তিনি ছিলেন নদীর সন্তান 

সন্তান 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ তাঁর জন্মদিন। আজ আরও একবার অনুভব করলাম প্রবল ভাবে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই নদীর সন্তান। তাই লেখার তাগিদ অনুভব করলাম।যদিও এটা খন্ডাংশ বলাই শ্রেয়।

নদীর সন্তান না হলে কেউ এভাবে নদীকে তাঁর চিন্তা- চেতনা-ভাবনা- লেখায় জড়িয়ে নিতে পারেন?!  অথচ কি আশ্চর্য! তাঁর জীবনের প্রথম ভাগে নদীর সাথে তার সংযোগ আমরা সেই অর্থে পাইনা। নদী প্রবাহিত হয় সর্পিল গতিতে, আঁকাবাঁকা পথে। আমাদের জীবনের পথও কি তেমন নয়? বিচিত্র সব ইতিহাস যেন লুকিয়ে আছে নদীর সব বাঁকে বাঁকে। একটু যদি দৃষ্টি প্রসারিত করি তাহলে দেখবো যে দুই বাংলার প্রতিটি নদীর বাঁকে বাঁকে আছে মানুষের জীবনের নানান ঘটনাবলী।

মানুষের দুঃখ, আনন্দ, হাসি, কান্নার রেণু যেন লেগে আছে নদীর গায়ে। মনে রাখতে হবে রবীন্দ্রনাথ যখন বাবার কাছ থেকে জমিদারী দেখার দায়িত্ব পান 1890 সালে তখন তার বয়স ত্রিশের গোড়ায়। ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি জমিদারী দেখাশোনা করার জন্য শিলাইদহ, শাহজাদপুর আর পতিসরের মধ্যে অসংখ্যবার যাতায়াত করেছেন। আর এই যাতায়াতে তার প্রধান সঙ্গী ছিল বোট। খেয়াল রাখতে হবে বোটের নাম ছিল পদ্মা।

তাঁর শিলাইদহের কুঠিবাড়ির দেওয়ালটি ছিল ঢেউ খেলানো। কাছ দিয়ে বয়ে গিয়েছে পদ্মা। আমরা অনুমান করে নিতে পারি পদ্মার ঢেউয়ের রূপক হিসাবেই এটি নির্মিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের রচনায় বারবার ফিরে এসেছে পদ্মা।এছাড়াও অন্য যে নদীগুলি এসেছে তার লেখায়, পত্রাবলীতে সেগুলো হল গঙ্গা, বড়াল, আত্রাই, নাগর, গড়াই, ইছামতি, যমুনা, গোহালা ইত্যাদি।

রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকতে তার লেখা 151 টি চিঠির সংকলন হিসাবে 1912 সালে প্রকাশিত হয়েছিল ছিন্নপত্র। সেখানকার প্রায় চিঠিতেই বাংলার উত্তরাংশের নদীগুলির উল্লেখ আছে। রবীন্দ্র ভাবনায় ও লেখাই নদীর স্থান উপরে এবং বিশেষ ভাবে। নদীর জলে ছেলেরা মাছ ধরছে, মাছরাঙা পাখি হঠাৎ করেই নদীর জলে লাফিয়ে পড়ছে,পালতোলা নৌকা, নৌকায় মাঝিদের হাঁকাহাঁকি, নদীর ঘাটে স্নানে ব্যস্ত নারী, নদীর জলে শিশুদের হুটোপুটি, নদী পার্শ্ববর্তী নিসর্গ, নদীর বন্যার জলে প্লাবিত বাংলার গ্রাম এসব যেন উঠে এসেছে অবলীলায়, অনিবার্য ভাবে।

1851 সালে রবীন্দ্রনাথ নওগাঁর পতিসর থেকে যে চিঠি লিখেছিলেন সেখানে করতোয়ার সংযুক্ত শাখা নাগর নদের কথা আছে।বর্ননাটি এরকম-

“ছোট নদীটি ঈষৎ বেঁকে এইখানে একটুখানি কোণেরর মতো, একটু কোলের মতো তৈরি করেছে – নৌকা ওয়ালারা উত্তর দিক থেকে গুণ টেনে টেনে আসে, হঠাৎ একটা বাঁক ফিরেই এই জনহীন মাঠের ধারে অকারণে একটা মস্ত বোট বাঁধা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। লজ্জাশীলা বধূ দুই আঙুলে ঘোমটা ঈষৎ ফাঁক করে ধরে কলসী কাঁখে জমিদার বাবুকে সকৌতুকে নিরীক্ষণ করছে, তার হাঁটুর কাছে আঁচল ধরে একটি সদ্যস্নাত তৈল চিক্কণ বিবস্ত্র শিশুও একদৃষ্টে বর্তমান পত্রলেখক সম্বন্ধে কৌতুহল নিবৃত্তি করছে-তীরে কতকগুলো নৌকা বাঁধা এবং একটা পরিত্যক্ত প্রাচীন জেলে ডিঙি অর্ধ নিমগ্ন অবস্থায় পুনরুদ্ধারের প্রতীক্ষা করছে ।তারপরে আবার অনেকটা দূর শস্য শৃন্য মাঠ মাঝে মাঝে কেবল দুই একজন রাখাল শিশুকে দেখতে পাওয়া যায় এবং দুটো একটা গোরু নদীর ঢালু তটের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এসে সরস তৃণ অন্বেষণ করছে দেখা যায়।এখানকার দুপুরবেলার মতো এমন নির্জনতা নিস্তব্ধতা আর কোথাও নেই।”

উপরের নাগর নদী সম্পর্কে লেখাটি থেকে কি বোঝা যাচ্ছে ! নদীকে অন্তরে ধারণ না করলে তাকে কেন্দ্রে রেখে এমন বর্ননা দেওয়া যায়?! হ্যাঁ, সরাসরি নদী দূষণ, নদী দখল ইত্যাদি নিয়ে সরাসরি অভিঘাত সৃষ্টিকারী নদীর লেখা হয়তো তাঁর নেই কিন্ত তার লেখায় ও মননে নদীকে ভালবাসার চিহ্ন পরতে পরতে আছে।পদ্মা নিয়ে, আত্রাই, ইছামতি নিয়ে পরবর্তীতে কোপাই, চূর্ণী নিয়ে বারবার লিখেছেন।

ছিন্নপত্র, ছিন্নপত্রাবলী, গল্প, কবিতা, উপন্যাসে অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। মানুষের জীবনের সাথে নদীর একটা আত্মিক সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিলেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি যথার্থই নদীর সন্তান। তাঁর জন্মদিনে আনত প্রণাম ও নদীমাতৃক সবুজ অভিবাদন জানাই একজন অতি ক্ষুদ্র নদী ও পরিবেশ কর্মী হিসাবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার- এক) ছিন্নপত্রাবলী : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই) ছিন্নপত্র’র নদী: মাহবুব সিদ্দিকী

আরও পড়তে পারেন….

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় নদী সংকেত দেয় 

বরাকের স্মৃতির ঊর্মি : মো. আজাদ বারী শিপু 

সংশ্লিষ্ট বিষয়