আড়িয়াল খাঁ নদ- স্মৃতি ও বাস্তবতায় ।। হাসান মাহবুব

আড়িয়াল

জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে যে নদীর কাছে, নদীর নাম মনে এলে যে ছবিটা ভেসে ওঠে প্রথমে, সে আমার শৈশবে একদিন হাঁটতে হাঁটতে নিজ থেকে খুঁজে পাওয়া নানাবাড়ির কাছের নদীটা। অনেকটা শীত বসন্ত গ্রীষ্মে প্রকৃতি বদলেছে তার রূপ, নদীটাও সেই সাথে তাল মিলিয়ে নানাভাবে দেখিয়েছে তার যৌবনদৃপ্ত খেলা, কখনো ম্রিয়মান হয়ে নিরবে বয়ে গেছে, বুক পেতে জায়গা করে দিয়েছে অনেক স্মৃতির, জন্ম দিয়েছে নানান বাস্তব-অবাস্তব গল্পের।

যে নদীর কথা বলছি সেটা ঠিক নদী নয়, নদ, আড়িয়াল খাঁ নদ। সাধারনত প্রাত্যহিক নানা প্রসঙ্গে এর কথা এলে- নদী বলেই ডাকা হয়। যাইহোক, এই নদ আমাকে টানে, আমার মতো শত সহস্র মানুষকে টানে, পাশে থেকে প্রয়োজন মেটায়, প্রশান্তি দেয়!

আড়িয়াল খাঁ নদকে ঘিরে গল্পের আগে এর জন্মকথা বলতে হয়। এটি পদ্মা নদীর একটি প্রধান শাখা নদ যা ফরিদপুর, মাদারীপুর হয়ে দীর্ঘ ১৫৫ কি.মি. পথ পাড়ি দিয়ে বরিশাল জেলায় শেষ হয়েছে। এর অতীত নাম ছিল ভুবনেশ্বর। যতদুর জানা যায় ১৮০১ সালে ‘ঠগি (বিশেষ এক ধরণের দস্যুদল যারা পথিকদের গলায় রুমাল বা কাপড় পেঁচিয়ে হত্যা করতো ও মালামাল লুন্ঠন করতো) দমনের জন্য তৎকালীন সরকারের নির্দেশে আড়িয়াল খাঁ নামক একজন জমাদার নিযুক্ত করা হয়। কোন এক সময় ভুবনেশ্বর নদ থেকে একটি খাল খনন করে এটি প্রাচীন পদ্মার দক্ষিণাংশের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। এই খালটিই পরবর্তীকালে প্রবল রূপ ধারণ করে প্রাচীন পদ্মা ও ভুবনেশ্বরের কিছু অংশ গ্রাস করে ও সাধারণ মানুষের কাছে যা আড়িয়াল খাঁ নদ নামে পরিচিত হয়।

এই তো গেল চমকপ্রদ নদ পরিচিতি, জীবনের সাথে এর সংযোগ কম চমকপ্রদ নয়। এই নদের দুই পাড়ের জীবনযাত্রায় যেমন এর অবদান অনস্বীকার্য, এক সময়ের প্রবল প্রমত্ত রূপ কাদিঁয়েছেও অনেক। ঢেউ ও স্রোতই নদীর প্রান। শৈশবে তেমই দেখেছি। তখনো ইঞ্জিন নৌকা বলতে হয় তেমন আসেনি। বিশাল বিশাল ছইওয়ালা নৌকা, রঙ- বেরঙের পাল, পরিশ্রমী মাঝি-মাল্লার পরিশ্রমী শরীর, নদীকে ঘিরে তাদের জীবন ও জীবিকা, উচ্ছলতা হাসি কান্না চোখে পড়তো।

