নদীর আঁচল ।। আলিফ আলম 

আঁচল
‘নদ- নদী’ শব্দ দুটি  অনেকটা পুরুষ  আর নারী বাচকতা শব্দের সঙ্গে অবলীলায় মিলে যায়। তাদের গতি-প্রকৃতিও বেশ খানিকটা নর-নারীর মতই। মানুষের মতই তাদের রয়েছে শৈশব, যৌবন, মাঝবয়স আর বৃদ্ধকাল। উৎস থেকে  উৎপত্তি  হয়ে প্রাকৃতিক সৃষ্ট এই জলধারা একদিন সাগর, মহাসাগর কিংবা হ্রদে মিশে যায়। এই  মিশে যাওয়া ব্যাপারটা  তাদের সহজাত।
কানাডার কুইবেক প্রভিন্সের মন্ট্রিয়াল শহরের গা ঘেঁষে যে নদী বয়ে গেছে তার নাম ‘সেন্ট লরেন্স’  Saint Lawrence River । আগে এর নাম ‘Magtogoek’ ছিল পরে যা পরিবর্তন করা হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য- ১১৯৭ কিমি. এবং যার উৎপত্তির স্থল অন্টারিও হ্রদ। কুইবেকের  যে যে শহরের গা ঘেঁষে এ নদী প্রবাহিত  হয়েছে তা হল, থ্রী রিভার্স, ব্রক ভিল এবং কর্ণওয়াল। এই নদী উত্তর আমেরিকার বড় হ্রদ এবং আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে সম্পর্কিত।
মন্ট্রিয়াল শহরের আমার প্রিয় এই নদীকে প্রায়েই গ্রীষ্মকালে দেখতে যাওয়া হয়। নদীকে ঘিরে এক বিশাল পার্ক তৈরি করা হয়েছে। একদিকে সরু হাঁটার রাস্তা আর অন্য দিকে সমান্তরাল সাইকেল চালানোর পথ। গ্রীষ্মে প্রচুর মানুষের সমাগম হয় এখানে। কেউ  পিকনিক, কেউ  বারবিকিউ, আবার কেউবা তার অবসর সময় কাটাতে আসেন এই নদীর কাছে।
কুইবেকের জনসংখ্যা, কৃষি আর সুপরিকল্পিত নগারায়ন এবং একে ঘিরে বিভিন্ন ব্যবসা- বাণিজ্য গড়ে উঠায়, সেন্ট লরেন্স নদীর উপর এর প্রভাব পড়েছে বেশ খানিক। নদীতে বিভিন্ন সময় ভারী বর্জ্য নিক্ষেপ, নদীর দূষণ বাড়িয়েছে অনেকখানি। বিগত ২০ বছর যাবত এই দূষণ কমানোর চেষ্টা চলছে যেন নদী সাঁতার কাটার জন্য উপযোগী হয়।
সেন্ট লরেন্স নদী, কানাডা। ছবি- আলিফ আলম
প্রতিবছর যাওয়া হয় আমার সেন্ট লরেন্সের কাছে,  রোদের আলোয় ঝকঝক করে চারপাশ। নদীর যে পাশ দিয়ে হাঁটার পথ গিয়েছে তার দুপাশে উঁচু উঁচু গাছের সারি, দূর থেকে দেখলে,  চুলের সিঁথির মত দেখায়। হাঁটার পথকে ‘U’ আকৃতির করে বানানো হয়েছে। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটলে যে কারো হাঁফ ধরে যায়। নদীর পাড়ে সাজিয়ে রাখা বড় বড় পাথরে পানির ছোট ছোট ঢেউ এসে যখন ভেঙে যায়, তখন মনে হয় এ ঢেউ ভাঙার শব্দ মনের ভাঙ্গনকেও সারিয়ে দেয়! এর গতি আর রূপ যেন এক নারীর মত যে তার লম্বা আঁচল ছড়িয়ে বয়ে চলছে!
একটু দূর তাকালে ছোট ছোট নৌকা চোখে পড়ে। কোথাও বা আবার ইঞ্জিন চালিত নৌকা। তার নাব্যতাই বলে দেয় এখন তার যৌবন কাল। উপর থেকে দেখলে তাকে একদম সুতি শাড়ির মত লাগে আর তার পাড়ে সাজানো পাথরগুলো যেন শাড়ির পাড়ের নকশা!  নদীর পাড়ে যখন ঢেউ ভেঙ্গে যায়, এ যেন কোন এক  নারীর পায়ের নুপুরের শব্দ! এ নদীর কাছে আসলেই পুরনো ব্রহ্মপুত্রের কথা মনে পড়ে,  ট্রেন ভ্রমণের সময় যাকে দেখার সুযোগ হত।
