সুন্দরী সোমেশ্বরী ।। আব্দুস সামাদ নয়ন

সোমেশ্বরী

নদ-নদী এদেশের সৌন্দর্যের অন্যতম এক অনুষঙ্গ। তেমনি অপার্থিব সৌন্দর্যের রাণী নেত্রকোণা জেলার সোমেশ্বরী নদী। এ নদীকে স্মরণ করতে গেলে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে শুরুতেই স্মরণ করতে হয় টঙ্ক আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী হাজং বিদ্রোহে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধেয় স্বজন, যিনি হাজংদের কাছে আজও হাজং মাতা সেই শহীদ রাশিমনি হাজং সহ শঙ্খমণি, রেবতী, নীলমণি, পদ্মমণি ও আরো অনেক শহীদদের নাম।

যারা সোমেশ্বরী নদীর ধারে টঙ্ক আন্দোলনের জন্য শহীদ হন। এ ছাড়া স্মরণ করতে হয় টঙ্ক আন্দোলনের প্রয়াত বিপ্লবী সর্বজন শ্রদ্ধেয় কমরেড মনি সিং কে। যিনি এই সোমেশ্বরীকে ভালোবেসে বড় হয়েছিলেন। এক অসাধারণ মায়াবী সুন্দরী নদী সোমেশ্বরীর নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানান লোককথা। কারও কারও মতে, এই নদীর আদি নাম ‘সমসাঙ্গ’ আবার কেউ কেউ বলেন ‘সিমসাং’। তবে, সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ এই অঞ্চলের দখল নেয়ার পর থেকে নদীটির নাম হয় সোমেশ্বরী।

নেত্রকোনা জেলার গারো পাহাড় অধ্যূষিত এলাকা দূর্গাপুরের প্রাচীন নদী সোমেশ্বরী মূলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পর্বত শ্রেণি বাহিত শীতল পানির স্রোতধারা। ভারতের মেঘালয়ে উৎপত্তি লাভ করে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার কুল্লাগড়া ইউনিয়ন দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই সোমেশ্বরী মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার হয়ে গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝরনাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে অতঃপর সোমেশ্বরী দুর্গাপুর সদর ইউনিয়নে এসে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বিভাজিত দুটি শাখাই সোমেশ্বরী নামে পরিচিত।

সোমেশ্বরী নদী: ছবি- আব্দুস সামাদ নয়ন                                                                                                                                                          সোমেশ্বরী নদী মূলত বাংলাদেশ ও মেঘালয়ের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী বা বাংলাদেশ ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বা “পাউবো” কর্তৃক সোমেশ্বরী নদীর প্রদত্ত পরিচিতি নম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদী নং সাতাশি। নীল আকাশের ছায়ায় জলকল্লোলের সুর তুলে প্রবাহমাণ এ নদীর বুকে নৌকায় করে ঘুরে বেড়ানো দারুণ আনন্দের। নদীর স্বচ্ছ নীল, ঝকঝকে এবং সুনির্মল জল, মেঘালয়ের পাহাড় মিলে সোমেশ্বরী ধরা দেয় তার মোহনীয় রূপে। বর্ষায় পূর্ণ যৌবন পাওয়া সোমেশ্বরী তখন মনে হয় স্বর্গের ধারা। সোনালির বুকে সাদা রঙের আঁচড় কাটা যেন স্বচ্ছ পানির সঙ্গে মিশে গেছে। লাল বালিতে হেঁটে হেঁটে কাশবনের পরশ নিয়ে সূর্যাস্ত দেখার জন্য অবস্থান বিজয়পুর সীমান্তরক্ষী বিজিবির ডেরায়।

মেঘ আকাশ পাহাড় আর নদীর পানির ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানোর দৃশ্য সূর্যাস্তের অপূর্ব মনোমুগ্ধ চোখের পলক সব ক্লান্তি দূর করে শান্তির পরশ এনে দেবে এ ভ্রমণে। শরতের সময়ে মেঘালয়ের পাহাড় ঘেরা সর্পিলাকারের সোমেশ্বরীর হৃদয়পটে নিজেকে আবিষ্কার করলে মনে হবে ওপারের মেঘে ঢাকা পাহাড়গুলো ইশারায় ডাকছে। প্রকৃতির এ আত্মদান দেখে মন ভালো হয়ে যাবে একলহমায়।

সোমেশ্বরী নদীর খানিকটা দূরেই সবুজে ঘেরা গারো পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। ছোট ছোট চরে বেড়ে ওঠা ধবধবে সাদা কাশবনগুলো সত্যিই হৃদয়ে দোল খেয়ে যাবে। এ নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানো দারুন এক আকর্ষণের নাম। এই নদীর স্বচ্ছ নীল জলে মুগ্ধ হতে হবেই। শুধু বাধা হয়ে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে ওপারের কাঁটাতারের বেড়া।

