“নদী সেতু হয়ে আছে আমাদের বন্ধুত্বে” 

বন্ধুত্বে

তাঁদের বন্ধুতা অনেকদিনের। নদীই বেঁধে দিয়েছে বন্ধুতার এই পথ। নদীই দুই বন্ধুর সেতু। ভারতের সাংবাদিকও পরিবেশকর্মী তুহিন শুভ্র মন্ডল এবং নদী বিশেষজ্ঞ সুপ্রতিম কর্মকার। নদীকে কেন্দ্রে রেখে তাদের এই আড্ডায় প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত জুড়ে থাকলো নদীই। উঠে এল স্থানীয় ও দেশীয় নদী, নদীর সমস্যা, সমাধানের পথ। কলকাতায় অনুষ্ঠিত এই আড্ডার সবটুকু রিভার বাংলার পাঠকদের জন্য উপস্থাপন করা হলো।- সম্পাদক, রিভার বাংলা।

তুহিন শুভ্র মন্ডল: সুপ্রতীম, তোমাকে নদীমাতৃক সবুজ শুভেচ্ছানদীই আমাদের বন্ধুত্বের সেতু কি বলো?

সুপ্রতিম কর্মকার: তুহিন দা, তুমি আমার একজন নদী বন্ধু। তাই তোমাকেও জানাই একনদী শুভেচ্ছা। তুমি দেখো, সারা পৃথিবীর মানুষ নদীকে মা ভাবে। অস্ট্রেলিয়ার মাওরি সম্প্রদায়ের মানুষেরা তারা বিশ্বাস করেন ওয়াংগানুই নদী থেকে তাদের জন্ম। আবার দেখো আমাদের এই নদী মায়ের বাংলায় বাঁকুড়ার কাসাইকুল্লা বলে একটি সম্প্রদায় আছে, যারা বিশ্বাস করেন কাসাই বা কংসাবতী নদী থেকে তাদের জন্ম। দেখো যে জন্ম দেয়, সেই মা। নদী জন্ম দেয় বলে আমরা নদীকে মা বলতে দ্বিধা করি না। সেই হিসেবে আমি, তুমি বা আমরা সকলেই নদী মায়ের সন্তান হলাম, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে।

এবার তুমি যে শব্দটি ব্যবহার করলে বন্ধুত্বের সেতু, সেই প্রসঙ্গে বলি। সেতু কি করে? সেতু সংযোগ করে। এক প্রান্তকে অন্য প্রান্তের সঙ্গে জোড়ে। সেতুর শব্দের সঙ্গে যে শব্দটি জুড়ে যায় তা হল ‘সেতু বন্ধন’। তোমার আর আমার মধ্যে বন্ধন কিসের? উত্তরটা বন্ধুতার। আর সেই বন্ধুতার হাত ধরেছে কে? নদী। লক্ষ্য করে দেখো নদীও বন্ধুতা করে। নদীও একে অন্যের হাত ধরে। কি করে? যদি এই প্রশ্নটি কর, তাহলে সোজা কথায় উত্তর দেব যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোন নদীর শাখা নদী হবার মানে সে আরেকটি নদীর উপনদী। তার মানে তো এক নদী অন্য নদীর হাত ধরল। সেই ভাবে, ভূগোলের সীমানাকে অতিক্রম করে, আমরাও একে অন্যের নদী বন্ধু। কারণ নদী আমাদের দুজনেরই বন্ধু।

তুহিন শুভ্র মন্ডল: লকডাউনের আগে আর লকডাউনের পরে নদীতে অনেক পার্থক্য এসেছে সবাই বলছেজলের স্বচ্ছতা দেখা যাচ্ছেতুমি কি বলবে?

