কতকাল ধরে শুনে আসছি নদী; তার কূল নেই, কিনারাও নেই। এই পাড় ভাঙে তো ওই পাড় গড়ে। একপ্রকার নিরুদ্দেশ যাত্রার নিয়তি তার, যদিও জানি নদী কোনো না কোনোভাবে সমুদ্রধাবিত। (অবশ্য বাঁধ দিতে দিতে মানুষ নদীর সমুদ্রযাত্রাও নিঃশেষ করে দিচ্ছে)।
পঁচিশ জুন। শুক্রবার, বুড়িগঙ্গা (আমার বেড়ে ওঠার প্রতিবেশী নদী কুমিল্লার গোমতী; যদিও গোমতীর চেয়ে বুড়িগঙ্গাই স্মৃতিতে-শ্রুতিতে প্রভাবশীল বেশি)। প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুর লাগোয়া দুপুরের নদী। আকাশে মেঘ। পাশে ঘাট। ঘাট থেকে নদীতে স্নানে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ছেলে-বুড়ো-বউ-ঝি। তাদের আগেও অগণন মানুষের স্নান সারা হয়েছে এ নদীতে। তারা হয়তো মরে গেছে কিন্তু নদী রয়ে গেছে। অন্যকে শুচিশুদ্ধ করে, নিজের গায়ে নোংরা মেখে নদীর এই চরম সহিষ্ণু বেঁচে থাকা। নদীর ঘাট মানে স্মৃতির হাওয়া। কত হাসি-কান্নার স্মৃতি মিশে থাকে এক একটি ঘাটে!
আমরা চারজন। নাজমুল, মোমিন, রাজিব, আমি আর মাঝারি সাইজের একটি নৌকা। বৃদ্ধ মাঝি, থির থির জলে প্রবল কাঁপন তুলে চলে যাচ্ছে বড় বড় লঞ্চ। মালবাহী লঞ্চ। যাত্রীবাহী লঞ্চ। মালবাহী লঞ্চগুলো চুপচাপ, যাত্রীবাহী লঞ্চে দারুণ হৈ চৈ, নদী এই হল্লা ও নীরবতা-উভয়েরই সাক্ষী।
প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুকে পেছনে রেখে আমরা সদরঘাটের দিকে নৌকা ভিড়ালাম। নদী মানে তো শুধু নদী নয়। নধীর পাশের বসতবাড়ি, গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন- এরা সবাই নদীর অংশ। রাজিব দেখাল নদীতীরে এক নারকেল গাছের ডালে চারটি কাক, নদী ছাড়া আর কোনো জায়গা থেকে বোধ হয় কাককে এমন সুন্দর দেখায় না।
ঢেউয়ের উপর ঢেউ আছড়ে পড়ছে। অদ্ভুত জলসংগীতে ঢেকে দিচ্ছে আমাদের মোবাইল ফোনে বাজা যান্ত্রিক গানকে। আকাশে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা, তবে মেঘের পাল্লাই ভারি।
নদীতে নিমজ্জিত একটি লঞ্চ। ক’দিন আগে শত শত যাত্রীসহ ডুবে গেছে সে, কালের প্রবাহ যেন নদীর চেয়ে গতিবাজ। সবাই ভুলে গেছে যে লঞ্চডুবির ঘটনা। শুধু স্মৃতিকঙ্কাল হয়ে আধ-ডোবা, আধ-জাগা এই লঞ্চ। আমরা নৌকা ভিডিয়ে মৃত লঞ্চটির মাথায় উঠলাম। যেন সিন্দাবাদের বিশাল কোনো জলদানোর উপরে আমাদের পা পড়ল। কিন্তু না, রাজিব মনে করিয়ে দিল ডুবন্ত লঞ্চটির শত শত মৃতপ্রায় মানুষের সেদিনকার আর্তচিৎকার আমাদের পায়ের পাতায় গেঁথে যাচ্ছে। মুহূর্তে মনটা অপরাধ বোধে ভরে গেল।
নৌকাটি যত তীরের দিকে এগুচ্ছে ততই চমকে ওঠার পালা। নদীর পাড়ে কয়লার স্তূপ, যেন ব্যঙ্গ করছে সফেন জলরাশিকে- ‘খুব শীঘ্রই তুইও আমার মত কুচকুচে কালোতর হবি।’
ভয়ে বুকটা ধক করে উঠল। ভয়টা অমূলক নয়। এই নদীর খুব কাছেই আবাসিক এলাকা তৈরির মোহন বিজ্ঞাপন। নদী দখলদাররা মানুষকে মিথ্যা স্তোকবাক্য শোনাচ্ছে। হায়রে নদীর বিরুদ্ধে কোনো মানুষ দাঁড়াতে পারে!
আমার মনে হয় নিসর্গ-টিসর্গ অতিদ্রুত বাংলা কবিতা-শিল্প থেকে বিদায় করে দিতে হবে। বোদলেয়ারের মত প্রস্তরশাসিত নগরের মহিমা কীর্তন করব তখন আমরা। বছরে নিয়ম করে একবার সমুদ্রগমন এখন আমাদের নাগরিক ফ্যাশন। সমুদ্রটা সহজে দখল করা যায় না; কিন্তু সমুদ্রকন্যা নদীকে চাইলেই ভরাট করা যায়। দশতলা, বিশতলা, ত্রিশতলা দালানদাররা নদীকে দায় মনে করে। কারখানার বর্জ্য ফেলো, স্যুয়েরেজ লাইন বসাও, ভরাট করে সীমানা সংকুচিত কর, তাহলে দেখবে নদী স্বেচ্ছায় অভিমানে গুটিয়ে যাবে।
আমি ভাল দিক চিনি না। সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে নাজমুল আমাকে দিক চেনাতে চেষ্টা করল। খুব ভাল যে বুঝেছি তা নয়। তবে এটুকু অন্তত বুঝেছি নদী মরে গেলে চারদিক একই রকম মনে হবে। জল নেই তো হওয়া নেই। হাওয়া নেই তো গাছ নেই। গাছ নেই তো পাখি নেই। পাখি নেই তো গান নেই। গান নেই তো প্রাণ নেই। শুধু ধু-ধু রুক্ষ বালুচর। মাইলের পর মাইল বিরানভূমি। কালের শোভাযাত্রা ছাড়া তখন দেখার কিছু থাকবে না।
পঁচিশ জুন। শুক্রবার, দুপুরের নদী। রোদ-মেঘের লুকোচুরি খেলা। জলের ক্যানভাসে কালো নৌকার বিন্যা, সারি সারি। মাঝনদীতে আমরা, রাজিব মোমিন, নাজমুল, আমি, ঘাট, নিমজ্জিত লঞ্চ, নদীর তীরে নারকেল গাছ, একটা ডালে চারটে কাক, কয়লার স্তূপ, কারখানার বর্জ্য। নদীদখলের বাহারি আয়োজন। হঠাৎ নৌকায় শুয়ে চোখটা বন্ধ করতেই দিনদুপুরে একটা কালো স্বপ্ন আমাকে তাড়া করল মুহুর্মুহু। এমন নদীভ্রমণ আমাদের আর নাও হতে পারে। আমাদের মতই অভিমানে নদীটা নিরুদ্দেশে চলে যেতে পারে।
আমার প্রিয় নদী কাঁদছে।
আমরা কী শুনছি?
পিয়াস মজিদ: কবি ও কথাসাহিত্যিক।