নদীর নাম বলাকুট ।। মনির হোসেন

বলাকুট

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘আমার পরিচয়’ কবিতায় লিখেছেন-‘তেরশত নদী শুধায় আমাকে কোথা থেকে তুমি এলে?’ নদীর কলকল ধ্বনির এমনই প্রশ্নে আমি বলবো, ‘আমি এসেছি বলাকুট নদীর তীর থেকে। আমার স্মৃতিময় বলাকুট। আমার শৈশব-কৈশোরের বলাকুট। কুশিয়ারা নদীর অববাহিকায় বহমান বলাকুট এর জলে আমার তৃষ্ণা মিটে। বলাকুট নদী নয়, বলাকুট আমার মা

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের ব্রহ্মপুত্রের তীরে আমার জন্ম। বাবার কর্মস্থলের সুবাদে ইটনা থানার জয়সিদ্ধিতে বসবাস। সুদীর্ঘসময়, আবাল্য, শৈশব-কৈশোর দুরন্তপনার সবগুলো অধ্যায় কেটেছে বলাকুটের তীরে শান্তির নীড়ে। নদীর উৎপত্তিস্থল সুনির্দিষ্ট না হলেও হবিগঞ্জ জেলার আজমেরীগঞ্জ এর নিকটে কুশিয়ারা বা কালনী নদীই হলো এর সূতিকাগার। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুশিয়ারা প্রমত্তা হলেও বলাকুট তেমনটি নয়। একে-বেঁকে সর্পিলাকারে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে গেছে এ শান্ত নদী। মাঝে মাঝে শাখা-প্রশাখাও মেলে ধরার চেষ্টা করেছে।

বলাকুট নদী: শুকনো মৌসুমে ছবিটি তুলেছেন বিলাশ রহমান

কিন্তু খরস্রোতা না হওয়ায় এবং শুকনো মৌসুমে পানির অপর্যাপ্ততার জন্য হয়তোবা খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি। উৎপত্তিস্থল আজমেরিগঞ্জ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে ডুইয়ারপাড় এসে ডানপার্শ্বে শাখাটি থানা শহর ইটনায় ধনু নদীর কাছাকাছি গিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। ডুইয়ারপাড় থেকে নদীটি পশ্চিমে আরো কিছুদূর গিয়ে দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে একটি ত্রিমোহনার সৃষ্টি করে। একটি ধারা দক্ষিণে আতপাশার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এখানকার বিস্তৃর্ণ জনপদ যেন এই বলাকুটের আশীর্বাদপুষ্ট। অন্য ধারাটি একেবেঁকে বয়ে গেছে উত্তরদিকে। গন্তব্য ধনু নদী। ঘোড়াউত্রা নদীর সাথে এর স্রোতকে মিশেয়ে দিতে কাটাখালের মাধ্যমে প্রশাসন চেষ্টা করেছে। কিন্তু না, নদী চলে আপন বেগে, আপন ঠিকানায়। বহতা নদী বলাকুট প্রেমের টানে ধনু নদীর মোহনায় মিলে-মিশে একাকার।

বলাকুট আদলে অনেকটা রবী ঠাকুরের ছোট নদীর মতো। ভাটি বাংলার হাওরের দেশে এই নদীর প্রবাহমানতা। সংগতকারণেই নদীর তীরেই গড়ে ওঠেছে জনপদ। হাওরের পলিমাটির বুকে কৃষকের ভালবাসা। সেই ভালবাসার আবেশে এই ছোট নদী বিলিয়ে দেয় তার রূপালী জল। জলের সেঁচে অবশেষে হাওর যেন হয় সবুজ মাঠ, শস্য দোলা বাতাস দোলা দেয় কৃষকের প্রাণে।

ফেব্রুয়ারি-মার্চে নদীর পানি কিছুটা কমে গেলেও বর্ষাকালে নদীটি হয় নবযৌবনা। তবে বছরের বারোটি মাস নদীর বুকে নৌকা চলে। নানান রঙের আর ঢঙের নৌকা। চলে পাল তোলা নৌকা, দাঁড়টানা নৌকা, গুণটানা নৌকা, লগিঠেলা নৌকা আর চলে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। নদীতে চলে মালবাহী ও যাত্রীবাহী নৌকা। জ্যৈষ্ঠমাসের পর থেকেই নৌকা বাড়তে থাকে নদীতে। ইঞ্জিন চালিত নৌকায় মাইক ব্যবহার করে যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষনের চেষ্টা করা হয়। হাওরের এই অঞ্চলে বর্ষাকালে সাধারণত বিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রঙিন কাগজে সাজানো ট্রলারের ছাদে লোকজগানের তালেতালে চলে লাঠিয়ালের লাঠিখেলা।

