আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার একটা বড়নদী ছিলো। এখন আমি বড় হয়েছি, এখন সেই নদী ছোট হতে হতে প্রায় মিলিয়ে গেছে। আমি কোনোভাবেই আমার ছেলেবেলার নদীর সাথে একে মিলাতে পারি না। আমার মন ভারাক্রান্ত হয়, আমি বড় কষ্ট পাই। আথচ ছেলেবেলায় এই নদীই ছিলো আমার ভালোবাসা।
আমার শৈশব-কৈশর নদীর জল, জলের নিরবধি বয়েচলা, বর্ষায় টই-টম্বুর স্রােতধারার সাথে মিশে ছিলো। শুধু কী তাই- আমার শরীর-মন ও আমার চৈতন্যকে বিকশিত করেছিলো আমার প্রিয় ভালোবাসার এই নদী। আমার জন্মভিটা থেকে তিন’শ গজ দূরেই ছিলো সেই নদী। সেই নদীতে সাঁতার কাটা, বন্ধুদের নিয়ে জলখেলায় মেতে উঠার এক দুর্দমনীয় সময় কেটেছে আমার নদীতেই। গৌরাঙ্গবাজারের গেনাদাসুন্দরি ব্রীজ থেকে লাফিয়ে নদীতে পড়া, আবার স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতার নির্মল আনন্দে মেতে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে।
বিকালে ফুটবল খেলা শেষে কাচারিবাজারের পশ্চিমে খেলার মাঠের দক্ষিণপাশে নদীর ঘাটে গা.ধুথে ধুথেই সতীর্থদের সাথে খুনসুটি করে আর আড্ডায় অঢেল সময় পার করতাম অবলীলায়। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেক সেরা সেরা ফুটবলার ছিলো। সেসময় তারাই এখানকার ফুটবলে নেতৃত্ব দিত। তাদের অনেকেই সেসময় ঢাকার বিভিন্ন ফুটবল দলের সদস্য ছিলো। সে সময়টা ছিলো আমার জীবনেরও সোনালি সময়। নদীরও ছিলো ভরা যৌবন। পাগলা মসজিদের দিক থেকে কলকল রবে পূবে বয়ে যেতো জলের ধারা। এখানে নদীতে গভীর কুড় ছিলো। এই কুড়ে প্রচুর মাছ ছিলো। নদীর এখানে ওখানে কিশোর-কিশোরীদের কলাগাছের ভেলা বানিয়ে সাঁতার কাটা ও খেলা করার দৃশ্য খুবই উপভোগ্য ছিলো।
আমার সেই বড় নদী এখন আর নেই। নদীর শোভা নেই, বাহারি নৌকার ছলাৎ ছলাৎ বয়ে চলাও নেই। ছেলেবেলার রোমাঞ্চকর সেইসব স্মৃতি কী ভুলা যায়? ওইসব স্মৃতি নতুন প্রজন্মের কেউ বিশ্বাস করুক বা না করুক আমার মনের অলিন্দে সেইসব সুখস্মৃতি এখনো নিরবধি বইছে।
এখন এ নদীর নাম হয়েছে ‘লেক’। গুরুদয়াল কলেজের কাছে বেশ কিছুটা জায়গা জুরে নান্দনিক করা হয়েছে। ছেলেমেয়েরা এখানে এসে সময় কাটায়।
বলা যায় পাশ্চাত্যের অনুকরণে বিনোদনের কিছুটা ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। ছেলেমেয়েরা এখানে এসে বেশ উপভোগ করে থাকে। এটাই এখন বাস্তবতা। এই বাস্তবতার আদলেই নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা স্বপ্ন দেখে। তাদের স্বপ্নে ধরা দেয় আইয়ুব বাচ্চুর গান, জেমসদের প্রতিচ্ছবি, নুরুল দ্বীনের নাটকের সংলাপ।
আমাদের ছেলেবেলায় যেমন ছিলো হেমন্ত-মান্না, সতীনাথ, আব্বাস, আলীম, ফেরদৌসি রহমান, ফরিদা ইয়সমিনরা। আমাদের সময় গানে আবেগ ছিলো, ছিলো প্রকৃতি ও নিসর্গ। এখন গতির যুগ, প্রবল বেগে বয়ে চলা। তাই এখনকার ছেলেমেয়েরা গতিময়তাকেই বেশি পছন্দ করে। তারা এখন লেকের পাড়ে বসে সেই স্বপ্নেরই জাল বুনে। আমাদের ছেলেবেলায় এই নদী তীরে বসে নদীর স্রােত দেখতাম, মাছধরা দেখতাম। কতসব মাছ যেমন কৈ,শিং, মাগুর,পুটি এবং বড় মাছও ধরা পড়তো। গাংচিল আসতো, আসতো অতিথি পাখিরাা দলবেঁধে। আজ বড় নদী নেই, নদীর ঢেউ নেই সব মিলিয়ে গেছে।
