নদী মানেই প্রবাহ। আর প্রবাহ মানে জীবন। তাই নদী বাদে জীবনকথা সম্পূর্ণ হতে পারে না। আবার, জীবনসঙ্গীত গায় কিন্তু তথাকথিত ব্রাত্যজনেরা। আবহমানকাল ধরে তারাই সচল রেখেছে জীবনের জয়যাত্রা। ঠিক একইভাবে, নামীদামী বৃহৎ নদ-নদীর পাশাপাশি, ছোট্ট ছোট্ট নদীরা ধরে রেখেছে সভ্যতার মূল চালিকাশক্তিকে। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরদিকে, জানা-অজানা অজস্র নদীর রুদ্ধকথা সেই শক্তিকেই বিবৃত করছে।
ভুটান পাহাড়ের দক্ষিণ বনাঞ্চলে আট হাজার উচ্চতায় জন্ম নেওয়া ‘রঙ্গোরি’ নামের নদীটিও ঠিক এমনই। তবে উৎসমুখের নামে নয়, তার অধিক পরিচিতি ‘মুজনাই’ নামে এবং এই উৎস নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেননা উৎস থেকে যে প্রবাহ দেখা যায় তার খাত বর্ষা বাদে সারা বছর শুকনো থাকে। অথচ আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাটের নিকটবর্তী বাঙাবাড়ি অঞ্চলে নদীতে সারাবছর জল দেখা যায়। এর কারণ আসলে, এই অঞ্চলে থাকা কয়েকটি প্রস্রবণ। অনবরত সেগুলি থেকে জল বেরিয়ে দক্ষিণ মুখে বয়ে চলেছে। ডুয়ার্সের আরও দুই একটি নদীও এরকম প্রস্রবণের জলে পুষ্ট। আদি অনন্তকাল ধরে বেরিয়ে আসা এই প্রবাহের জন্যই হয়ত নদীর নাম ‘মজে নাই’ যা লোকমুখে মুজনাই হয়ে গেছে। তবে তা অনুমান মাত্র।
বাঙাবাড়ি থেকে নিজের খাতে জল নিয়ে মুজনাই রাঙালিবাজনা হয়ে খয়েরবাড়ি বনাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। খয়েরবাড়ির চরিত্রও ডুয়ার্সের অন্য অরণ্যগুলির মতো। একটা সময় এখানেও সূর্যের আলো মাটি স্পর্শ করতে পারত না। আজ সে অবস্থা না থাকলেও, হাতি, বাইসনসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী, অজস্র পাখি ও সরীসৃপ সমৃদ্ধ এই বনভূমি যথেষ্টই গা-ছমছমে। মুজনাই তার একক যাত্রায় ইতিমধ্যে বেশ কিছু নামহীন প্রবাহকে অঙ্গীকৃত করেছে। তার জলে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে হিংস্র শ্বাপদেরা। প্রবাহে ভেসে যাচ্ছে, শাল- সেগুন- চিকরাশি- মাদার- জারুল- অর্জুন-শিরীষের ছিন্নপত্র। বোরোলি- বাটা- আড়- রুই- কালবাউশ- মৃগেল- কাতলা ইত্যাদি মাছেরা খেলা করছে মুজনাইয়ের গভীরে।
অরণ্য ভ্রমণ শেষে, লোকালয়ে মুজনাইকে দেখা যায় ফালাকাটা-জটেশ্বরের মাঝে। এরপর মুজনাই ফালাকাটার একদম পাশ দিয়ে বয়ে শৌলমারির কাছে কোচবিহার জেলায় প্রবেশ করেছে। ইতিমধ্যে মুজনাইয়ের সঙ্গে মিশেছে বুড়া তোর্ষা বা বালাতোর্ষা ও বীরকিটি। ফলে মুজনাইয়ের কলেবর আরও বেড়েছে। উপচে পড়া স্বাস্থ্যবতী মুজনাই এবার বিপুল আনন্দে, উচ্ছল নারীর মতোই, অনবরত দিক পরিবর্তন করতে করতে মুকুলডাঙা- রাঙামাটি-রামঠেঙা-উত্তর দাইভাঙ্গী হয়ে ৮৫ কিমির যাত্রা শেষে, মিশে গেছে জলঢাকার সঙ্গে। জলঢাকা-মুজনাইয়ের মিলিত প্রবাহ এরপর থেকে মানসাই নামে বয়ে চলেছে।
উল্লেখ্য যে, অতীতে মুজনাইকে মানসাই নামে ডাকা হত। এখনও বয়স্ক বৃদ্ধ মানুষেরা মানসাই বলতে মুজনাইকেই বোঝেন। মুজনাই নামটি তুলনায় নতুন। অতীতে কিন্তু মুজনাইয়ের যাত্রাপথটি অন্যরকম ছিল। জলঢাকা-সহ মুজনাই মাটিয়ার কুঠি, ভোগমারা, ডুমনিগুড়ি হয়ে কালাপানিতে এসে পুরোনো তোর্ষার সঙ্গে মিশে দক্ষিণ-পূর্বে আঠারোকোঠা, ঘেগিরঘাট, মোয়ামারি হয়ে বানিয়াদহের পূর্বদিকের রংপুরে ধরলাতে মিশত। হয়ত সেজন্যই অতীতে মুজনাই মানসাই নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু কালের গতিতে জলঢাকা তার প্রবাহকে অঙ্গীকৃত করে তার বামতীরের উপনদীতে পরিণত করে এবং মানসাই নামটি মুছে গিয়ে মুজনাই নামটি জায়গা নেয়।