সে অনেক বছর আগের কথা, ভুজুং তখন জোয়ান। তার বাড়ি ছিল আমলাডিহি গ্রামে (বর্তমান নাম আমলাদহি)। এখন যেখানে চিত্তরঞ্জন রেল শহরের চব্বিশ নম্বর (নামের) স্কুলটা আছে তার পাশে। তার বাড়ির দাওয়ায় একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। পূর্ব দিকে অনেকটা নিচু জায়গা।
বর্ষাকালে সেখানেই মাছ ধরত তারা ছোটো বেলায়। এখন সে টাঙ্গির এক কোপে শ্যাওড়া গাছ কাটে। একদিন গাঁয়ে নেমে এল শোকের ছায়া। তাদের ভিটে ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেখানে নাকি শহুরে বাবুদের জন্য থাকার বাড়ি হবে। ভুজুং বুঝতে পারে না, তাদের কেন বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। এত ট্যাঁড় জমি। বানাক না ঘর। সে শুনেছে দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার মানে কি নিজের ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে যাওয়া। অনেক অশান্তি হোলো, কারো নাকি প্রাণ গেছিল। সে দেখে নি। একদিন তার বন্ধু হারিয়ে গেল এক গণ্ডগোলের পর। তার বউ চুনি তাকে জোর করে নিয়ে এল অজয় নদীর পাড়ে আমলাচাতর গ্রামে।
কিছু টাকা পেয়েছিল সে জমি বাড়ির দাম বাবদ। বাবুরা বলেছিল কারখানায় কাজ করতে। সে রাজি হবে কিনা ভাবতে ভাবতে একদিন জানল, টাকা নিয়ে নিয়েছে, তাই আর কাজ নেই। ভালোই হয়েছে। ওসব তার পোষাত না। সারা মাস খাটলে তবে পরের মাসে দশ তারিখে পয়সা। সেই মাসের দশ দিনের কি হবে? পরে যদি না দেয়?
ভুজুঙের গল্প এখানেই শেষ। ভুজুং স্বাধীন ভারতের প্রথম সভ্যতার উদ্বাস্তু। আর পাঁচটা উদ্বাস্তুর লড়াই যেমন ছিল তার লড়াইটাও কিছু অন্য মাত্রার নয়। ফারাকটা এই যে সে হেরো পাট্টি। ছেলে দুটোই মারা গেল দু দিনের জ্বরে। বউটাও গেল নতুন বাড়ি আসার এক বছরের মধ্যে। এতে তার সুবিধাই হয়েছে। একদিন বাবুদের বাড়িতে কাজ করলে তিন দিন সুখ।
একদিন সে দেখা পেল এক বাঙ্গালী বাবুর। কথা বলে সুখ। সে যেন অনেক দিন বাদে আবার। ততদিনে তার কাজের ক্ষমতা হারিয়েছে। মাঝে মাঝে সে ওই ছোটবেলার কাঁঠাল গাছের তলায় এসে বসে। মাঝে মাঝো পাকা কাঁঠাল সে ভেটও পায় গাছের পাশের কোয়াটার্সের বাবুর কাছ থেকে। ফোকলা মুখে হাসি ফোটে। কাঁঠালটা নিয়ে আসে বাবুর বাড়ি। সবাই মিলে সাবাড় করে। বাড়ি নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। সে জমানো ব্যাপারটাই বোঝে না।
সেদিন রাতে ভুজুং নদী পেরিয়ে আর বাড়ি ফেরেনি। নদীর বুকে এই পাথরের চাতালে শুয়ে ছিল। বউটার কথা তার খুব মনে পড়েছিল অনেকদিন বাদে। চাঁদের দিকে চেয়ে চেয়ে তার কেটে গেল সারা রাত। সারা রাত ধরে চাঁদ সরে সরে গেল এক গাছের মাথা ছুঁইয়ে অন্য গাছের মাথায়।
