে আজও ঢেউ তোলে। আমার তিস্তা দোমহনীর পার ভেঙে বয়ে চলে। আমার তিস্তা ডুয়ার্সের মায়াকাজল চোখে নিয়ে ভাসিয়ে দেয় চরাচর। আমার তিস্তা বাঘারুর সংগ্রাম জানে, আমার তিস্তা চা-বাগানের কোল, সাঁওতাল, মুন্ডার অপমান বুকে নিয়ে বয়ে যায় নিরন্তর। এই নিস্তব্ধ পচা ডোবার জল বুকে নিয়ে বয়ে চলা বা দাঁড়িয়ে থাকা নদীটি কিছুতেই আমার তিস্তা না।
শুভময় পাল : সরকারী চাকুরে, লেখক