ছোটকাল থেকে শুনে আসছি নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। এদেশের মানুষের জীবনও নদীকেন্দ্রিক। নদীর সাথে মানুষের সম্পর্ক মায়ের মতো। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসব নদ-নদীর ভূমিকা অপরিসীম। এদেশে নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে সর্বাধিক জনবসতি।
নদীর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকা, সুখ-দুঃখ, আবেগ-ভালোবাসা জড়িত রয়েছে। হাজার বছরের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতেও রয়েছে নদ-নদীর প্রভাব। নির্বাচনের সময় নদীও রাজনৈতিক অঙ্গনে নদীর দুই পাড়ের মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভাজন তৈরি করে। নদীর এপার ও ওপারের বিষয়-আশয় নিয়ে চায়ের দোকানে চলে নানান যুক্তি-তর্কের ঝড়। মনে হয় যেন নদী ও মানুষ মিলেমিশে একাকার।
তেরোশত নদীর দেশ বাংলাদেশ। যার মধ্যে ছোট-বড় অনেক নদী রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি নদীর নাম সিঙ্গুয়া। সিঙ্গুয়া নদী বাংলাদেশে অন্য সব নদীর তুলনায় অনেকটা ছোট্ট নদী। কিন্তু এই নদীর সাথেও অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে রয়েছে। এ নদীর সাথে জড়িয়ে রয়েছে অনেক মানুষের শৈশব-কৈশোরের রঙিন স্মৃতি।
কবি গোলাপ আমিন ‘আমার প্রিয় নদী‘ কবিতায় লিখেছেন-
নদী বয়ে যায় বুকের ভেতর
নদী বয়ে যায় মনে,
গ্রামের পাশেই বয়ে গেছে নদী
নেই দেখা তার সনে।
শাপলা-শালুক ঝিনুক কুড়ানো
নদীটি আমার প্রিয়,
নেই নদী আর আগের মতন
দিনে দিনে আজ ক্ষীয়।
শৈশব-স্মৃতি জড়িয়ে তো আছে
খেলেছি ডুব-সাঁতার,
নদীর জলেই কতো দাপাদাপি
হিসেব আছে কি তার?
নদী সেতো এক নারীর মতন
কাছে টানে এ আমাকে,
কতোদিন হয় দেখি নাতো চোখে
কাছ থেকে আমি তাকে।
আমার প্রিয় নদীর কথা বলতে গিয়ে তিনি নদীবর্তী মানুষের জীবনচিত্র ও মধুময় শৈশবস্মৃতির রোমন্থনে তুলে এনেছেন পুরনো সেই খণ্ড খণ্ড হীরক চিহ্ন। আমাদের প্রিয় সিঙ্গুয়া নদীর ফুল-পাখি, ফসল ও নিসর্গ প্রকৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি আরেকটি কবিতায় উল্লেখ করেছেন-
সবুজ মাঠের ফসল ক্ষেতে
দোলে ধানের শীষ,
আরও আছে ঘুঘু, শালিক,
দোয়েল পাখির শিস্।
বিলে-ঝিলে শাপলা-শালুক
ভরা নানান মাছে,
কারও কাছে হোক বা না হোক;
প্রিয় আমার কাছে।
সিঙ্গুয়া নদীটি পাকুন্দিয়া উপজেলার এগারসিন্দুর ইউনিয়নের খামাবিল হতে উৎপন্ন হয়ে গচিহাটা ও নিকলী হয়ে ঘোড়াউত্রা নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২২.৪ কিলোমিটার। কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া, কটিয়াদী, নিকলী উপজেলা এবং কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মানুষ এই নদী থেকে বিভিন্নভাবে উপকৃত হচ্ছে। ষাট থেকে সত্তর দশকে নদীতে যে পরিমাণে মাছ ছিল, সেই তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ মাছও বর্তমানে নদীতে নেই।মুরুব্বিদের মুখে সেই সব মাছ ধরার গল্প শুনলে মনে হয় যেন রূপকথা। সেই সময়কেই বলা হতো মাছে-ভাতে বাঙালি। তখনকার সময়ে নদীর মাছ বিক্রি করে গরীব মানুষগুলো জীবন নির্বাহ করতে পারতো। আমার নিজের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি- প্রায় আশির দশকের শেষের দিকে নদীতে প্রচুর দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ ছিল। সিঙ্গুয়া নদী থেকে স্থানীয় কিছু যন্ত্র বা হাতিয়ার ব্যবহার করে মাছ ধরা হতো। যেগুলোকে এলাকার স্থানীয় ভাষায় বলে- ফারুন, উন্নিয়া, চাঁই, বড়শি, পুহা, ধর্মজাল, কোঁচ, ঝাঁকিজাল প্রভৃতি।
