তদন্তেই সীমাবদ্ধ সব নৌ-দুর্ঘটনা : আর কত প্রাণ দিলে এর অবসান ঘটবে!

নৌ-দুর্ঘটনা

মো. ইউসুফ আলী ।।  আবারো লঞ্চ ডুবি। আবারো প্রাণহানী। এবারতো একেবারে তীরে এসে তরী ডুবলো। ময়ূর-২ এর ধাক্কায় অর্ধশতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে গেল মর্নিং বার্ড নামের ছোট একটি লঞ্চ

মুন্সিগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চটি একেবারে সদরঘাটের নিকটে এসেই ডুবলো। এতে শিশু ও নারীসহ অন্তত ৩৩ জনের প্রাণ গেলো। প্রতি বছরই এভাবে একের পর এক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে। এ যেন কোন ভাবেই থামছে না। তাই দেশের সচেতন মানুষের কাছে এটা এখন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে যে, নৌ-পথে আর কত প্রাণ দিলে এর অবসান ঘটবে।

কারণ একের পর এক নৌ-দুর্ঘটনা যেমন ঘটেই চলছে তেমনি এসকল দুর্ঘটনা শেষে এক একটি তদন্ত কমিটিও গঠিত হচ্ছে। দুর্ঘটনার কিছুদিন যেতে না যেতেই এসকল তদন্ত ফাইল বন্দী হয়েই পড়ে থাকে। এ যাবৎ ঘটে যাওয়া ঠিক কতটি তদন্ত কমিটি আলোর মুখ দেখেছে তা দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে তদন্তেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে সব নৌ-দুর্ঘটনা।

বুড়িগঙ্গা নদীর ফতুল্লায় লঞ্চ ডুবি, চাঁদপুরের মোহনায় লঞ্চ ডুবি, ভোলায় লঞ্চ ডুবি, পটুয়াখালীর গলাচিপায় লঞ্চ ডুবি, মুন্সিগঞ্জের পদ্মা নদীতে পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ ডুবি, সর্বশেষ গত ২৯ জুন সোমবার বুড়িগঙ্গার সদরঘাটের নিকটবর্তী শ্যামবাজার-ফরাসগঞ্জ বরাবর নদীতে আরেক লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটে। এযাবৎ যতগুলি লঞ্চ ডুবির ঘটনা ঘটেছে তার প্রত্যেকটি দুর্ঘটনায়ই অসংখ্য যাত্রীর নির্মম মৃত্যু হয়েছে। আবার প্রত্যেকটি নৌ-দুর্ঘটনায়ই কিছু লোকের লাশ নিখোঁজও থেকে গেছে। কিন্তু এ ধরনের প্রত্যেকটি নৌ-দুর্ঘটনার পর পরই হইচই হয়। নিয়ম মাফিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এসব কমিটি আবার বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশও করে কিন্তু পরক্ষনে তা আর বাস্তবায়িত হয় না।

এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, সরকারি হিসেবেই গত ২০ বছরে দেশে নৌ-দুর্ঘটার শিকার হয়েছে ৩৮৯টি। যার বেসরকারী হিসাব ৬৫৮টি। এতে সরকারি হিসেবেই প্রান হারিয়েছে অন্তত ৩ হাজার মানুষ। যার বে-সরকারী হিসাবে প্রাণহানীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫হাজার। এছাড়া নিখোঁজ থেকে গেছে আরো অন্তত দেড় হাজার মানুষ। যার লাশটি পর্যন্তও ফিরে পায়নি স্বজনেরা। এসকল নৌ-দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে প্রায় ৮৬৩টি। যার মধ্যে মাত্র ৫টি তদন্ত কমিটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে।

বুড়িগঙ্গায়
বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবি

কিন্তু কেনইবা বার বার এধরনের নৌ-দুর্ঘটনা! কেনই বা এধরনের প্রাণ হানী এর সঠিক কোন জবাব সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের জানা আছে বলে মনে হয় না। আর জানা থাকলে কেনইবা এক্ষেত্রে সঠিক নিয়ম কানুন মানা হচ্ছে না? এ প্রশ্ন কেবল ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার গুলোর নয়। এ প্রশ্ন দেশের বিবেকবান মানুষের। তাহলে আমরা কি ধরে নেব এ ক্ষেত্রে সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের কোন দায় বধ্যতা নেই!

বাংলাদেশের নৌ-দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করছেন এমন একটি সংগঠনের নাম সোসাইটি অব মাষ্টার মেরিনার্স। তারা লঞ্চ দুর্ঘটনার অন্তত ১০টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তাদের মতে শতকরা ৩৪ ভাগ লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কারনে। ১৫ ভাগ লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে মাষ্টার বা চালকের গাফলতিতে। ১৫ ভাগ ঘটে মাষ্টারবিহীন চালনার জন্য। ৮ ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে চরে আটকানো ও প্রবল স্রোতের কারণে। ৭ ভাগ চরে ওঠার কারণে। ৭ ভাগ বিরূপ আবহাওয়ার কারণে। ৩ দশমিক ৫ ভাগ নির্মাণ জনিত কারণে। এছাড়া আগুন লাগা,পর্যাপ্ত সরঞ্জামাদি না থাকা ও দুটি লঞ্চের সংঘর্ষেও করনেও লঞ্চ দুর্ঘটনার শিকার হয়।

এরমধ্যে কোনো কারনইকি সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের আমলযোগ্য নয়। আর যদি আমলযোগ্য কোনো কারণ তারা সনাক্ত করে থাকেন তবে তার প্রয়োগ হচ্ছে না কেন? সমুদ্র পরিবহনের নকশা ছাড়া নৌ-যান নির্মাণ না করার নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। এছাড়া নকশা অনুযায়ী নৌ-যান নির্মাণ করা হয়েছে কিনা তা তদারকির দায়িত্ব রয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ এর।তারাও সঠিকভাবে তা তদারকি করছে বলে মনে হয় না। দেশবাসী এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না ঘটে সে বিষয়ে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন ও সঠিক নজরদারী কামনা করছেন।


আরও পড়ুন….
মোট ৩৩ লাশ উদ্ধার : অভিযান সমাপ্ত ঘোষণা
বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবি : বিভিন্ন মহলের শোক
বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবি : ৩২ মরদেহ উদ্ধার, বিভিন্ন মহলের শোক
বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ ডুবি: ২৯ মরদেহ উদ্ধার

সংশ্লিষ্ট বিষয়