বিশ্ববরেন্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় শতবর্ষে পদার্পন করলেন। গতকাল ছিল তাঁর জন্মদিন। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র যে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমায় নতুন ভাষার আমদানী করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।পথের পাঁচালী থেকে যে যাত্রাপথের দিকনির্দেশ তিনি করেছেন তা এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
জগত ও বিভিন্ন ধারার সম্পর্কের বিষয়ে কৌতুহল ও নিজস্ব একটা ব্যাখ্যা ছিল তাঁর। সেই ব্যাখ্যান এবং আখ্যান আমরা হয়ে উঠতে দেখি তার সিনেমায়। সত্যজিৎ নদী ভালবাসতেন। তাই তাঁর সিনেমায় নদী নানাবিধ সংকেত দেয়। সময়, সম্পর্ক, পরিস্থিতির একটা দ্যোতনা তৈরি করে।সেসব নিয়েই খন্ডিত ভাবে আলোচনা করবো নিবন্ধে।
সত্যজিৎ নদীর বিষয়টিকে কতটা ভালবাসতেন তার একটা উদাহরণ দিই তাঁর বয়ানে। তিনি লিখছেন: পথের পাঁচালী ছবিতে নদী রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্ত রাখা হয়নি।অথচ বাংলার গ্রামে নদী থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।পাশ দিয়ে নদী চলে গেছে, অপুর সংসার ছবির জন্য এমন একটা গ্রাম চাইছিলাম। কলকাতার লোকেশন বাছাই শেষ হতে আমরা নদীর খোঁজে লেগে যাই। বিস্তর নদী দেখার পর শেষ পর্যন্ত মহেশগঞ্জ গ্রামে জলঙ্গী নদী আমাদের ভাল লেগে যায়…।
চলে আসি অপরাজিত ছবিতে। এই ছবিতে গঙ্গা নদীকে ব্যবহার করা হয়েছে জীবনের সাথে মিলিয়ে। জীবনের প্রাত্যহিকতার সাথে যার সংযোগ নিবিড়। ঘাট থেকে নেওয়া ও নদী থেকে নেওয়া ঘাটের দৃশ্যগুলিতে চোখ রাখলে বোঝা যায় প্রধান যে ঘটনা তার সাথেই অন্যান্য ঘটনাক্রমকে চলমান রেখেই জীবনের যে নিজস্ব গতিময়তা তাকে তুলে ধরা হয়েছে।
একটি দৃশ্য মনে করুন ।গঙ্গার উপর দিয়ে ব্রিজ পার হয়ে ট্রেন যাচ্ছে বারাণসীর দিকে। ট্রেনের ভিতর থেকে দর্শক দেখতে পাচ্ছেন প্রবহমান নদী।ট্রেনের গতির বিপরীতে সরে সরে যাচ্ছে লোহার থাম, ভেসে আসছে গম্ভীর শব্দ আর ক্রমশ এগিয়ে আসছে শহর বারাণসী।ঠিক এই জায়গায় দৃশ্য আর শব্দ মিলেমিশে মনে একটা অজানা ভয়, চিরনতুনের প্রতি কৌতুহল আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে একটা আশা ও আশঙ্কা তৈরি করে।হরিহর গ্রাম ছেড়ে বারাণসীতে এসেছে নতুন ভাবে জীবন গড়ার আশায়।
সেটা সফল হবে নাকি হবে না? পরে আমরা দেখি হরিহরের জীবিকার সবটাই এই নদীর উপর। নদীর একটা নিজস্ব প্রবহমানতা আছে, তার ঠিক পাশেই জীবনেরও যে নিজস্ব প্রবহমানতা তা লক্ষ্য করি আমরা। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনের উত্তরণ ও সঙ্কটের নীরব সাক্ষী হিসাবে থেকে যায় নদী। হরিহরের মৃত্যুও এই সিনেমায় দেখানো হয় এক অনবদ্য সংকেতের মাধ্যমে। ঘাট থেকে একঝাঁক পায়রা ভোরের আকাশে উঠে যাওয়া এবং সঙ্গেই সর্বজয়ার সবকিছু হারিয়ে ফেলার হাহাকার কি সংকেত প্রদান করে না? শবদাহের পর এই নদীকে সাক্ষী রেখেই অপু শোককে টপকে
যাওয়ার সাহস পায়।
অপুর সংসার ছবিতে নদী আরও গভীর ভাবে এসেছে। নদীর যে জলস্রোত এবং তার টান মানুষের ভাগ্যকে পরিচিত জগত থেকে অপরিচিত জগতের দিকে ঠেলে দেয়।নদীর গতিপথ বিচিত্র, জীবনও কি বৈচিত্র্যময় নয়? জলসাঘর ছবিতে নদী একটা ট্র্যাজিক সুর তৈরি করে।দেবী সিনেমায় নদী ব্যবহৃত হয়েছে নির্দিষ্ট শিল্প চেতনায়।তিনকন্যাতে অবশ্য পোস্টমাস্টার পর্বে নদী আসে ঘুরপথে। চলে আসি গুপী গাইন বাঘা বাইন সিনেমায়।নদীর ওপারে সূর্যোদয়ের অবাক করা অনুভূতি গুপীর কন্ঠে যেন সুর এনে দেয়।বাঘার হাতে অনবদ্য বোল।জীবনের কাছে অপমানিত দুজনের অসামান্য উত্তরণের নীরব সাক্ষী হয়ে এখানেও থেকে যায় নদী।
অরণ্যের দিনরাত্রি ছবিতে শুষ্ক পাহাড়ী নদী বিভিন্ন দৃশ্যে ফিরে ফিরে আসে। এই ছবিতে নদীকে একটা মোটিফের মতো ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ।
অশনি সংকেত সিনেমায় স্বচ্ছন্দ গ্রামজীবনকে যেন ঘিরে থাকে নদী। জয় বাবা ফেলুনাথ, জন অরন্য ছবিতেও নদী এসেছে যেন অবধারিত ভাবে।
আসলে নদী আমাদের নানাভাবে পুষ্ট করে। আমাদের দুঃখ ও আনন্দ, হতাশা ও উত্তরণ, মন খারাপ ও ভাল লাগার পরিসর খুঁজে পাই নদীর মধ্যে।নদী নির্জন মানুষের মনের সাথী।আসলে নদী মানুষের মুক্তির জায়গা।সত্যজিৎ সেসব গভীর ভাবেই অনুভব করেছিলেন।তাই তার সিনেমায় নদী এসেছে সেভাবেই।আসুন সেভাবে আমরাও অনুভব করি। হে, মহান চলচ্চিত্র ও জীবন বোধের নির্মাতা।তোমাকে শতকোটি প্রণাম।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: সত্যজিতের ছবি ও খেরোর খাতা- সুনীত সেনগুপ্ত।