।। রিভার বাংলা ডটকম ।।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলাটি পদ্মা নদীর তীব্র ভাঙনের মুখে পড়েছে। এ উপজেলার অনেক স্থাপনা ও শত শত ঘড়বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মানুষের চোখের সামনে একের পর এক বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট পদ্মার পেটে চলে যাচ্ছে। পদ্মা নদীর পানি ও স্রোত গত শুক্রবারও বেড়েছে এবং নড়িয়া উপজেলায় ভাঙন অব্যাহত আছে। শুক্রবার পর্যন্ত ছয় হাজার ১৩০টি পরিবার নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারাল। পদ্মা নদীর চলমান ভাঙনের ফলে উপজেলার মানুষ উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন যাপন করছে। কেদারপুর, কেদারপুর দাসপাড়া ও উত্তর কেদারপুর গ্রামের মানুষ পুরোটা সময় পার করছে ঘরবাড়ি হারানোর আশঙ্কা নিয়ে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীপারের বাসিন্দাদের কাছে নদীভাঙন একটি বড় আতঙ্ক। নদীভাঙনের কারণে অনেক মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়েছে, অনেকে হারিয়েছে সহায়-সম্বল, অনেকে হারিয়েছে জীবন-জীবিকার অবলম্বন। নদীভাঙনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন থেকেই পরিচিত। বর্ষাকালে বাংলাদেশের উজানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। উজানের পানি নেমে এলে নদীগুলোতে পানির তীব্র স্রোত তৈরি হয় এবং স্রোতের তীব্রতার কারণে নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় প্রায় এক হাজার ২০০ কিলোমিটারজুড়ে ভাঙন অব্যাহত আছে এবং আরো ৫০০ কিলোমিটার এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দিতে পারে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেস (সিইজিআইএস) পদ্মা নদীর ভাঙন নিয়ে গবেষণা করছে এবং দীর্ঘদিন থেকে পদ্মার ভাঙন সম্পর্কে পূর্বাভাস দিচ্ছে। সিইজিআইএসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত সাত বছরে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার প্রায় সোয়া ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে ২০১৫ সাল পর্যন্ত পদ্মার ভাঙনের গতি কম থাকলেও তার পর থেকে ভাঙনের মাত্রা বেড়ে গেছে। ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত নড়িয়া উপজেলায় প্রতিবছর গড়ে আধা বর্গকিলোমিটার এলাকা ভাঙনের কবলে পড়ে। কিন্তু ২০১৫-১৬ সময়কালে নদীতে তলিয়ে গেছে প্রায় ১ দশমিক ৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা এবং এ বছর এরই মধ্যে ভেঙেছে দুই বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকা।
বাংলাদেশে প্রতিবছরই বিস্তীর্ণ এলাকা নদীভাঙনের শিকার হয়। নদীভাঙনের কারণে প্রতিবছর ছয় হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ফলে নিজেদের ঘরবাড়ি, ফসলের জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অনেক মানুষ। বাংলাদেশের অনেক নদীরই ভাঙনপ্রবণতা রয়েছে। তবে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকায় ভাঙনের মাত্রা বেশি। গত চার দশকে দেশের বড় এই তিনটি নদীতে বিলীন হয়েছে দেড় লাখ হেক্টরের বেশি জমি।
সিইজিআইএসের তথ্য মতে, যমুনা নদী কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করায় সেখানকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় নদীভাঙন ঘটছে। গাইবান্ধা, জামালপুরসহ পাশের জেলাগুলো সব সময় হুমকির মুখে থাকে। যমুনা নদীর কারণে সিরাজগঞ্জ বেশ কয়েক দশক ধরে ভাঙনপ্রবণ এলাকা। যমুনার করাল গ্রাসে চৌহালী উপজেলা আহত হচ্ছে প্রায় প্রতিবছর। সর্বনাশা নদীভাঙন এ এলাকার অনেক মানুষকে নিঃস্ব করেছে। উপজেলার অনেক স্থাপনা চলে গেছে যমুনার গর্ভে। বাড়িঘর, চাষের জমি, উপার্জনের পথ হারিয়ে চৌহালীর অনেক মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে অন্য এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে। অনেক অবস্থাপন্ন গৃহস্থ সব হারিয়ে দীনহীন মানুষে পরিণত হয়েছে। পদ্মার ভাঙন এখন নিঃস্ব করছে নড়িয়া উপজেলার মানুষকে।