আলোর রংকে বর্ণপিচ্ছিল জলের ছায়ায় ধরতে চেয়ে কেটে গেল তার বাকি জীবন। গ্রীষ্মে নদী লাল হয়ে যায় তাপে। পাথর শিকড় বালু কামড়ে পড়ে থাকে জলের আশায়। কালবৈশাখী তার তৃষ্ণা কবে মেটাবে, দিন গুনে চলে। তারপর একদিন ঝড় ওঠে। মেঘেরা জীবন পায়। তারো পরদিন লালবুড়ো বিদায় নিলে সে আমেজ আর ওম নিতে নিতে ভাবে কোথা গেলে হে সঙ্গিনী বৈরাগীগৌরবে….. পরিত্যক্ত এক বনানীর বিস্তার মন জুড়ে। সেই দূরত্বের আভাষ নিয়তির নীলাভ বিচ্ছুরণে প্রকাশিত। হেরে হেরে গাছেদের কাছে রয়ে গেছে শুধু বিষাদেরই হাতছানি।
কালে অকালে ভুজুং ঢুকে পড়ে জলের সীমানায়। ত্রস্ত পায়ে। বৃষ্টি শেষের পাথর মেটে রঙের চাদর ঢেকে বসে আছে। স্তব্ধ আশায়। আকাশ থেকে বাতাসে ভেষে নেমে আসছে হাজার বাহুর ভষ্ম রাশি রাশি। ভাদ্রের সকালে। তার অবচেতনে নিশির ডাক। স্বজাতি নদীর বুকচিরে তুলে নেয় বালির আরাম। প্রতিদিন। তবু হার না মানা জিদের কাছে হার মেনে জায়গা ছেড়েছে নদী সবুজ ঘাসেদের। তাদের সাথে ভুজুং কথা বলে, দু এক পশলা বৃষ্টি না হয় হোক বোঝাপড়ায়। পুবের আলোয় ছায়া খোঁজা অকারণ। রং, চোখ ঝলসানো সাদা। ভুজুং আরাম বোধ করে।
ভালবাসলে প্রিয় নারী নদী হয়ে যায়
নদীরাও রাঙা হয়ে ওঠে সাঁঝে
আলোর দ্বন্দ ছাড়িয়ে প্রাগৈতিহাসিক সুখ
চলতে চলতে থমকে হাঁপায় পাথর বুকে।কালক্রমে বালু ঢেকে যায় জলে
নীল রঙ ঢাকবে হলুদে
পাথরেরাও ঢাকা পড়ে যাবে স্রোতে
তারপর একদিন কাশ ফুল দোল খাবে
ছট প্রদীপ জ্বলবে জলের ধারে…..
(যারা ভুজুঙের প্রেক্ষাপট জানেন না, তাদের জন্য – অজয় নদ ঠিক যে জায়গায় ভারতের ঝাড়খণ্ড প্রদেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করল সেইখানে গড়ে উঠেছে স্বাধীন ভারতের প্রথম রেল ইঞ্জিন কারখানা, বর্তমানে যে জায়গার নাম চিত্তরঞ্জন। অতীতে এখানে ছিল অনেকগুলি গ্রাম। মূলত সাঁওতাল ও চাষিদের। আর রেল স্টেশনটার নাম ছিল মিহিজাম। তার পাশেই জামতাড়া। জাম শব্দের অর্থ সাপ। মিহি মানে সরু আর তাড়া মানে মোটা… অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে এক সময় এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভাব ছিল না। সে সব গ্রাম মাটিতে মিশিয়ে সভ্যতার রথের চাকা এগিয়ে গেছে। যাদের বাড়ি জমি হারিয়ে গেছে তাদের প্রতিবাদ কেউ লিখে রেখে যায় নি। কিন্তু প্রতিবাদ যে চরম আকার নিয়েছিল তার সাক্ষী বিপ্লবের নিশান চিত্তরঞ্জন রেল কারখানার লোগোতে এখনো জ্বলজ্বল করছে একটা তিরযুক্ত ধনুক। অজয় নদী এই লড়াই এর মূক দর্শক…… বাংলা সাহিত্যে অজয় নদই আমি নদী ডাকি ভালোবেসে।) (ভুজুংকে আমরা চিনি কবি অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায়ের কলমে। কবিকে শ্রদ্ধার্ঘ)
দিবাকর দাস : চিত্রকর।