বলাকুট নদী: বর্ষা মৌসুমে ছবিটি তুলেছেন আল-আমিন সিদ্দিক

এই নদীর জলে নৌকা চালিয়ে ও মাছ ধরে জীবীকা নির্বাহ করে মাঝি ও জেল সম্প্রদায়। ঘেরজাল দিয়ে মাছ ধরা হয় বেশি। গাছের ডালপালা, বাঁশ ও কচুরিপানা দিয়ে তৈরি করা হয় ঘের বা চারি। একটা নির্দিষ্ট সময়ে ঘের ভেঙে পাওয়া যায় বোয়াল, চিতল, কালিবাউসসহ বড় বড় মাছ। বরফ দিয়ে মাছ চালান করা হয় ভৈরব বন্দরে। এই নদীতে চাপিলা, টেংরা, পাবদা, বাইম ইত্যাদি মাছ খুব ধরা পড়ে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা বর্শি দিয়েও মাছ ধরে। জীবন-জীবীকার আধার এই বলাকুট জাতীয় রাজস্বতেও ভুমিকা রাখে। একসময় এই নদীতে শুশুক দেখা গেলেও আজকাল চোখে পড়ে না।

বলাকুট নদীর সিংহভাগ অংশে একপাশে জনপদ ও অন্যপাশে বিস্তৃর্ণ গো-চারণ ভূমি। সকাল বেলা রাখাল গরু ও মহিষ নিয়ে সাঁতার কেটে নদী পাড় হয়। ‌‘পানির নিচে জলপরী পছন্দ মতো গরু বা মহিষকে ভোগে নেয়’-এমন রূপ কথাও কিন্তু কম শোনা যায় না। লোকমুখের এসব আষাঢ়ে গল্প কারো সম্মুখে ঘটতে শোনা যায়নি। নদীর এপাড়ে-ওপাড়ে অসংখ্য সেঁচ মেশিন অষ্টপ্রহর পানিতুলে। নদীর পাড়ের গুচ্ছ গুচ্ছ এই গ্রামগুলো শুধু ছবির মতোই নয়, তাদের মধ্যে রয়েছে সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। নদী আর মানুষের মাঝে গভীর মিতালী।

শান্ত বলাকুট কখনো কখনো অশান্ত হয়ে যায়। কূলে আছড়ে পরে ঢেউরের উপর ঢেউ। কোথাও কোথাও নদী পাড়ের ঘরবাড়ি হয়ে যায় বিলীন। নদী সিকিস্ত মানুষের দু:খ-কষ্টের সীমা থাকেনা। তবে নদী পাড়ের মানুষ থাকে প্রচন্ড সাহসী ও আত্ম-বিশ্বাসী। তারা প্রকৃতির সাথে নিরন্তন যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। এ নদীর স্নিগ্ধজলে অবগাহন করেছেন বিজ্ঞানাচার্য জগদ্বীশ চন্দ্র বসুর ভগ্নিপতি এবং বাংলার প্রথম ও একমাত্র র‌্যাংলার আনন্দমোহন বসু। বিজ্ঞানী হেমেন্দ্রমোহন বসুসহ আরো অনেক গুণীজন।

নদী ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ অতিশয় দুর্বল। যেকারণে বলাকুট আজ মরতে বসেছে। এ যেন আজ মরা নদীর সুঁতা। বলাকুট ভাল থাকলে ভাল থাকবে নদী পাড়ের জনপদ ও মানুষের জীবন-জীবীকা। ভাস্বর হোক স্মৃতিগুলো, ভাল থাকুক বলাকুট।

লেখক: মনির হোসেন, ডাটা কন্টোল সুপারভাইজার, আইসিটি ডিভিশন, প্রধান কার্যালয়, জীবন বীমা কর্পোরেশন, ঢাকা।


আরও পড়তে পারেন…
সুন্দরী সোমেশ্বরী ।। আব্দুস সামাদ নয়ন
যে নদীকে কেবল ভাসিয়ে দেওয়া গেল ।। সুপ্রতিম কর্মকার
সে এক মায়াবী নদী ।। সৈয়দ কামরুল হাসান

সংশ্লিষ্ট বিষয়