মাদারীপুর সদরে হযরত শাহ্ মাদার দরগাহ শরীফ, যার নামে মাদারীপুর জেলার নামকরণ, মসজিদের পূর্ব পাশ দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে নদীর কাছে যাওয়া যেতো। সে সময় নদীটা অনেক দুরে ছিলো। বেশ খানিকটা হেঁটে নদীর পাড়ে পৌঁছতে হতো। মসজিদের উল্টোদিকে একটু উত্তরে শ্মশান, তারপাশেই শুনশান গোরস্থান, মাঝে কিছু ঘরবাড়ি রেখে এগিয়ে গেলে মাদারীপুর লঞ্চঘাট। এখান থেকে একসময় নিয়মিত কম খরচে শরীয়তপুরের ডামুড্যা, গোসাইরহাট ভেদরগঞ্জ উপজেলায় যাওয়ার ছোট ছোট লঞ্চ ছেড়ে যেতো। ঢাকা যাওয়ার লঞ্চ সারি সারি ভাবে লঞ্চঘাটে বাঁধা থাকতো। এসব এখন অতীত, নতুনদের কাছে গল্পের মতো অনেকটা। আমার ছোট বেলার ছোট চোখ দিয়ে বিস্ময়ভরে দেখে নিয়েছি নদী কেমন হয়, অনুভব করেছি কী এর সৌন্দর্য, টের পেয়েছি এক অদৃশ্য টান।

আড়িয়াল খাঁ নদ। ছবি- হাসান মাহবুব

এরপর ধীরে ধীরে অনেকটা সময় পেরিয়েছে, আড়িয়াল খাঁ নদে ইঞ্জিন নৌকার দাপট বেড়েছে, একে ঘিরে মানুষের প্রয়োজন বহুগুন বেড়েছে কিন্তু নদীর প্রাণ কমে গেছে। ততদিনে ‘শহরায়নের’ প্রয়োজনে বালির ব্যবসা, ইটের স্তুপ, পাথর ভাঙার মেশিন আরো কতো কী এক সময়কার চোখজুড়ানো স্মৃতিময় নদের পাড় দখল করে নিয়েছে। ড্রেজিং এর বালি বিরাট বিরাট গর্ত করে জমা করা হতো এবং পরে সেগুলো ঠ্যালাগাড়ি, পা-চালিত ভ্যানে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়। এ যেন ভাঙনকে উসকে দেয়া! এই নদ এখন দরগাহ শরীফ মসজিদের খুব কাছে, ২৫/৩০ গজের মধ্যে এসে গেছে অথচ যা একসময় আমি দেখেছি সেখান থেকে প্রায় ৯০/১০০ গজ দুরে। ভাঙন, নদীর শক্তি ও যৌবন যেমন দেখিয়েছে তেমনি তৈরী করেছে অনেক ইতিহাস, সুখ-দুঃখের গল্প।

এ সময়ে নদীর রূপ অনেক অনেক বদলে গেছে। শহর রক্ষা বাঁধ আড়িয়াল খাঁ-র পাড় ধরে চলে গেছে বেশ কয়েক কিলোমিটার। পাড়ে হাঁটার পথ তৈরী করা হয়েছে, সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে। কিন্তু নদের প্রান যেন খানিকটা কমে গেছে (কেউ হয়তো বলবে নদ এখন নতুন রূপে সেজেছে)। ব্যস্ততম এই জীবনে খুব কমই এখন নদের কাছে যাওয়া হয়। কখনো গেলে আমার দু’টি মেয়ে, তাম্মি ও তোয়া,-র জন্য যাওয়া হয়। ওরা বিমোহিত হয়। ছোট চোখ দিয়ে এই নদকে দেখে, নদের পাড়ের জীবন দেখে। এটাই ওদের কাছে নতুন, এটাই যেন নদের আদর্শ রূপ! ওদের নিয়ে হাঁটি, সময় কাটাই, সুখ খুঁজি, নদের পাড়ের গোরস্থান কখনো চোখ আর্দ্র করে কেননা এখানে আমার বাবার কবর!
নদ বা নদীর কোন আবেগ থাকে না, আমাদের আবেগী দৃষ্টি একে নানান ভাবে দেখে, কখনো এর ভিতর ব্যাখ্যাতীত এক প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার প্রয়াসী হয়। আসলে এর নিজের প্রাণ নয়, নদীকে ঘিরে দু’পাড়ের জীবন ও জীবিকা নদীতে স্পন্দন আনে অপ্রমাণিত এক প্রানের সঞ্চার করে। আমিও সেভাবে ভাবি, নদীর কাছে থাকি, গল্প করি। নদীটা যদিও আমার ব্যক্তিগত কোন সম্পদ নয়। তবুও গোপনে গোপনে নদী যেন বলে- ‘আমার কাছে ফিরে ফিরে এসো, বলে যেও যা আছে বলার’।


হাসান মাহবুব : লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।

আরও পড়তে পারেন…

আমাদের ছোটো নদী ।। গৌতম অধিকারী

সংশ্লিষ্ট বিষয়