আমার ছেলেবেলার নদীতে ঘাটে ঘাটে নোঙর থাকতো বাহারি নৌকা। সেই নৌকায় যাতায়াত করতো যাত্রীরা। পুরানথানা, মণিপুরি ঘাট, রথখোলা ও একরামপুর ব্রীজের নিচে শত শত বজরা বাঁধা থাকতো। এসব নৌকার মধ্যে অনেকসময় সুন্দর সুন্দর নৌকাও দেখা যেত। নৌকাগুলো কারুময়, শিল্পীর আঁকা ছবিতে বৈচিত্রপূর্ণ থাকতো। বাহারি ও শৈল্পিক নৌকাগুলো সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। রথ ও ঝুলনযাত্রা উৎসবের সময় দলে দলে দর্শনার্থীরা আসতো শহরে।
আমার মনে পড়ে সেসময় রথখলায় সার্কাস দলের মাসব্যাপী সার্কাস খুবই জনপ্রিয় ছিল। সার্কাস দলের নারী-পুরুষদের শারীরিক কসরত ও ক্রীড়া নৈপুন্য আমাদের মুগ্ধ করতো। দলে একজন জোকার থাকতেন। তিনি নানা অংগ-ভংগীতে দর্শকদের মাতিয়ে তুলতেন। সার্কাস দলের সাথে থাকতো জীবন্ত বাঘ ও হাতি। এসব প্রত্যক্ষ করে আমরা আন্দোলিত ও একইসাথে আনন্দিত হতাম। রথখলায় বৎসরে অন্তত একবার যাত্রাপালা হতো। সারারাত ধরে চলতো যাত্রাপালা। সাধারণ মানুষ যাত্রাপালা মন্ত্রমুগ্ধের মত উপভোগ করতেন। নদীপথেই সার্কাস ও যাত্রাদলের আসা-যাওয়া ছিল।
এখন সবই বাসি হয়েছে। এখন আর ঘাট নাই, বজরাও নাই। উৎসবের সেই মনোহর পরিবেশও নাই। অতীতের গহ্বরে, স্মৃতির মণিকোঠায় সবই আজ বিলুপ্ত। আমি যখনি নদীর কাছে যাই, শৈশব-কৈশরের ছবিটাই ভৈসে উঠে। আমি যেন দেখি, জলেভরা টলমল নদী। শাপলা-শালুক ও নানা ফুল-গুল্মেভরা ছলছল জল। দেখতে পাই, জলে ভেতর নানা প্রজাতির মাছের খেলা। ছেলেবেলার বড় নদীটাই আমারে চোখের সামনে ভেসে উঠে। মনে পড়ে আমিও নদীতে মাছ ধরতাম। ছোট ডিংগী নৌকায় শখের মাছ ধরা। আমার মত আরো অনেকেই মাছ ধরতেন। অনেকেই রাতে হ্যাজাকবাতি জ্বালিয়ে মাছ শিকার করতেও দেখেছি। উড়ানি ও খড়াজাল দিয়েও মাছ ধরা হতো।
আমাদের সময় শীত মৌসুমেও নদীতে পানি থাকতো। এসময় কিছু কিছু স্থানে চর পড়তো। সেই বালুচরে বন্ধুরা মিলে মারবেল খেলতাম। তবে বছর জুড়েই নদীতে পানি থাকতো। বর্ষায় নদীর রূপ বদলে যেতো। ভরা যৌবনা অপরূপা হিসাবে আমাদের কাছে ধরা দিত। সেসময় বর্ষা আর বৃষ্টি মিলে নদীর সে কী রূপ। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলে মন উতলা হয়ে ওঠতো।
আমার ছেলেবেলার সেই নদী এখন ছোট হতে হতে লেকে পরিণত হয়েছে। যে নদীর কলধ্বনি ও কৈশরের দুরন্তপনার ধারাপাতের সাথে আমি বড় হয়েছি। সেই বড় নদী এখন ছোট হতে হতে উধাও হয়ে গেছে। মনে মনে ভবি, আমি কী কখনো ফিরে পাব আমার সেই বড় নদী, প্রিয় নরসুন্দা?
আরও পড়তে পারেন….
আমলাচাতর গ্রামের ভুজুং মাঝি ও অজয় নদীর পাথর ।। দিবাকর দাস
এই মৃত নদী আমার তিস্তা না ।। শুভময় পাল
ভারতের সঙ্গে পানি নিয়ে সংঘাত নেপাল-ভুটানের : যা বললেন মেধা পাটকর
ঘুসকি, একটি সম্ভাবনার নাম ।। কৌশিক বিশ্বাস
আঞ্চলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য সংগ্রাহক ও লেখক, কিশোরগঞ্জ।