নদীর দুপাশে রয়েছে বিস্তর ফসলি কৃষি জমি। শীতকালে দেখা যেত বোরো ধানের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য কাঠ দিয়ে বানানো কুন বা কুন্দা ব্যবহার করা হতো। যা দেখতে অনেকটা নৌকার মতো। সারাদিন এবং রাতের বেলায় কৃষকরা কুন বা কুন্দা দিয়ে সিঙ্গুয়া নদী থেকে পানি তুলে জমিতে সেচ দিতো, যা এখন একেবারে হারিয়ে গেছে। সেই সময়ে কৃষকরা জমিতে তেমন কোনো কীটনাশক ব্যবহার করতো না। বর্তমানে জমিতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে নদীর থাকা দেশীয় প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে।
এই নদীতে এক সময় বাঁশের সাঁকো দিয়ে মানুষজন হাতে হাত ধরে নদী পার হতো। নদীতে চলতো পাল-তোলা নৌকা। কুমাররা মাটির জিনিসপত্র নৌকায় সাজিয়ে নিতো ও কাঁচা বাঁশ ভাসিয়ে নিয়ে দূরের হাটবাজারে বিক্রি করতো। মানুষ কম খরচে মালামাল একস্থান থেকে অন্যস্থানে খুব সহজে নিয়ে যেতে পরতো। সিলেট বিভাগসহ হাওরাঞ্চল ইটনা, মিটামইন ও অষ্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা বর্ষাকালে নৌকায় করে ধান, চাল, পাট, কাঠ ও কাঁঠালসহ নানা ধরনের কাঁচামাল পাকুন্দিয়া উপজেলার কালিয়াচাপড়া বাজারে নিয়ে আসতো। আমাদের গ্রাম কুমরীর পশ্চিম পাশে স্মৃতি-বিজড়িত এই সিঙ্গুয়া নদী।
ওপারে মহিষবেড় গ্রাম। গ্রামটির সামনে সিঙ্গুয়া নদী পিছনে নলাবিল। গ্রামটি এক সময় অবহেলিত ছিল। কারণ সে এলাকায় মাত্র একটি ফসল হতো। প্রায় প্রতি বছরেই সেই গ্রামের ফসল পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে যেতো। অর্থনৈতিকভাবে এই এলাকার মানুষ ছিল অনেক দুর্বল। বর্তমানে নলাবিল থেকে খাল কেটে সিঙ্গুয়া নদীতে সংযোগ করা হয়েছে। নদীর পাড়ও উঁচু করে মাটি ভরাট করে পাকা করা হয়েছে।
এখন এলাকার মানুষের জীবনমান অনেক উন্নত হয়েছে। বর্তমানে আশে পাশের সকল গ্রামের চেয়ে মহিষবেড় গ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক লীলাভূমি। কুমরী গ্রামেরও কুমিরডিঙ্গি বিল থেকে খাল কেটে সিঙ্গুয়া নদীতে সংযোগ করার কারণে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী থেকে রক্ষা পেয়েছে। যদিও কুমিরডিঙ্গি বিলটি এখন মৎস্য-খামারে ভরপুর। নদীটি এই এলাকার মানুষের পরিবেশ ও জীবন যাপনের সাথে জড়িত। এই সিঙ্গুয়া নদীতে যেহেতু আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না, তাই জেলে এবং এলাকার মানুষের নদীতে বিচরণও কম। মাছ ধরার ক্ষেত্রে তেমন একটা আনাগোনাও নেই।
কচুরিপানা নদীর বুক দখল করে রেখেছে। আগের মতন নৌকা চলার পরিবেশটাও আর বজায় নেই। আগে বর্ষাকালে নদীতে শাপলা-শালুক ফুটে থাকতো। কিশোর-কিশোরীরা শাপলা ফুলের মালা বানিয়ে গলায় পরতো। এখন যেহেতু কচুরিপানার দখলে নদী, তাই শাপলাও আর ফুটে না। নদীতে নেই কোনো ঢেউ। পানি চলাচলের গতিবিধিও দেখা যায় না। নদীটি দীর্ঘদিন যাবত খনন করা হচ্ছে না, তাই যে কোনো সময় নদী-পাড়ের মানুষের জীবনে নেমে আসতে পারে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নদী-পাড়ের মানুষের জোরালো দাবি সিঙ্গুয়া নদীটি খনন করে নদীর আগের যৌবন ফিরিয়ে দেওয়া হোক।