সুপ্রতিম কর্মকার: এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তোমার এই প্রশ্নটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ। লকডাউন শব্দটির দৈনিক জীবনে ব্যবহার পৃথিবীর কাছে একেবারে নতুন। এই নতুন শব্দের হাত আমরা যে ভাবে ধরলাম, তা সত্যি বিস্ময়ের। কোভিড-১৯ নামের এক ভাইরাস। যাকে চোখে দেখা যায় না। আমাদের শত্রু অদৃশ্য। লড়াইটা তাই কঠিন থেকে কঠিনতর হল। মানুষের শত্রু কোভিডের আক্রমন শুরু হল, আমাদের প্রকৃতি ধ্বংসের হাত ধরে। একজন আশাবাদী মানুষের দলে আমি পড়ি। সেই দলের আমি একজন পেছনের সাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মানুষ।

সে প্রতি মুহূর্তে নদীকে মরে যেতে দেখেও ,সে এক বুক আশা ভাবে, কোন একটা সকাল শুধু নদীর হবে। সত্যি সত্যি করে একটা দিন আসল। মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে যে পৃথিবীতে রাজত্ব করত, সেই মান আর হুশ নিয়ে জন্মানো মানুষ প্রানীগুলোকে প্রকৃতি পুড়ে দিল খাঁচায়। আর যারা মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারত না বলে তারা ছিল ‘না মানুষের’ দলে, তারা বেরিয়ে আসল মানুষের দেশে। যে দেশটা গড়ে উঠেছিল না মানুষের দেশ দখল করেই, জঙ্গল ধ্বংস করে ও নদী বুজিয়ে।

দেখো তুহিন দা, নদীরও একটা কথা বলার ভাষা আছে। নদীর কথা বলার ভাষা তার জল ও স্রোতের মধ্যে মিশে থাকে। কেমন করে, তা হলে একটা উদাহরণ দিই। তোমাদের জেলার নদীরই উদারহণ দিচ্ছি। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার প্রাণের ধারা আত্রেয়ী। বালুরঘাট শহরের ভেতর নদীর বুকে যে ব্রীজটি আছে, সেই জায়গাটি সমস্ত মানুষের একটা মিলন ক্ষেত্র বলা যেতে পারে। আত্রেয়ীকে বুঝতে যখন নদীটার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তখন ঐ ব্রীজের ওপরেই আমার সাথে আলাপ হল বছর ৪৫-এর নিরঞ্জন হালদারের সঙ্গে।পাঁচ ফুটের মতো লম্বা। তামাটে গায়ের রঙ। হাড় ভাঙ্গা খাটনির ছাপ চোখে মুখে প্রবল। ঐ মানুষটি জানালেন তার বাবা এখনো বেঁচে আছেন

আমি আগ্রহ প্রকাশ করলাম, তাঁর বাবার সঙ্গে দেখা করব বলে। কাছেই বাড়ি ছিল। গেলাম। কথা হল ঐ মানুষটির সঙ্গে। ৮০-র ওপর বয়স। স্মৃতি বেশ প্রখর। শরীরের কাঠামো এখনো বয়স অনু্যায়ি বেশ শুঠাম। তিনি জানালেন আত্রেয়িতে বন্যা আসার আগে জলে ছাড়া ছাড়া ফেনা হয়। এই ফেনা যদি এক ঘন্টার মধ্যে পাঁচ ছয় বারের বেশি ভেসে আসতে চোখে পড়ে, তখন আট থেকে দশ ঘন্টার মধ্যে নদীতে জল বাড়বে, নদী বন্যা হয়ে ভাসাবে তার বুক। এটাই আসলে নদীর কথা বলা, যে কথাটা কেবল বোঝে নদীর একজন স্টেক হোল্ডার।

ঠিক এমন ভাবেই নদী লকডাউনে কথা বলছে। গঙ্গার জলে দূষনের পরিমাণ তলানিতে এসে ঠেকেছে। দিল্লীর  যমুনা, ভারতের দুষিত নদীর মধ্যে অন্যতম, সেই নদীতেও জল টলমল করছে, নদীতে মাছ ফিরে আসছে। পদ্মায় জল নিয়ে নবদ্বীপের কাছে যোগান দেওয়া একটা নদীর নাম জলঙ্গি। লকডাউনের আগে নদীতে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল ২ মিলিগ্রাম প্রতি লিটার জলে। যা স্বাভাবিক মাত্রার থেকে অনেকটা কম ছিল। ২ জুন নদীর জল পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, জলে দ্রবিভূত অক্সিজেনের পরিমান বেড়ে হয়েছে ৮ মিলিগ্রাম প্রতি লিটারে।

