যে নদীকে কেবল ভাসিয়ে দেওয়া গেল ।। সুপ্রতিম কর্মকার

সুপ্রতিম
লেখা শব্দগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। নৌকার খোলের মত করে। জলের ওপর বা পানির ওপর। ঠিক এখনো জানি না, জলের ওপর পানি! না পানির ওপর জল! শুধু এটাই জানি, ওই দুটো গ্যাসীয় পদার্থ একে অন্যের সঙ্গে মিলে মিশে তৈরি করে একটা তরল পদার্থ। জীবন বাঁচাতে ঐ রঙহীন তরলের মতন আর বিকল্প তরলের জন্ম হল না, এই বিশ্ব চরাচরে। আর সেই না হওয়ার কারণেই জলের মতন সহজ আর জলের মত দামীও কেউ হল না।
জীবনকে প্রজাপতির মত রঙ্গিন দেখতেই পছন্দ করে সবাই। কিন্তু জল তার কোন রঙ নেই। কোন গন্ধ নেই। কোন স্বাদ নেই। কোন গড়ন নেই। আছে শুধু, হ্যাঁ শুধু অস্তিত্ব টুকু। এই বেরঙ্গিন জীবন নিয়ে এতো উদার ভাবে বাঁচা যায়! সত্যি বলো, বাঁচা যায় সে ভাবে? আমার কাছে উত্তর নেই। এই উত্তরটা খুব দরকার। দরকার একটা লেখার জন্য। ‘আমরা প্রিয় নদী’-র জন্য।
জলের ধারায় মালিক কে? এই ধরুন মেঘ। মেঘ মানে তো ‘মেঘ বালিকা’। এমন কথা শুনে মেঘ বালিকার কী রাগ। গাল ফুলিয়ে, মাথা নাড়িয়ে বলল এখন আমায় মেঘ বলো না। এখন পুরো বর্ষা চলছে। তাই সবাই আমায় ‘বৃষ্টি বলে ডাকে’। সূর্যের বুকের  তাপ নিয়ে জলের বাষ্প হয়ে ওঠা। সেই জলকে ধুলোর সঙ্গে মাখিয়ে নিয়ে মেঘ হিসেবে বুকে আগলে ধরা। আর পারি না। রেহাই চাইছি। মেঘ বলল। এই কথা গুলোই মেঘ বলল। সঙ্গে সঙ্গে এক পশলা বৃষ্টি নামল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল।
বৃষ্টির ধারা গড়িতে এলো চোখের কোনে। তারপর গাল বেয়ে চোয়ালের ধারে। সেখান থেকে লাফ দিয়ে পড়ল মাটিতে। মাটির কনাগুলোকে ধাক্কা মারতে মারতে গড়িয়ে পড়ল একটা জলের ধারায়। যে ধারায় তার মত আরো অনেক বৃষ্টি এসে মিশছে। কেউ আসছে মাটির ঢাল বেয়ে, কেউ আসছে পথের আল বেয়ে। যে ধারায় সব বৃষ্টি এসে মেশে, তাকেই সবাই নদী বলে।আচ্ছা বৃষ্টি কেন আসে? নদী নাকি আমার জন্য?
অনেক পরে বুঝেছি, বৃষ্টি আসে আমার জন্য নয়। বৃষ্টি আসে নদীর জন্য। আমি শুনেছিলাম। না শুধু শুনিনি, পড়েওছিলাম। হুমায়ুন আহমেদের লেখা। তিনি লিখেছিলেন তাঁর একটা নদী আছে। আসলে নদীটা সত্যি থাকার মতই একটা জিনিস। দুর্গ শহরটা ছত্রিশগড় রাজ্যের মধ্যে পড়ে। এই শহরের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছিল একটা নদী। এই নদীটার নাম ছিল শিবনাথ। স্থানীয় মানুষেরা নিজের মনে করে নদীটাকে একটা ডাকনাম দিয়েছিল। শেও। বা অনেকে বলত শেওনাথ।