সোমেশ্বরীতে রয়েছে ‘কালো সোনা’। মাটি তুলতে তুলতে এর ভেতরে মুক্তার দানার মতো কালো রঙের খনিজ পদার্থ মিলে বলে এর নাম কালো সোনা। এটির খনিজ মূল্য আছে। এছাড়াও এখান থেকে তোলা হয় কয়লা আর বালু। এ ছাড়া এই সোমেশ্বরীর তীরেই রয়েছে সাদামাটির অপরূপ পাহাড় বিজয়পুর। সাদা ছাড়াও গোলাপী, লাল, বেগুনী, ও ধূসর মূল্যবান মাটি এই সোমেশ্বরীরই অবদান। তবে সোমেশ্বরীর দুঃখ কিছু রাজার আকার কংসমামাগণ আমলে নেন না। তারা অষ্টপ্রহর পরদেশী বালি রাশির প্রচ্ছন্ন প্রেমে মাতোয়ারা। তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চান বালি ঐতিহ্য। বালির জন্য এলাকাবাসীর আছে জগতের সকল ধৈর্য্য ও সহ্য! নির্মমতা হলো বালি নিয়ে অন্তরালে জনতা দিনরাত অনুরোধে ঢেকি গিলছে। কিছু নব্য টাকার কুমিরগণ বলে বালি লক্ষী; বালি সুখের পক্ষী, বালি জীবন, বালি স্বপন।

সোমেশ্বরী নদী: ছবি- আব্দুস সামাদ নয়ন

সোমেশ্বরীর সংযোগস্থল ব্রিজ জুড়ে নিত্য দিনরাত শত ট্রাকের বিশ্রামই কিছু রাঘব বোয়ালদের সুখের দিন; ভবিতব্য যে কোন ট্রাজেডি কিছু দলীয় পালেরগোদাদের কাছে আবেগহীন। দিনশেষে আমজনতার জন্য লবডংকা; দূর হয় না জনতার জীবনের শংকা।নদীর নাব্যতার বিষয় তাদের কাছে অতীব তুচ্ছ। নৌ চলাচলের সেই ঐতিহ্য নেই। নেই পালতোলা নৌকার নিবীড় চলাচল। ২৪/৭-অষ্টপ্রহর শত শত বালি তোলা মেশিনের শব্দদূষণ, শত শত ট্রাক, ট্রাকটরকে বানানো ট্রলির দাপাদাপিতে রাস্তার বেহাল দশা, নিত্য সরুপথে অসহ্য যানজট, ঘন ঘন ট্রাকের নীচে মানুষের বলিদান, হারিয়ে গিয়েছে মাঝির কন্ঠের গান।

সোমেশ্বরীর নদীর নাব্যতা নিয়ে যুগ যুগ ধরে চলছে শুভংকরের ফাঁকি। নদী শাসন প্রসঙ্গ কাজীর বয়ানের শোভা বর্ধন করে মাত্র। সোমেশ্বরী নয় সোমেশ্বরীতে মেঘালয়ের গারো পাহাড় হতে ঢলের জলের সাথে নেমে আসা বালি এখনও অগ্রগামী। এখানে বালি লক্ষ্য সোমেশ্বরী উপলক্ষ্য। তবে অপরুপা এ সুন্দরী সোমেশ্বরীর দিকে একটু নেক দৃষ্টি দিলে প্রকৃতির আত্মদান আরো সহজ হতো।

প্রতীক্ষায় আছি, সোমেশ্বরী ফিরে পাবে তার স্বাভাবিক নাব্যতা, মিলবে জনতার কপালে শান্তি। লাল বালি নিয়ে কাঁচা বাণিজ্যের যোগ, বিয়োগ, গুনন, ভাজ্যের দুষ্ট চিন্তায় রাষ্ট্রের পক্ষ হতে পড়বে ইতিবাচক যতি। আবার দেখা মিলবে প্রাচ্যের স্যামন মাছের চেয়েও দামী সোমেম্বরীর বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য মহাশোল মাছের দলে দলে সাঁতারে বিমূর্ত হবে জলকল্লোলের ধ্বনি।

আব্দুস সামাদ নয়ন : লেখক।


আরও পড়তে পারেন….
যে নদীকে কেবল ভাসিয়ে দেওয়া গেল ।। সুপ্রতিম কর্মকার
সে এক মায়াবী নদী ।। সৈয়দ কামরুল হাসান
প্রাণের দোসর কালীগঙ্গা ।। সন্তোষ কুমার শীল
আড়িয়াল খাঁ নদ- স্মৃতি ও বাস্তবতায় ।। হাসান মাহবুব

সংশ্লিষ্ট বিষয়