জলের মিশে থাকে প্রাণ বাতাসের এই মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে অনেকটায় বেশি।এই রকম ‘জল -নদীর বুকে’ যারা থাকে, সেই মাছ ও জলজ প্রাণীদের কাছে এখন এই জল অমৃত সমান। আবারো উত্তরবঙ্গে ফিরে যাই। তিস্তা-তোর্সায় যেখানে বোরোলি মাছ, একেবারে পাওয়া যেত না, সেই নদীতে বোরোলি মাছ ফিরে এসেছে। মাছ প্রাণীটা জলের ইন্ডিকেটর। নদীর জল খারাপ হলে সে চলে যায়। আর নদীর জল ভালো হলে সে থেকে যায়। বংশ বিস্তার করে, আনন্দ করে, উল্লাস করে। আর আমাদের জানান দেয়, এই নদীটা ভাল আছে।

আমি শব্দটা বড় চিৎকার শব্দ। তাই আমি শব্দটাকে একটু বাদ দিয়ে বলি, আমরা যারা নদী ও পরিবেশ নিয়ে একটু ভাবি, তাদের দাবি হওয়া উচিত, তা হলো, প্রতি মাসে, একটা দিন করে যেন লকডাউন করা হয় দেশ জুড়ে। এটা প্রাক্টিসে আনলে আমাদের দেশের সামগ্রিক পরিবেশের উপকারই হবে।

তুহিন শুভ্র মন্ডল: যাই বলো নদীগুলো কিন্ত খুব খারাপ অবস্থায় আমরা দেখেছিদূষণে, দখলে, নাব্যতাহীনতায়এত কষ্ট হয় যে কি বলবো? তোমারও নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়?

সুপ্রতিম কর্মকার: আমার জীবনে অভিজ্ঞতাগুলোর হাতেখড়ি নদীর পাশ থেকে। নদী দূষণ, নদী দখল, নদীর নাব্যতা হীনতা এই তিনটে নদীর জীবনের তিনটে থ্রেট। আমরা যারা সারা দেশ জুড়ে নদী নিয়েই কাজ করি ও লেখালেখি করি, তারা এই তিনটে অভিঘাতের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পেরাডাইম চেন্ড হতে দেখেছি। নানান উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

নদীর নাব্যতার প্রশ্নে আসি। স্বাধীনতার পূর্বের সময়টা চিন্তা করো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। খাজনা আদায়ের সাহেবদের অত্যাচার। জমিদারের জমিদারি রক্ষা করতে হবে। উপায় নেই। বন্যা না আটকালে চাষের ক্ষতি হচ্ছে। উপায়? নদীর পাড়ে বাঁধ দাও। পাড় বাঁধ বা তট বন্ধনী তৈরি হল। নদী বন্যায় যে দুধের সরের মত উর্বর পলি বিছিয়ে দিত, তারপর বন্যার জল নামত। অমনি চাষী ভাইরা মাঠে নেমে পড়ত। ধানের বীজ ছড়াত। ফনফলিয়ে ধান হত।পাড় বাঁধ দেবার পর নদীর যাপনটা পাল্টে গেল। বন্যার বয়ে আনা পলি নদীর বুকে জমা হল। ফ্লুভিয়াল রেজিমে প্রথম ইন্টারভেনশন হল। এই পর্যন্ত একটা প্যারাডাইম। তারপর দেশ বাঁচানোর লড়াই শুরু।

পরাধীনতার শৃঙ্খলে কেউ যে বাঁচতে চায় না। দাসত্ব শৃঙ্খলের বেড়ি ভাঙল আমাদের দেশ মায়ের সন্তানেরা। স্বাধীনতা আসল। ইংরেজ সাহেবরা বাংলার নদীকে বাণিজ্যের জন্যই বোঝার চেষ্টা করেছিল। পুরোটা যে বুঝতে পেরেছিল এমনটা নয়। কিন্তু আমরা বাংলার নদীকে বুঝতে চাইলাম না। কেবল শাসন করার চেষ্টা করলাম। পঞ্চাশের দশক থেকে একটা নতুন ভাবনার জন্ম হল এই দেশে। বড় বাঁধ দিলেই দেশে সেচের সমস্যা, বন্যার সমস্যা সব মিটে যাবে। যেমন ভাবা হল, কাজও তেমন হল। আমেরিকার টেনেসি ভ্যালির অনুকরণে তৈরি হল দামোদরের ওপরে বাঁধ। প্রথমে নদীর পাড় বাঁধ, তারপর নদীর বুকে কংক্রিটের বড় বাঁধ। দেখো নদীকে মারার প্যারাডাইম চেঞ্জ হয়ে গেল। দামোদর নদী পরিকল্পনা সেচের লক্ষ মাত্রা পূরণ করতে পারল না। আবার বন্যাও নিয়ন্ত্রণে ব্যার্থ হল।