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশবিষয়ক গবেষণা সংস্থা নাসার এক গবেষণায় দেখা গেছে, পদ্মা নদীর ভাঙনে গত ৫১ বছরে ৬৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা হারিয়ে গেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬৭ সাল থেকে পদ্মা নদীর ভাঙন শুরু হলেও ১৯৯৮ সালে তা হঠাৎ করে বৃদ্ধি পায়। সে বছর পদ্মার উজানে অবস্থিত ফারাক্কা বাঁধের পানি ভারত ছেড়ে দেওয়ার ফলে পদ্মা নদীতে পানির প্রবাহ অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। সে কারণে বন্যার পাশাপাশি নদীভাঙনও বৃদ্ধি পায়। নাসার বিজ্ঞানীরা স্যাটেলাইটে তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে ১৯৮৮ সাল থেকে পদ্মার আকৃতি ও গতি-প্রকৃতির তুলনা করেছেন। প্রতিবেদন অনুযায়ী তিন দশক ধরেই পদ্মা নদী তুলনামূলকভাবে সোজাসুজি অবস্থান পরিবর্তন করেছে; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মার গতিপথ আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে। নাসার বিজ্ঞানীরা পদ্মার ভাঙনের দুটি কারণও চিহ্নিত করেছেন, যার প্রথমটি হলো নদীর ভাঙন রোধের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো সুরক্ষামূলক ব্যবস্থার অনুপস্থিতি। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পদ্মার দুই পারে বালুচর রয়েছে, যা স্রোতের ধাক্কায় সহজেই ভেঙে যায়।
নদী ও পানি বিশেষজ্ঞরাও ভাঙনের জন্য নড়িয়ার ভূমির গঠন ও পদ্মা নদীর গতি-প্রকৃতিকে দায়ী করছেন। তবে এটি এখন মোটামুটি স্পষ্ট যে পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকার মাটি গঠনের দিক থেকে নরম এবং পদ্মার স্রোতের তীব্রতা বেশি থাকার কারণে পদ্মার ভাঙনের পরিমাণ বেশি। এ ছাড়া পদ্মার ভাঙনের আরেকটি প্রবণতা হচ্ছে, কোনো এলাকায় একবার ভাঙন শুরু হলে প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে সে এলাকায় নদীভাঙন চলার প্রবণতা দেখা যায়।
নড়িয়ায় পদ্মার ভাঙন চলছে সাত বছর ধরে। এত দিন নদীগর্ভে তলিয়েছে কৃষিজমি, তা নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। কিন্তু পতিত বা কৃষিজমি পেরিয়ে এবার ভাঙছে অবকাঠামো, ঘরবাড়ি। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি পরিবার গৃহহীন হচ্ছে। তাই এবার নড়িয়ার নদীভাঙন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নড়িয়ার মাটির গঠন শক্তিশালী নয় এবং এখানকার মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি বলে ঘাতসহন ক্ষমতা কম। ফলে স্রোতের তীব্রতার কাছে ভাঙন রোধের জন্য নেওয়া সাধারণ উদ্যোগগুলো কার্যকর থাকছে না।
গত বছরের ডিসেম্বরে বিশ্বখ্যাত গবেষণা সাময়িকী স্প্রিঙ্গারে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে পদ্মা নদীর ভাঙনের কারণে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তার একটি হিসাব পাওয়া যায়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, পদ্মার ভাঙনের কারণে ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১৪ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির এ পরিমাণ নির্ণয়ে জমি, স্থাপনা ও ফসলের দাম হিসাব করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পদ্মার ডান দিকে ভেঙেছে ১৮৯ দশমিক ৪ বর্গকিলোমিটার এবং পলি পড়ে গড়ে উঠেছে ২৩ দশমিক ৬৬ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু পদ্মার বাঁ দিকে ভেঙেছে ১৬৬ বর্গকিলোমিটার এবং গড়ে উঠেছে ১৩৪ বর্গকিলোমিটার। সে হিসাবে দেখা যায়, পদ্মার ডান দিকের চেয়ে বাঁ দিকের ভাঙনের প্রবণতা বেশি।
প্রকৃতপক্ষে পদ্মা একটি ভাঙনপ্রবণ নদী। এখন পদ্মা ভাঙছে প্রাকৃতিক কারণে। বাংলাদেশ একটি পলি গঠিত বদ্বীপ। দেশের অনেক নদীতেই ভাঙাগড়া চলছে প্রতিবছর। তবে মেঘনা, যমুনা, পদ্মা অত্যন্ত ভাঙনপ্রবণ ও স্রোতস্বিনী নদী হওয়ায় বিক্ষিপ্ত এবং ছোটখাটো স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ নিয়ে এসব নদীর ভাঙন রোধ করা যাবে না। এসব নদীর ভাঙন রোধ করার জন্য মাটির গঠন, নদীর গভীরতা, স্রোতের তীব্রতা, অন্যান্য তথ্যসহ একটি সামগ্রিক সমীক্ষা পরিচালনা করতে হবে। ভাঙনের কারণগুলো সঠিকভাবে নির্ণয় করে নদীভাঙন প্রতিরোধের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা দরকার। কারণ নদীভাঙন প্রতিরোধের ব্যয় অপেক্ষা নদীভাঙনে মানুষের সর্বস্ব হারানোর ক্ষতি অনেক বেশি।
লেখক : পরিবেশবিষয়ক লেখক, ইংল্যান্ডের গ্রিনিচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এনভায়রনমেন্টাল কনজারভেশন বিষয়ে মাস্টার্স।
সূত্র: কালের কন্ঠ, প্রকাশ- ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ।।