।। রিভার বাংলা ডট কম ।।
দ্বিতীয়বার সন্ধ্যা নদী দেখেছিলাম প্রয়াত সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, আমাদের প্রিয় সারওয়ার ভাইয়ের চোখে। তার জন্মদিনে, এপ্রিলের প্রথম দিন, সমকালেই আয়োজিত ঘরোয়া আয়োজনে সহকর্মীরা দু-এক মিনিটের আধা-আনুষ্ঠানিক শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকি। সর্বশেষ জন্মদিনে ‘নদীময় শুভেচ্ছা’ জানিয়ে বললাম, যদি কখনও সময়-সুযোগ হয়, তাকে নিয়ে সন্ধ্যা নদী দেখতে যেতে চাই। তিনি হেসেছিলেন। আমি নিশ্চিত, আমাদের মধ্যে আরও কিছুদিন থাকলে নিয়েও যেতেন। তবে জন্মদিনের জনাকীর্ণ সেই অনুষ্ঠানে তার চোখে সন্ধ্যার ঝিলিক প্রথম দেখেছিলাম, এমন নয়।
সন্ধ্যা নদী প্রথম যখন দেখি, তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব যায়নি। সরকারের জাটকা রক্ষা কর্মসূচির মূল্যায়নমূলক একটি কাজে কনিষ্ঠ গবেষক হিসেবে বরিশালের হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জে মেঘনা চষে বেড়াচ্ছি। প্রায় দিন-রাতের পরিশ্রম, নদীতে-নদীতে, চরে-চরে। পারিশ্রমিক হিসেবে গো ধরলাম ঢাকায় ফেরার পথে বরিশালে একদিন বিরতি দিতেই হবে। উদ্দেশ্য আর কিছু নয়; নদীর ঘ্রাণমাখা কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ি দেখব। দর্শন করব তার প্রিয় ধানসিঁড়ি নদী।
বরিশাল শহর থেকে সড়কপথে ধানসিঁড়ি যাওয়ার পথে পড়েছিল গাবখান সেতু। নিচ দিয়ে বয়ে গেছে গাবখান চ্যানেল। অনেকে আদর করে বলেন, ‘বাংলার সুয়েজ’। ব্রিটিশরা এই বৃহৎ ‘খাল’ সংস্কার বা খনন করেছিল ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে মংলা বন্দরের দূরত্ব কমিয়ে আনতে। সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীর এই সংযোগ খাল এখন নিজেই একটি মাঝারি নদী। আমরা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে মালবাহী মাঝারি নৌযানের যাতায়াত দেখছিলাম। রীতিমতো মুগ্ধ।
তখনও গুগল, ইউকিপিডিয়া সহজলভ্য হয়নি। মোটরসাইকেল সজ্জিত সহযাত্রীর কাছে জানতে চাই, গাবখান কোথা থেকে এসেছে। তিনি বলেন, সন্ধ্যা নদী। আহা, নাম শুনেই মন জুড়িয়ে যায়। এখানকার নদীগুলোর নাম এত সুন্দর কেন! সন্ধ্যা, সুগন্ধা, ধানসিঁড়ি! সন্ধ্যা নদী দেখতে যাওয়া যায় না? তিনি সম্মতি দিলে আমরা গাবখানের সমান্তরালে ঝালকাঠি-শেখেরহাট সড়ক ধরি। তখনও খুব সম্ভবত কাঁচা। সন্ধ্যা নদীর তীরে আমড়াজুড়ি ফেরিঘাটে যখন পৌঁছি, ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্ন। ছায়াঘন এক নদী মন্দমন্থরে বয়ে চলেছে। তির্যক রোদের সঙ্গে খেলা করছে ঘোলাজল। সঙ্গে ফিল্মভরা সস্তা ম্যানুয়েল ক্যামেরা। যত্রতত্র ছবি তোলার সুযোগ নেই। যে কয়টি ‘ক্লিক’ বাকি, তা ধানসিঁড়ির জন্য বরাদ্দ। জীবনানন্দের কাছে সন্ধ্যা যেন হার মানে। কিন্তু নদীটি চোখে লেগে থাকে।