দেখ যখনি প্যারাডাইম শিফট হচ্ছে, তখনি নদীর জীবনে জটিলতা বাড়ছে। আবার সত্তরের দশক থেকে যখন কলকারখানা আস্তে আস্তে বাড়ছে, তখন থেকেই বাড়তে আরম্ভ করল বাতাসের দূষণ। পৃথিবীর গায়ে লেপ্টে থাকা বায়ু মন্ডলের চাঁদরে বাড়তে আরম্ভ করল গ্রীন হাউস গ্যাস। দেখো শুধু কলকারখানা কে দোষ দিলেই হবে না। বড় বাঁধ গুলো থেকেও গ্রীন হাউস গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্রীন হাউস গ্যাস প্রকৃতির শরীরকে গরম করল। বিজ্ঞানীরা বলল এই ঘটনাকে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। যার প্রভাবে পৃথিবীর দুই প্রান্তে যুগ যুগ ধরে যে বরফ জমিয়ে রেখেছিল আমাদের পৃথিবী মা তার সৃষ্টির কিছু সময় পর থেকে, তা গলতে আরম্ভ করল। আর তার প্রভাব পড়ল পৃথিবীর তিন ভাগ জলের দেশ, সাগরে। যত বরফের গলন বাড়ল,  তত সমুদ্রের জলস্তর বাড়ল। প্রভাব পড়ল উপকূল ভাগে। প্রভাব পড়ল নদীর বুকেও।

যে সমস্ত নদীগুলি বরফের গলে যাওয়া জলে পুষ্ট, তাদের শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দিল। গঙ্গা, তিস্তার ক্ষেত্রে আমরা এই বিষয়টাকে নানা ভাবে প্রত্যক্ষ করলাম। বাংলাদেশ লোয়ার রাইপেরিয়ান কান্ট্রি হবার জন্য, ক্লাইমেট চেঞ্জের ইমপ্যাক্ট বেশি পড়ল। দেশে বিদেশের নানা রিপোর্ট এমন কথায় বলছে।টাইম লাইনে আমরা যত এগোচ্ছি, তত একের পর এক নদীর জীবনে অ্যান্সিডট এসে জুড়ছে। আর তাতেই নতুন একটা প্যারাডাইমের জন্ম হচ্ছে।  আমরা যদি একটু পরপর সাজায় তাহলে দেখব নদীকে এই মুহূর্তে লড়াই করতে হচ্ছে পাড় বাঁধের সঙ্গে, বড় বাঁধের সঙ্গে, নদী দূষনের সঙ্গে,আবার ক্লাইমেট চেঞ্জের সঙ্গে। এই  চারটে হচ্ছে নদীর বড় থ্রেট। তাই নদী নিয়ে আমাদের লড়াইটা বেশ কঠিন। তাই কষ্ট গুলকে জমিয়ে রেখে নদীর জন্য লড়াই করতেই হবে।

তুহিন শুভ্র মন্ডল: সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের নদীগুলোর সমস্যা নিয়ে যদি বলি তাহলে কিন্ত অনেক কথাই আসেসঠিক নদী নীতি, প্রশাসনিক উদ্যোগ, জনসাধারণের অংশগ্রহণ ইত্যাদিএই বিষয়টা নিয়ে তুমি কি বলবে?

