নদীটির নাম ফুলেশ্বরী।এর বিস্তৃতি কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার কিছু অংশ জুড়ে। একসময়ের খরস্রোতা এই নদীটির উৎপত্তি হয় জালিয়া হাওর থেকে। কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলা ও নেত্রকোনা জেলার কিছু অংশে ফুলেশ্বরীর তেজস্বী স্রোতধারা প্রবাহিত ছিল। তৎকালীন বৃহত্তম ময়মনসিংহ জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী ছিল এই ফুলেশ্বরী। রুপ, শক্তি, যৌবন হারিয়ে ফুলেশ্বরী এখন কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা জেলার মৃত নদীর তালিকায় স্থান পেয়েছে। নদীটি মানচিত্র থেকে মুছতে মুছতে নদী তীরের মানুষই তাদের আদরের ফুলেশ্বরীকে ভুলতে বসেছে। নদীটির অবস্থান এখন কোথায়, আছে না নেই, তা নিশ্চিত করে অনেকেই বলতে পারে না।
ফুলেশ্বরীতে একসময় জল ছিল, মাছ ছিল, নৌকা ছিল, মাঝি ছিল, ছিল ভরা যৌবন। কালে কালে নদীটি হারিয়েছে তার প্রায় সবকিছু। সব হারিয়েও ফুলেশ্বরী এখনও বেঁছে আছে। তার যতটা না আকার- আকৃতিতে, জল ভরা যৌবনে, তার ছেয়ে ঢের বেশি মানুষের মনে। এর প্রধান কারণ বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। ফুলেশ্বরী নদী চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত।কারণ সেসময় এর অবস্থান ছিল কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মাইজখাপন ইউনিয়নের পাতুয়াইর (কাচারিপাড়া) গ্রামে। যেখানে চন্দ্রাবতীর বাড়ি। তাঁর জীবনে নানাভাবে জড়িয়ে আছে এই নদী। আমরা যতটা না নদী ফুলেশ্বরীর খোঁজ করি, তার ছেয়ে বেশি করি চন্দ্রাবতীর। সঙ্গত কারণেই চন্দ্রাবতীর সাথে সাথে আমাদের মানষপটে ভেসে উঠে ফুলেশ্বরী।
এই নদীর তীরেই মঙ্গলকাব্যের কবি দ্বিজ বংশীদাসের গৃহে জন্ম হয় চন্দ্রাবতীর। ফুলেশ্বরীর জলের স্নেহেই বেড়ে উঠেন তিনি। যৌবনে চন্দ্রাবতী তার শৈশবের সাথী ও প্রেমিক জয়ানন্দের কাছে উপেক্ষিত হওয়ার পর এই ফুলেশ্বরী নদীতীরে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার জন্য পিতা দ্বিজ বংশীদাসের কাছে আবেদন জানান। কন্যার আবদার মেনে নিয়ে দ্বিজ বংশীদাস ফুলেশ্বরীর তীরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর চিরকুমারী চন্দ্রাবতী শিবের সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। বেশকিছুদিন পর মোহ কেটে গেলে অনুতপ্ত জয়ানন্দ ফিরে আসেন চন্দ্রাবতীর কাছে। সেইসাথে ক্ষমাও চান প্রেমিকার কাছে। এবার প্রেমিক জয়ানন্দের ডাককে উপেক্ষা করেন চন্দ্রাবতী। এসময় মন্দিরের দরজা বন্ধ করে শিবের পূজায় মগ্ন থাকেন চন্দ্রাবতী। বন্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জয়ানন্দ বারবার চন্দ্রাবতীকে ডেকেও কোনো সাড়া না পেয়ে ব্যাথিত হন। এরপর সন্ধ্যামালতী ফুল দিয়ে মন্দিরের দরজায় চার ছত্রের একটি পদ লিখে সেই স্থান ত্যাগ করেন। পূজা শেষে মন্দির থেকে বের হয়ে চন্দ্রাবতী লেখাটি দেখতে পান। মন্দির অপবিত্র হয়েছে ভেবে সেই লেখা মুছে ফেলার জন্য নদীর