সন্ধ্যার সেই অপরাহ্ন চোখে লেগে ছিল বেশ কয়েক বছর পর রিভারাইন পিপলের মুখপত্র ‘নদী’র দ্বিতীয় সংখ্যার প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও। জানতাম সারওয়ার ভাইয়ের বাড়ি সন্ধ্যার তীরে। তাকে গিয়ে বলি শৈশবের নদী নিয়ে লেখার জন্য। তিনি প্রথমে সময়ের অভাবের কথা বলছিলেন। নদী নিয়ে স্মৃতিকথা লেখার প্রস্তাবে ‘নিউজম্যান’ একটু বিরক্তও যেন। মনে করিয়ে দেই যে, সন্ধ্যা নদী তো তার প্রিয়। তিনি হঠাৎই আনমনা হয়ে যান। তার চোখে যেন নেমে আসে সন্ধ্যার ছায়া। বলেন, ঠিক আছে, সময় করতে পারলে লিখবেন। রাশভারি সম্পাদককে দু-একবারের বেশি তাগাদা দেওয়ার সাহসও নেই। সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন দুপুরের পর ডেকে বললেন, এই নাও তোমার লেখা। কয়েক পৃষ্ঠা হলুদ নিউজ প্যাডে সেই ট্রেডমার্ক হস্তাক্ষর। শিরোনাম ‘সন্ধ্যা আমার ভালোবাসা’।
‘নদী’ দ্বিতীয় সংখ্যায় (মার্চ ২০১১) গোলাম সারওয়ার লিখলেন- “নদী বলতেই আমার বাল্য ও কিশোরবেলার অন্তরজুড়ে থাকা ‘সন্ধ্যা’- সন্ধ্যা নদী। পুরো পঞ্চম দশকজুড়ে, ষাটের দশকের সূচনাকাল অবধি সন্ধ্যা আমাকে নানাভাবে প্রভাবিত ও আলোড়িত করেছে। দুরন্ত বেগে ছুটে চলা সন্ধ্যা নদী ও নামহীন ছোট আরেকটি নদীর ঠিক মোহনায় আমাদের বাড়ি- মোল্লাবাড়ি।
মেঘনাকন্যা সন্ধ্যা একূল-ওকূল ভাঙতে ভাঙতে দুরন্ত বেগে চলতে চলতে বহু বিখ্যাত গ্রাম-জনপদ স্পর্শ করে ‘কচা’ নামে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে। একেবারে পঞ্চাশ দশকের শেষে আমার বয়স যখন বারো-তেরো তখনও ঢাকা থেকে হুলারহাট অবধি ঘুমভাঙানিয়া ভেঁপু বাজিয়ে জাহাজ ছুটে যেত। বিশাল জাহাজ, তার লাল-নীল আলো দেখার জন্য প্রায়ই শেষ রাতে সন্ধ্যার তীরে এসে বসতাম।”
সন্ধ্যার তৃতীয় প্রসঙ্গ সমকালেই ‘চারমাত্রা’ সহযোগে। এ বছর আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস উপলক্ষে ‘এখনও সুন্দর সাত নদী’ নিয়ে লিখতে হবে এই সাপ্তাহিক সাময়িকীর জন্য। নদীর পর নদী যোগ-বিয়োগ করতে গিয়ে সন্ধ্যার সেই অপরাহ্ন মাথা থেকে তাড়াতে পারি না। বন্ধু ও সহযোদ্ধা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও আলোকচিত্রী, মোহাম্মদ আব্দুল বাতেনের কাছ থেকে সন্ধ্যা নদীর একটি চমৎকার আলোকচিত্র উপহার পেয়ে আর দ্বিধা থাকে না। আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের এখনও সুন্দর সাত নদীতে অন্তর্ভুক্ত হয় সন্ধ্যা। ‘চারমাত্রা’ প্রকাশ হওয়ার একদিন পর বিভাগীয় সম্পাদক আহমাদ শামীমকে বলি, সারওয়ার ভাইকে বলেছেন যে, এখানে তার শৈশবের নদীও রয়েছে? শামীম বলতে ভুলে গিয়েছিলেন।
পরদিন সকালে সারওয়ার ভাইকে সন্ধ্যার সুন্দর আলোকচিত্রটি দেখাই। তিনি টেবিলে ঝুঁকে বেশ মনোযোগ দিয়ে ছবিটি দেখলেন। বললেন, ‘খুব সুন্দর তুলেছে। তাকে একদিন নিয়ে এসো অফিসে।’ তারপর চেয়ারের পেছনের দিকে হেলান দিয়ে বললেন, ‘বিকেলে তোলা?‘
একটু রিল্যাক্স মুডে আছেন দেখে, আমি আরও কথা বাড়াই। বলি, নদীটি কখন সুন্দর দেখায় তার এখনও মনে আছে! সারওয়ার ভাই বলেন, ‘দেখো, যত বয়স বাড়ে, শৈশবের স্মৃতি তত তাজা হতে থাকে। ১০ বছর আগেও সন্ধ্যা নদীর যেসব স্মৃতি আমার মনে হতো না, এখন স্পষ্ট দেখতে পাই।’
আমি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকি। তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যা নদী সবচেয়ে সুন্দর হয় বিকেল বেলায়।’