নদীটার নাম শিবনাথ : ছবি- সুপ্রতিম কর্মকার, কলকাতা
একদিন কৈলাস সোনি নামের একজন মানুষ নদীটার দখল করে নিল। নদীটার লিজ নিয়ে নিল,৯৯ টা বছরের। সোনিজীর কারখানার জন্য জল লাগবে।তাই আস্ত একটা নদী সে কিনে নিল। এই নদীটা ছিল মহানদীর একটা শাখানদী।দৈর্ঘে নদীটা ছিল ২৯০ কিলোমিটার। বিলাশপুর শহরের কাছে খরগানি নদীতে এসে মিশত এই শিবনাথ। কাঁটাতারের বেড়া তোলা হয়েছিল নদীটার দুপাশ দিয়ে। যাতে এক বিন্দু জল কেউ যেন নিয়ে না পারে। নদীকে পাহাড়া দেওয়ার জন্য ছিল প্রহরী। যাদের চোখে ঘুম ছিল না। যাদের চোখের পাতা বাতাসেও নড়ত না।
আশেপাশের মানুষগুলো যারা রোজ নদীকে ভালোবেসে বড় হল, তারা কিন্তু তাদের ভালবাসার এক টুকরো দাম পেল না। নদীটাকে কেনার পর কৈলাস সোনী জীও বলেছিলেন, তাঁর শিবনাথ নদীটা আছে। এক লেখকের কাছেও নদী আছে আবার এক শিল্পপতির কাছেও নদী আছে। এই নদী যাপনের মধ্যে শব্দগত মিল থাকলেও অন্তহীন অমিল ছিল লক্ষ যোজন।
এমন কিছু দেখেই প্রিয় শব্দটাকে বড় ভয় পাই। একটা ‘ভালবাসা’ মেশা অন্তলীন স্রোত এই প্রিয় শব্দের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায়, ফল্গু ধারার মতন করে, সঙ্গোপনে। এক আদৃশ্য জিনিস এই ভালবাসা। যা চোখে না দেখেও অনুভবে ধরা পড়ে। তাই প্রিয় হলে, তাকে হারালে মন ভাঙে। ভাঙে সম্পর্কের টানা পোড়েন, তাঁত শিল্পীর মতন। টানা সুতো আর পোড়েন সুতোয় মিলে তৈরি করে একটা লম্বা বারো হাতের শাড়ি। এই সুতোর টানাটানিতে একটু অমিল হলেই নষ্ট হয় শাড়ির গুন। প্রিয় নদীকে কেও আঘাত করলেও সেই শাড়ির মত কিছু খুঁত তৈরি হয় নদীর শরীরে। তবু মানুষ বোঝে না। আসলে ঐ মানুষের দলে আমিও দাঁড়িয়ে আছি।আমার দাঁড়াবার জায়গাটিতে ধর্মের ষাঁড়ের মতন গুঁতোতে থাকে উন্নয়েনের ষাঁড়। যার ক্ষমতার মানদণ্ড সেনসেক্সের পয়েন্ট।
তবু আমার প্রিয় নদীটার নাম করতে পারি না। আমার প্রিয় নদীটা আমার কাছের প্রিয় মানুষের মত। তাই হারানোর ভয়ে আমার প্রিয় নদীটাকে গোপনে বুকে আগলে রাখলাম। এক গভীর অন্ধকার ভেঙে আলো ফুটল। আমার প্রিয় নদীটা আমার বুক থেকে বেরিয়ে ছুটল তেপান্তর পেরিয়ে সাত সাগরের নীল জলের মাঠে।
লেখক : সুপ্রতিম কর্মকার, বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, গবেষণা পত্রের লেখক ও নানা সম্মানে ভূষিত।কলকাতা, ভারত।

আরও পড়তে পারেন…..

সে এক মায়াবী নদী ।। সৈয়দ কামরুল হাসান
নদীর আঁচল ।। আলিফ আলম 
প্রাণের দোসর কালীগঙ্গা ।। সন্তোষ কুমার শীল

সংশ্লিষ্ট বিষয়