ঘাটে জল আনতে গিয়ে দেখেন তাঁর প্রিয় ফুলেশ্বরী নদীর জলে ভাসছে প্রেমিক জয়ানন্দের মৃতদেহ। আবেগ সংবরণ করতে না পেরে খরস্রোতা ফুলেশ্বরীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন চন্দ্রাবতীও। প্রায় পাঁচশত বছর পর আজ যেমন নেই কবি চন্দ্রাবতী, তেমনি সেখানে নেই ফুলেশ্বরী নদী। তবে কালের সাক্ষী হয়ে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নদী পাড়ে প্রতিষ্ঠিত শিব মন্দির। বলা হয়, ভয়াবহ এক ভূমিকম্পের কারণেই এখানে ফুলেশ্বরী মিশেছে মাটির সাথে।
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন এর ওয়েবসাইটে কিশোরগঞ্জ জেলার উল্লেখযোগ্য নদীসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণে নদী ফুলেশ্বরী সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘ফুলেশ্বরী তাড়াইলের জালিয়া হাওর হতে বের হয়ে তেউরিয়া ও কাওখালীর পূর্বদিক দিয়ে ধলা গ্রামের পশ্চিমপার্শ্ব দিয়ে, জাওয়ার ও সেকান্দর নগরের ভিতর দিয়ে পাতুয়াইর গ্রামের দক্ষিণদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে নরসুন্দার সাথে মিলিত হয়।’
ফুলেশ্বরীর উৎপত্তি নিয়ে কথা হয় কিশোগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্য গবেষক ও লেখক মু আ লতিফের সাথে, তিনি বলেন- ‘ফুলেশ্বরী একসময় একটি বৃহৎ ও খরস্রোতা নদী ছিলো। অস্টাদশ শতাব্দীতে এটি বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল ও নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। তৎকালে জালিয়া হাওর থেকে এর উৎপত্তি। পরে এটি তাড়াইলের ধলা গ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে জাওয়ার ও সেকান্দর নগরের ভিতর দিয়ে পাতোয়াইর গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমে নরসুন্দায় মিলিত হয়।’
একই বিষয়ে কথা বলেন, তাড়াইল উপজেলার স্থানীয় নদীকর্মী আফজল হোসেন আজম। নদীটির উৎপত্তি ও প্রবাহ নিয়ে তিনি বলছেন ভিন্ন কথা-‘ফুলেশ্বরী নরসুন্দার শাখা নদী। পাথুয়াইর গ্রামের উত্তর দিকে প্রবাহমান ফুলেশ্বরী একসময় খরস্রোতা নদী ছিলো।এখন জরাজীর্ন খালের মতো মৃতঃপ্রায়। এটি পাথুয়াইর হতে সুনামগঞ্জ ও ইছাগঞ্জের মধ্যদিয়ে কাইছলাটি বান্দুলিয়া বাটগাঁও রাউতি গ্রামের সামনে এসে পড়েছে। প্রবল ভূমিকম্পে (১৭৭৮) সালে রাউতিতে ভূমিধসে দুই কিলোমিটার লম্বা ও হাফ কিলোমিটার প্রস্থে বিরাট গভীর খাদের সৃষ্টি করে।যা এখনও বিস্ময়ের বিষয়। সেই হতে ফুলেশ্বরী মৃতঃপ্রায়।
তিনি আরও বলেন, রাউতি হতে এটি সরাসরি উত্তর দিকে চেংগুরিয়া, কৌলি, হরিগাতি, কারংকা গ্রামের সামনে দিয়ে দাউদপুর শালিহা নওগাঁ দিয়ে সোজা কেন্দুয়া উপজেলার গগডা মোজাফফরপুর দিয়ে তাড়াইলের তেউরিয়া গ্রামের দিকে যায়।তেউরিয়া হতে গজেন্দ্রপুর, আজবপুর, ছনাটি দেওয়াটি গ্রামের সামনে দিয়ে সোজা উত্তর দিকে বোরগাঁও, বেলংকা, দামিহা, বড়ুহা ও সবিশেষ মাখনাপাড়া (জেলে পল্লী) হয়ে আবার নরসুন্দার সাথে মিলিত হয় রাজঘাট নামক স্থানে।