প্রতিবার গ্রীষ্মের সময় এই নদীর প্রতি এক ধরণের টান বোধ করি, যাকে একেবারেই এড়ানো যায় না। নদীর কাছে গেলে এর এক পাশে শান্ত ঢেউ খেলানো শরীরে সতেজ বাতাসের বুলানো হাত,  আর অন্য পাশে প্রখর রোদে নদীর গায়ে আলোর ঝিকমিকি যেন মনকে পুরোপুরি প্রশান্ত করে দেয়। মনকে সব পঙ্কিলতার ঊর্ধ্বে তুলে আনার জন্য হলে ও তার কাছে আমার যেতে হয় বারবার। নদীকে আমার মানুষের মত লাগে, যে মনের দুঃখ বুঝে  মনের সব ক্ষত, দুশ্চিন্তা সারিয়ে দেয়।
সেন্ট লরেন্স নদী, কানাডা। ছবি- আলিফ আলম
বাস্তবিক প্রয়োজনেই নদীকে ঘিরে নানারকম কর্মকাণ্ড গড়ে উঠে। আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ ও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশটিতে প্রধান নদ-নদী, উপনদী আর শাখা নদী মিলিয়ে অনেক নদী রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক  হলেও সত্যি যে অনেক নদী এখন হুমকির সম্মুখীন। নাব্যতার সঙ্কট, খননের অভাব, পলি জমা, নদী দখল আর শিল্পের অপরিশোধিত বর্জ্যের বিষক্রিয়ায় অনেক নদী এখন মৃত প্রায়। আমার দেখা ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র, বইয়ের পাতায় ছাপা অক্ষরের সঙ্গে কল্পনায় ভেসে উঠা,  কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রিয় সেই কপোতাক্ষ নদ আর রূপসা নদী এখন মৃত্যুর দিন গুনছে!
নদ -নদী কেবল প্রাকৃতিক সুন্দর জলধারাই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আমাদের প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ জীবন। নদীর সঙ্গে আমাদের মৎস্য চাষীদের প্রতিদিনকার জীবন নানাভাবে জড়িত। নদীর দূষণ বাড়লে পরোক্ষভাবে আমারাও তার ফল ভোগ করি। এ ভীষণ সত্য যে, প্রকৃতিগতভাবেই নদী পরিবর্তিত হয় এবং তার গতিপথ বদলায়। একটা সময় তার যৌবনকাল শেষ হলে, নাব্যতা হারিয়ে সে বার্ধক্যে পৌঁছায় কারণ নদীর স্বাস্থ্য বেশ নরম আর ভঙ্গুর। কিন্তু এর সঠিক যত্ন আর খননের অভাবে দেশে অনেক নদ-নদী সময়ের  অনেক আগেই  মানচিত্র থেকে মুছে গেছে আর অনেক নদী মুছে যাবার পথে।
নদীর এমন পরিণতি পরিবেশবিদের পাশাপাশি অনেক কবি, লেখক, আর গবেষকদেরকেও ভাবিয়ে তুলছে। কারণ মানুষ সৃষ্টিলগ্ন থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই নদীর স্বাস্থ্য রক্ষার্থে নদীর সার্বিক যত্ন খুব জরুরি, নইলে আমরা একদিন তার রুপ আর তার নানাবিধ উপকার থেকে বঞ্চিত হব।

 আলিফ আলম : লেখক, বর্তমানে স্থায়ীভাবে কানাডায় বসবাস করেন।
আমার প্রিয় নদী সিরিজের আরও লেখা
আমাদের ছোটো নদী ।। গৌতম অধিকারী
আড়িয়াল খাঁ নদ- স্মৃতি ও বাস্তবতায় ।। হাসান মাহবুব

সংশ্লিষ্ট বিষয়