সুপ্রতিম কর্মকার: ঠিক, নদী নিয়ে কথা বলতে গেলে এক জায়গায় আটকে থাকলে হবে না। নদীকে সামগ্রিক ভাবে ধরার চেষ্টা করতে হবে। আর তার জন্য নদীনীতি, প্রশাসনিক উদ্যোগ ও জনসাধারণের উদ্যোগ যেমন দরকার, এই তিনটের মধ্যে কোঅর্ডিনেশন থাকাটাও প্রয়োজন। আমাদের দেশে এক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা রয়েছে। ৮৭ সালের জাতীয় জলনীতি পাল্টে ২০০২ সালে নতুন জলনীতি আনা হল।

সেই জলনীতিকে ভিত্তি করে কিছু নতুন প্রকল্প আসল। খুব বড় প্রকল্প হিসেবে যে প্রকল্পটি এই মুহূর্তে মনে আসছে, তাহল নদী সংযোগ প্রকল্প। যা দেশ জুড়ে চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে এই প্রকল্পকে সম্পূর্ণ বন্ধ করেত হয়। ভারতবর্ষ, তার বিশালতার সঙ্গে জোড়ে নানা রকমের ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ঠ। একটি মাত্র জল নীতি দিয়ে পুরো দেশে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দেয়।তাই দরকার ভৌগোলিক অঞ্চলের ভিত্তিতে নীতি নির্মাণ করা। আমাদের রাজ্যেও জলনীতি প্রস্তুতের কথা ভাবা হয়েছিল ২০০৫-০৬ সাল নাগাদ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই নীতি আর কিন্তু তৈরি হয়ে ওঠেনি। এই খামতিগুলোকে আমাদের কিন্তু মেটানোর সময় হয়ে গেছে। না হলে নদী সমস্যাগুলো মিটবে না।

তুহিন শুভ্র মন্ডল: আমরা সবুজ মঞ্চের পক্ষ থেকে গঠিত রাজ্য নদী বাঁচাও কমিটির পক্ষ থেকে নদীর বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলাদা আলাদা নয় একটি দপ্তর দাবি তুলেছিতাতে সবক্ষেত্রেই সুবিধা হবেতাই নয় কি?

সুপ্রতিম কর্মকার: নদীর জন্য আলাদা নদী দপ্তরের দাবি সঙ্গত। তোমার মনে আছে নিশ্চই, তোমার সহযোগিতায় বালুরঘাট কলেজে একটি এক দিনের জাতীয় স্তরের আলোচনা চক্র হয়েছিল আট-নয় বছর আগে। সেখানে আমিও গিয়েছিলাম বক্তৃতা করতে। সেখানে এই একই দাবি উঠেছিল। আনন্দবাজার পত্রিকাতে, উত্তরবঙ্গ সংবাদে একটা বড় খবরও হয়েছিল।

আবার যখন সবুজ মঞ্চের পক্ষ থেকে গঠিত রাজ্য নদী বাঁচাও কমিটির  তরফ  থেকে দাবিটি ওঠে, তখন আমাদের দাবিটি আরো শক্তিশালী হয়ে যায়।এবার দেখার বিষয় হল, নদী দপ্তরের এরিয়া কি ভাবে ডিমার্কেট করা হচ্ছে? নদী দপ্তর ও সেচ দপ্তরের মধ্যে যেন কোন কনফ্লিক্ট না তৈরি হয়, এই রকম ভাবেই আমাদের নদী দপ্তরের একটা পরিসরকে নির্দিষ্ট করতে হবে, আলাপ ও আলোচনা ও পাবলিক ওপিনিয়নের ভিত্তিতে।

তুহিন শুভ্র মন্ডল: পশ্চিমবঙ্গের নদীগুলিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে  আনা খুব জরুরীকেননা নদীর সাথে আমাদের জীবন, কর্মসংস্থান, অর্থনীতি, ভবিষ্যত যুক্ত হয়ে আছেএই ক্ষেত্রে আমাদের নদী ও জল সংরক্ষণের দেশীয় পদ্ধতিগুলি কার্যকরী হতে পারে না? তুমি কি বলো?