পরে নরসুন্দা ভাটির দিকে ছুটে চলে হাওরের কালনি নদীতে পতিত হয়।৬০/৭০ কিলোমটার দৈর্ঘ্য ফুলেশ্বরী কিশোরগঞ্জ সদর ও তাড়াইলের উঁচু ভূমির উপর দিকে বয়ে গেছে।ভাটি বাংলার হাওর ও উজানে ফুলেশ্বরীর গ্রামসমূহের উচ্চতার হেরফের হবে প্রায় বিশ ফুট। তাহলে কথিত মদন, আটপাড়ার বিশাল জালিয়ার হাওর থেকে ফুলেশ্বরীর জন্ম হয়েছে এই তথ্য সঠিক নয় । নিচু এলাকা থেকে নদীর উৎপত্তি হয় না। পাহাড় হতে নদীর জন্ম হয়, এটাই স্বাভাবিক। এর বাইরে কথিত আছে প্রকল্প কাজ বর্ধিত করনের জন্য মদন ও আটপাড়ায় ফুলেশ্বরির অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে।যা বাস্তবসম্মত নয়। ছোট ছোট খালকে নদী ভাবলে চলবে না।
যেহেতু ফুলেশ্বরী প্রবাহিত হয়েছে নেত্রকোনা জেলার একটি অংশে, তাই নদীটির বর্তমান অবস্থা জানতে কথা হয় নেত্রকোনা জেলার সাংবাদিক ও গবেষক সঞ্জয় সরকার এর সাথে- ‘নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার পাইকুড়া ইউনিয়নে এবং আইথর গ্রামের পাশে ফুলেশ্বরী নামে একটি নদীর অস্তিত্ব ছিল। এখন স্থানে স্থানে ভরাট হয়ে গেছে। কোথাও সরু খালের মতো আছে।জেলার নদী তালিকায় ফুলেশ্বরীরর অস্থিত্ব নেই।নদীটি এখন মৃত।’
মৃত বলেই হয়ত, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ওয়েবসাইটে দেয়া কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার নদীর তালিকায়ও নেই ফুলেশ্বরীর নাম। ফুলেশ্বরী নেই, ফুলেশ্বরী আছে।কালের বিবর্তনে নদীটি আজ হারাতে যাচ্ছে তার সমস্ত অস্থিত্ব।তাই আর সময়ক্ষেপন না করে নদী ফুলেশ্বরীকে উদ্ধারের আবেদন জানিয়েছেন নদী তীরবর্তী সাধারণ মানুষ। তাঁদের দাবি মানচিত্র ধরে নদী খনন হোক। অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ হোক। প্রাণ ফিরে আসুক ফুলেশ্বরীর।
আরও পড়তে পারেন…
আমার নদী মধুমতী ।। রুখসানা কাজল
কালী নদী, যেখানে ঋণী আমার শৈশব ।। মাসুম মাহমুদ
আহা, এইখানে এক নদী ছিল… ।। প্রভাষ আমিন
লেখক ফয়সাল আহমেদ’র জন্ম- ২৬ জানুয়ারি ১৯৮৪ খ্রি, কিশোরগঞ্জ জেলায়। বর্তমান বসবাস ঢাকায়। তিনি গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত আছেন। সম্পাদনা করছেন অনলাইন ম্যাগাজিন নরসুন্দা ডট কম ও নদী বিষয়ক অনলাইন পত্রিকা “ রিভার বাংলা” ডট কম। এছাড়াও তিনি সম্পাদনা করছেন বই বিষয়ক পত্রিকা “এবং বই”।
লেখকের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চারটি। এরমধ্যে তিনটি গল্পগ্রন্থ। প্রথম গ্রন্থ ‘স্বপ্ন ও একটি গ্রাম’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালে, দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘সেদিন বৃষ্টি ছিল’- ২০১৫ ও ২০১৮ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘চিরকুট’। সর্বশেষ প্রকাশিত হয়েছে জীবনী ভিত্তিক বই ‘সৈয়দ নজরুল ইসলাম: মহাজীবনের প্রতিকৃতি’।
ছাত্র জীবনে যুক্তছিলেন ছাত্র আন্দোলনের সাথে। পালন করেছেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।