।। রিভার বাংলা ডট কম ।।
মুহাম্মদ হিলালউদ্দিন, ম. ইনামুল হক, মো. আব্দুল মতিন, জাকিয়া শিশির, শমশের আলী, মিহির বিশ্বাস, শরীফ জামিল, আনোয়ার সাদত, মোহাম্মদ এজাজ, সুমন শামস, আলমগীর কবির ফারুখ আহমেদ, হাসান খান, মনির হোসেন ও শেখ রোকন
এ বছর নিয়ে চতুর্থবারের মতো আমরা যৌথভাবে শনিবার পালন করলাম ‘নদীর জন্য পদযাত্রা’। এর প্রতীকী তাৎপর্য হচ্ছে- আমরা ক্রমাল্প্বয়ে নদী থেকে দূরে সরে এসেছি; আমাদের আবার নদীর কাছেই ফিরতে হবে। একা একা নয়, সবাই মিলে পায়ে পা মিলিয়ে ফিরতে হবে নদীর কাছে। পদযাত্রার মধ্য দিয়ে শানিত হবে নদী রক্ষার শপথ। বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে নদী, পানি ও পরিবেশ নিয়ে সক্রিয় বিভিম্ন সংগঠন ও উদ্যোগের পক্ষে ২০১৪ সাল থেকে আমরা ‘নদীর জন্য পদযাত্রা’ আয়োজন করে আসছি। এ ছাড়াও নদী দিবসে বিভিম্ন সংগঠনের একক আয়োজন থাকে।
‘বিশ্ব নদী দিবস’ প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রোববার পালিত হয়। সেই হিসাবে এ বছর আজ ২৪ সেপ্টেম্বর। এখন অনেকে জানেন, নদীকর্মী মার্ক অ্যাঞ্জেলোর উদ্যোগে কানাডায় ১৯৮০ সালে প্রথম দিবসটি পালিত হয়। ক্রমে বিশ্বের অন্যান্য অংশে দিবসটি সম্প্রসারিত হয়। জাতিসংঘ ২০০৫ সালে দিবসটি ‘এনডোর্স’ বা অনুসমর্থন করে। বাংলাদেশে প্রথম দিবসটি পালিত হয় ২০১০ সালে ‘রিভারাইন পিপল’-এর উদ্যোগে। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা ও বুড়িগঙ্গা রিভারকিপার এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য সংগঠন দিবসটি পালনে যোগ দেয়। ২০১৭ সালে গঠিত হয় ‘বিশ্ব নদী দিবস সমল্প্বয় পরিষদ, বাংলাদেশ’।
প্রসঙ্গত, বিশ্ব নদী দিবসের একক কোনো প্রতিপাদ্য থাকে না। দেশ ও অঞ্চলভেদে ভিম্ন ভিম্ন প্রতিপাদ্য ঘোষিত হয়। ২০১৪ সাল থেকে আমরা যৌথভাবে দিবসটির প্রতিপাদ্য ঘোষণা করে আসছি। ২০১৭ সালের বাংলাদেশ প্রতিপাদ্য- ‘দখল-দূষণমুক্ত প্রবহমান নদী; বাঁচবে প্রাণ ও প্রকৃতি’। বিশ্ব নদী দিবস বাংলাদেশে ও বিশ্বে মূলত বেসরকারি পর্যায়ে পালিত হচ্ছে। আমরা মনে করি, বেসরকারিভাবে পরিচালিত হলেও এই দিবসের গুরুত্ব কম নয়। বিশেষ করে ‘নদীমাতৃক’ বাংলাদেশে এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
আমরা জানি, বাংলাদেশের নদীগুলো নানামুখী সংকটের মুখে। দখল, দূষণ, ভাঙন ও প্রবাহস্বল্পতা এর অন্যতম। বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক অ্যাঞ্জেলো নদী দিবসের মধ্য দিয়ে নদীর উদযাপনকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। আমরা যদি উদযাপন করতে চাই, তাহলে প্রবহমান নদীর বিকল্প নেই। সেদিক থেকে এ বছর নির্ধারিত প্রতিপাদ্য যথার্থ।
বিশ্বব্যাপী নদী দিবস পালনের প্রাক্কালে মার্ক অ্যাঞ্জেলো এক ই-মেইল বার্তায় বলেছেন, ‘বিশ্ব নদী দিবস পালন হচ্ছে নদীর সারা পৃথিবীর পানি প্রবাহগুলোকে গুরুত্ব সহকারে মূল্যায়ন করা, তাদের সম্মানসূচক উদযাপন করা, এই দিনটিতে নদীর বহুমুখী গুরুত্ব তুলে ধরা, নদীর জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা ও নদীর জন্য অধিক অভিভাবকত্ব নিশ্চিত করার দিন। সারাবিশ্বেই নদীকে সুসংগঠিত হুমকির মোকাবেলা করতে হয়। অতএব, একমাত্র আমাদের (নদী কর্মীদের) নদী রক্ষার কাজে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়েই সতেজ নদী নিশ্চিত হতে পারে।’