সুপ্রতিম কর্মকার: তোমার প্রশ্নের দুটো দিক রয়েছে। এক নদীকে ফিরিয়ে দেওয়া আর দ্বিতীয় দেশীয় পদ্ধতিতে বৃষ্টির জল ধরে রাখা। প্রথম অংশে আসি। প্রথমে বলি নদীকে বাঁচানো সম্ভব। এই কাজ ভারতবর্ষে হয়েছে। কেরলের কুট্টাম্পেরুর নদীকে বাঁচানো গেছে। রাজস্থানের আরভারি নদীকে বাঁচানো গেছে। বাঁকুড়ার বিড়াই নদীকে বেশ কিছুটা বাঁচানো গেছে। উত্তরাখন্ডের শুখারালা নদীকে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া গেছে। বাংলাদেশেও বড়াল নদীর প্রাণ ফেরানো সম্ভভ হয়েছে। আমাদের মনে হয় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে যদি আমাদের কোন নদী বাঁচানোর মডেল অনুকরণ করতেই হয়, তাহলে বাংলাদেশের মডেলটি অনুকরণ করা বেশি যুক্তি যুক্ত হবে। কারণ ভৌগোলিক বৈশিষ্টে বাংলাদেশ আমাদের  অতি নিকট আত্মীয়।

আর তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে বলি সনাতন জল সংরক্ষণ পদ্ধতি আমাদের সুস্থায়ী ভাবে বাঁচার এক মাত্র পথ। উত্তরবঙ্গে দু’ধরণের চিরায়ত বৃষ্টির জল সংরক্ষণ পদ্ধতি ছিল। প্রথমটির নাম হল দং আর দ্বিতীয়টির নাম হল জমপৈ। দং পদ্ধতি একেবারেই হারিয়ে গেছে। আর জমপৈ হাতে গোনা একটা দুটো কোন রকমে তার

অস্তিত্বকে বজায় রেখেছে। আবার ইটাহার অঞ্চলের পুকুর নির্মাণের নিজস্ব একটা পদ্ধতি ছিল। এটা ঠিক আমাদের দেশে তথা রাজ্যে একটা ‘জল সমাজ’ গড়ে উঠেছিল। যাই হোক এই বিষয় নিয়ে অন্য এক সময় বলব। সে গুল সব হারিয়ে যাচ্ছে। যদি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যদি এই নীল গ্রহটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, তাহলে অবশ্যই আমাদের সনাতন পদ্ধতির হাত ধরতে হবে।

তুহিন শুভ্র মন্ডল: রিভার বাংলা, নদীর আপন বন্ধু নদী চেতনা বৃদ্ধিতে আজ করছে নিরলস ভাবেনদী বন্ধুতা বাড়ুকআমাদের মতোরিভার বাংলার জন্য কিছু বলবে?

সুপ্রতিম কর্মকার: রিভার বাংলার প্রাণ পুরুষ ফয়সাল আহমেদ’কে প্রথমেই একনদী শুভেচ্ছা জানাই। ওঁর এই প্রচেষ্টা শুধু কুর্ণিশ যোগ্যই  নয়, অনুসরণ যোগ্যও বটে। ওঁর দূরদর্শিতাকে কুর্ণিশ করতে হয়। নদী নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষায় এই প্রচেষ্টা ইতিহাস হয়ে থাকবে। আসলে লেখনী আন্দোলনও একটা আন্দোলন। তাই নদী আন্দোলনের ইতিহাস লেখা হলে, রিভার বাংলা নাম সোনার অক্ষরে লেখা হবে। কারণ দুই বাংলায় নদী প্রেমিক মানুষদের সে মেলাতে পেরেছে।

তুহিন শুভ্র মন্ডল: আশাকরি আমাদের নদী বন্ধুতা নতুন পথ তৈরি করবে ভবিষ্যতে।ভাল থাকো।নদীকে ভালো রাখো।


আরও পড়তে পারেন….
প্রিয় নদী ।। মনোনীতা চক্রবর্তী
যে নদীকে কেবল ভাসিয়ে দেওয়া গেল ।। সুপ্রতিম কর্মকার
আড়িয়াল খাঁ নদ- স্মৃতি ও বাস্তবতায় ।। হাসান মাহবুব
প্রাণের দোসর কালীগঙ্গা ।। সন্তোষ কুমার শীল

সংশ্লিষ্ট বিষয়