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন মানচিত্রে মুজনাইয়ের পরিচিতি রহস্যময় নদী হিসেবে। উজানের দিকে নদীর প্রবাহ তোর্ষা নদীর সমান্তরাল। ডুয়ার্স বিশেষজ্ঞ শ্রী ব্রজগোপাল ঘোষ জানাচ্ছেন যে, একসময় এই নদীতে ঘড়িয়াল দেখা যেত। স্বাধীনতা পরে পরে, যখন ডুয়ার্স অনেক বেশি দুর্গম ছিল, তখন তাসাটি চা-বাগানের বড়বাবু অনাথবন্ধু ঘোষ, ডিমডিমা চা-বাগানের ফিডারবাবুর সঙ্গে শীতকালে দুপাশে জঙ্গলাকীর্ণ বীরপাড়া- ফালাকাটা পথে জটেশ্বরের ক্যালভার্ট পেরিয়ে মুজনাইতে মাছ ধরতে যেতেন। তাঁদের সেই মৎস্য অভিযান একবার ব্যাহত হয় যখন তাঁরা আবিষ্কার করেন যে, মুজনাইয়ের তীরে একাধিক ঘড়িয়াল রোদ পোহাচ্ছে। কীভাবে এতগুলি ঘড়িয়াল মুজনাইয়ের মতো একটি নদীতে এল তা আজও জানা যায় নি। সম্প্রতি, মাদারিহাটে পুলিশের হাতে এক চোরাশিকারী ধরা পড়ে এবং তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় বাতাগুড় বাসকা নামের বিরল প্রজাতির কিছু কচ্ছপ। জেরায় জানা যায় যে, মুজনাই নদীর একটি নির্দিষ্ট স্থানে এই কচ্ছপগুলির দেখা মেলে। উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা ও অসমের দু’একটি জায়গা ছাড়া এই ধরণের কচ্ছপ আর কোথাও দেখা যায় না।
মুজনাইয়ের রহস্যময়তার জন্যই বোধহয় ১৯৫৯ সালে সারদানন্দজী এই নদীর তীরে ফালাকাটার কাছে শৌলমারিতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সদ্য সদ্য স্বাধীন হওয়া ভারতে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ছায়া তখনও দীর্ঘ। সারদানন্দজীর সঙ্গে নেতাজির মুখের সাদৃশ্য থাকায় ‘মুজনাইয়ের তীরে নেতাজির আগমন’বার্তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে এবং অচিরেই মুজনাইসহ ফালাকাটা-শৌলমারি হয়ে উঠেছিল সারা ভারতের আকর্ষণের কেন্দ্র। আশ্রমে প্রবেশের মুখে ছিল অখন্ড ভারতের ম্যাপ। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বিদ্যালয়। সারদানন্দজী মাঝেমাঝেই মুজনাই ও আশ্রমের মাঝের মাঠে বক্তব্য রাখতেন। অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল সেই আশ্রম ছেড়ে অবশ্য তিনি ১৯৬৭ সালে চলে যান। আজও আশ্রমে তাঁর ব্যবহৃত ঘর, বসবার বেদী, পঞ্চবটি ইত্যাদি দেখা যায়।
মুজনাইয়ের তীরে ফালাকাটার দশমী উৎসবের অতীত জৌলুষ খানিকটা ফিকে হলেও এখনও দলে দলে মানুষ ওইদিন নদীর তীরে ভীড় জমান। সাবেক জলপাইগুড়ি জেলার প্রথম মহকুমা (বর্তমানে বিলুপ্ত) ফালাকাটায় কবে এই উৎসবের সূচনা তা নিয়ে প্রামাণ্য কোনও নথি নেই। তবে ১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি জেলা গঠনের সঙ্গে সঙ্গে ফালাকাটাকে মহকুমা তৈরি করা হয়েছিল। ঠিক সেই সময় থেকে না হলেও, অনুমান করতে ভুল হয় না যে, মুজনাইয়ের তীরে এই উৎসবের বয়স কম নয়।
বর্তমানে মুজনাইয়ের গতিপথ পাল্টালেও, পুরোনো খাতে জল থাকায় ফি বছর উৎসবটি সম্পন্ন করতে অসুবিধা হয় না। একইভাবে আরও একটি তথ্য উল্লেখ করতে হয় যে, ১৯৮১ সালে উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় মুক্তমঞ্চ নাট্য আন্দোলন শুরু হয় ফালাকাটায় মুজনাই নদীর তীরেই। শিলিগুড়ির মুক্তমঞ্চের আদলে, ফালাকাটার এই নাট্যোৎসব মাসে দুটি বুধবার অনুষ্ঠিত হত এবং তাতে অংশ নিত উত্তরবঙ্গের নানা জায়গার নাট্য দলগুলি। আজ মুক্তমঞ্চ অতীত হলেও, মুজনাই ও জলঢাকার মিলন স্থলে প্রতি বছর ১৩ই ভাদ্র বাইচ প্রতিযোগিতাটি কিন্তু বেশ জনপ্রিয়।