এটি সুবিদিত যে, নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলো আজ নানামুখী অত্যাচারে চরম বিপর্যয়ের শিকার। যেন নদীর জন্য এ দেশে কেউ নেই। বরং নদী নিয়ে ব্যবসা করা, নদী দখল ও হত্যা করে তা থেকে আর্থিক ফায়দা লোটা, অপ্রয়োজনীয়, বিজ্ঞানবিরোধী, ভুল ও ধ্বংসাত্মক নীতি গ্রহণ করে ও প্রকল্প বানিয়ে তার সুবিধা ভোগ করা হয়েছে। মৃত নদীর ওপর সোৎসাহে বাড়িঘর নির্মাণ চলছে। ফলে বাংলাদেশের অনেক নদী ইতিমধ্যেই দখল-দূষণ ও প্রকল্পজনিত কারণে বিনষ্ট হয়েছে, এমনকি কোথাও কোথাও নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
নদীর পলিমাটি দিয়ে যেহেতু আমাদের এ দেশের জন্ম হয়েছে, মায়ের মতোই প্রতিদিন নদী এ দেশের ভূমি-প্রকৃতি, গাছপালা-তৃণ-গুল্ক্ম, পশু-পাখি, পোকা-মাকড় এক কথায় সবকিছুকে প্রতিপালন করছে। নদী আমাদের ব্যক্তিগত, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য-উম্নয়ন-চলাচল-পরিবহন-অর্থনীতি-রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য-গান-সংস্কৃতির মূল চালিকাশক্তি। তাই নদী যদি বিনষ্ট হয়, তাহলে আমরাও ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে ধাবিত হবো। সারাবিশ্বের সব দেশই নদীর অভাবে বিপদাপম্ন হবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশ আরও বেশি হবে।
আমরা মনে করি, নদী সংকটের একটি যুগ-সন্ধিক্ষণে আমরা অবস্থান করছি। এখনও ঘুরে দাঁড়ালে নদী রক্ষা কিছুটা হলেও হতে পারে। মানুষ তার নদী রক্ষা করতে চায়; রাজনীতিবিদ ও সরকার নদী রক্ষায় প্রত্যয় ঘোষণা করেন, উচ্চ আদালত পরিস্কারভাবে নদী রক্ষার সিদ্ধান্ত ও প্রক্রিয়া ঘোষণা করেন, নদী টাস্কফোর্স ও নদী কমিশন গঠিত হয়; কিন্তু নদী রক্ষা হয় না। বেসরকারি সংগঠনগুলো সরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে সার্বিক সহযোগিতা দেয়, অনেক সভা হয়; কিন্তু নদী উদ্ধার হয় না।
অতএব নদী রক্ষা করতে চাই- এটি বাংলাদেশের জন্য কোনো মামুলি বিষয় নয় বা কথার কথা নয়। নদী রক্ষা আমাদের বেঁচে থাকার ও ভালো থাকার প্রধান চাবিকাঠি। অতএব, নদী রক্ষার কাজ আমাদের সাময়িক কোনো কাজ নয়, প্রতিদিনের কাজ ও অবশ্যকরণীয়।
এই প্রেক্ষাপটে ‘নদীর জন্য পদযাত্রা‘ নদী রক্ষায় তাগিদের জন্য আমাদের নতুন ও সম্মিলিত কর্মসূচি। আমরা আশা করি, বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে ‘দখল-দূষণমুক্ত প্রবহমান নদী; বাঁচবে প্রাণ ও প্রকৃতি’ প্রতিপাদ্য ধারণ করে যে পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হলো, তার তাৎপর্য এতে অংশগ্রহণকারী সব সংগঠনের সাংবৎসরিক কর্মসূচিতে প্রতিফলিত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, নদীর জন্য পদযাত্রা বিশ্ব নদী দিবস পালনের পরিসর এবং সার্বিকভাবে নদী রক্ষার আন্দোলন আরও বেগবান করবে। প্রাণ ফিরে পাবে আমাদের প্রাণ প্রবাহগুলো। বিশ্ব নদী দিবস সফল হোক।
লেখকবৃন্দ বাংলাদেশে নদী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত । সূত্র: সমকাল,প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ।।