উত্তরের প্রায় সব নদীর মতোই মুজনাইও বর্ষাকালে এই অঞ্চলের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রায় প্রতি বছর দুকূল ছাপায় এই নদী। প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। দুর্ভোগে পড়ে সাধারণ মানুষ। তবে মুজনাইয়ের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল ক্রমাগত গতিপথ বদল। ডুয়ার্সের খুব কম নদীই মুজনাইয়ের মতো গতিপথ বদল করেছে। আর এর ফলে, মুজনাই তার যাত্রাপথের বেশ কিছু অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়। আবার পাশাপাশি, মুজনাইয়ের দানও কিন্তু অপরিসীম। ফালাকাটা ব্লক আলিপুরদুয়ার জেলার বৃহত্তম ব্লকের পাশাপাশি, জেলার শস্যভান্ডার বলে পরিচিত। সারা জেলার চাহিদা মিটিয়েও এখানকার সবজি চালান যায় বাইরেও। ফালাকাটার উর্বর মৃত্তিকার পেছনে মুজনাইসহ তার সঙ্গে মিশে যাওয়া ছোট ছোট প্রবাহর ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। জলসেচের ক্ষেত্রেও মুজনাই সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে। কষ্ট দিলেও নিক্তি পাথরে মুজনাইয়ের দেওয়া সুখের পরিমাণ অনেক বেশি ভারী হবে সেকথা বলবার অপেক্ষা রাখে না।
লোকগাথা থেকে শুরু করে লোকসঙ্গীত, লোকজীবন সর্বত্রই মুজনাইয়ের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য। মুজনাইকে নিয়ে রয়েছে ব্রতকথাও। মুজনাই তীরের জনপদগুলিতে শোনা যায় সেসব গান বা লৌকিক ছড়া। মুজনাইকে চরিত্র করে লেখা হয়েছে গল্পগাথাও। কবিতায়-নাটকে স্থান নিয়েছে মুজনাই।
নদীর নামেই মাদারিহাটের বাঙাবাড়ির সেই প্রস্রবণগুলির পাশেই তরঙ্গায়িত ভূমিতে রয়েছে মুজনাই চা-বাগান। অত্যন্ত সুন্দর সেই চা-বাগানের মালিকানা বারবার বদল হয়েছে। চা-বাগানটি বহু পুরোনো এবং মনে করা হয় যে, ১৯০৫ সালে যখন ব্রিটিশ ডুয়ার্স রেলওয়ে বীরপাড়া থেকে সম্প্রসারিত হয়, তখন এই বাগানের চা-পাতা পাঠানোর জন্য যে স্টেশনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়, তার নাম দেওয়া হয় মুজনাই। মুজনাই চা-বাগান, মুজনাই স্টেশন, মুজনাই নদীর পাশাপাশি, জটেশ্বর-ফালাকাটা পথে মুজনাই নদীর পাশে গড়ে ওঠা জনপদটিও আজকাল মুজনাই নামে পরিচিত হয়েছে। একটি নদীর নামে চা-বাগান, রেলস্টেশন ও জনপদের নামের এরকম দৃষ্টান্ত বিশেষ দেখা যায় না। এর থেকেই প্রমাণিত যে, মুজনাইয়ের প্রভাব এই অঞ্চলে ঠিক কতটা! অবশ্য প্রভাব না থাকলে ওই নামে পত্রিকাই বা প্রকাশ করতে যাব কেন!
নিজের সম্পাদিত সেই পত্রিকার জন্য একবার, লেখা চেয়ে চিঠি দিয়েছিলাম পরম শ্রদ্ধেয়া লীলা মজুমদারকে। ডুয়ার্সের ছোট্ট মুজনাই বালকের অনুরোধ তিনি ফেলতে পারেন নি। দিয়েছিলেন একটি লেখা। সেই লেখার একটু অংশ উদ্ধৃত করে শেষ করছি এই নদীকথা। ভাবতে বিস্মিত হই যে, না দেখে, শুধুমাত্র নাম ও সামান্য কথা শুনে, মহিয়সী সেই মানুষটি যে কথাগুলি লিখেছিলেন তা যেন সত্যি মুজনাইয়ের আসল কথা-
‘…নদীর নামও মুজনাইযাত্রাপথের বুঝ নাই,সেই পথে চলেছি, বুকেবল পেয়েছি, পরম সুখেডাকি তোদের, আয় ভাই।’
মুজনাই নিয়ে কিছু বলতে গেলেই সেই চিঠির কথা মনে পড়ে আর সেই চিঠির সুরেই সুর মিলিয়ে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করে যে, মুজনাইকে নিয়েই চলেছি আজও। নদীই যোগাচ্ছে বল, নদীই দিচ্ছে সুখ!
শৌভিক রায় : লেখক, সম্পাদক।