নিজের দেশের নদ-নদীর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা মেশানো এক আত্মীয়তাবোধ থাকে। নিজের দেশের নদীর কথা বলতে, শুনতে তার ভালো লাগে।ছোটবেলার পরিচিত নদীকে কেউ কোনোদিন ভোলে না।সেই কোন প্রাচীন কাল থেকেই বহতা নদীর সাথে, চলমান জীবনের এক আশ্চর্য সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। নদীই তো সভ্যতাকে লালন করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের পশ্চিমবাংলাতে প্রায় ৯৬ টি নদ-নদী, খাল আছে যেগুলোর সংস্কার করা হলে, জনগনের প্রভূত কল্যাণ হবে।
আজকের দিনে প্রকৃতি এবং পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলনের সাথে সাথে, নদী বাঁচাও আন্দোলনও ক্রমশ গতি পাচ্ছে। সেই জোয়ারে পা-মেলানোর তাগিদে এবং মানুষকে সচেতন করে তোলার জন্যই আমার এই লেখা। আমি আজকে আলোচনার জন্য বেছে নিয়েছি দামোদর নদের প্রধান উপনদী বরাকর নদীকে।
“ক্ষুদে , নুনে , বরাকর, / তিন নিয়ে দামোদর” – প্রধানত এই তিনটি নদী নিয়েই দামোদরের রমরমা। দামোদরের প্রধান উপনদী বরাকর পশ্চিম বর্ধমান জেলার পশ্চিম অংশে মাইথন হয়ে বরাকর শহর ছুঁয়ে শিয়ালডাঙার পশ্চিম থেকে আসা দামোদরের সাথে মিশেছে।
কোনো দেশের নদ-নদীর কথা জানতে হলে তার ভূ-প্রকৃতি এবং মৃত্তিকা সম্পর্কে সামান্য দু-চার কথা জানা প্রয়োজন।বলা বাহুল্য, নদী অনেকাংশে মৃত্তিকা নির্ভর। সেজন্যই বরাকর নদীর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে, ভূ-প্রকৃতি এবং মৃত্তিকা সম্পর্কে সামান্য দু-চার কথা বলা সমীচীন হবে। অবশ্যই এসব নেহাতই প্রাথমিক কথা, যা পাঠকদের মোটামুটি জানা।
বীরভূম, মুর্শিদাবাদের পশ্চিম অংশ, বাঁকুড়া, বর্ধমান ও মেদিনীপুরের কিছু অংশ নিয়ে হল রাঢ়ভূমি। এইসব জায়গার অবস্থান রাজমহল পাহাড় নয়তো ছোটনাগপুর মালভূমির গা ঘেঁষে। পুরুলিয়া জেলার পশ্চিমাংশ ছোটনাগপুর মালভূমিতে আছে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ছড়িয়ে আছে দীর্ঘ পাহাড়ের সারি। এসব পাহাড়ের সারি চলে গেছে ঘাটশিলা, মুসাবনি হয়ে বহেরাগুড়ায়।
তামা সমৃদ্ধ এসব অঞ্চলের বহু জায়গায়, প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রত্ন-নিদর্শন পাওয়া যায়। যাইহোক, রাঢ়ভূম ও মানভূমের শিলাস্তরের বারো আনাই আগ্নেয়যুগের উপাদান অর্থাৎ অতি প্রাচীন নাইস, গ্রানাইট, কোয়ার্টজাইট ইত্যাদি শিলা দিয়ে গঠিত। এখানেই আছে অযোধ্যা, বিহারীনাথ, শুশুনিয়া, জয়চণ্ডী প্রভৃতি পাহড়। বহু যুগ ধরে ক্ষয়িত শিলাস্তর কোথাও তরঙ্গায়িত ভূমির সৃষ্টি করেছে। এ মালভূমি অঞ্চল হলো রাঙামাটির দেশ। মাটির গভীরে প্রাচীন শিলাস্তর রূপান্তরিত ও ক্ষয়িত হয়ে কোথাও নতোন্নত ভূমির সৃষ্টি করেছে। এর উপর অনুর্বর লাল মাটি।
একে বলে ল্যাটেরাইট (Laterite) মৃত্তিকা।ল্যাটিন ভাষায় Letter শব্দের অর্থ ইঁট।আসলে নিম্নগঙ্গা সমভূমির যে প্রান্তিক দেশ ছুঁয়েছে পশ্চিমের উচ্চভূমিকে, সেটাই হলো রাঢ়ভূমি। সেখানে ল্যাটেরাইট ও পুরাতন পলিমৃত্তিকার প্রাকৃতিক মিশ্রণে মাটি হয়েছে রাঙা।আরক্ত মৃত্তিকা কোথাও লাল দোআঁশ, আবার কোথাও অম্ল ও লৌহময়। এর সঙ্গে আছে বালি, মরামকাঁকর, নুড়িপাথর।
বরাকর নদীর উৎপত্তি ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের কোডারমার পাহাড়ি এলাকায়। এই নদীর উৎপত্তিস্থল থেকে শুরু করে প্রবহমান পথের অধিকাংশই ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত। উৎপত্তিস্থল থেকে মোহনা পর্যন্ত ২২৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মাত্র ২০ কিলোমিটার পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলায় অবস্থিত। এই নদী কোডারমার পাহাড়ি এলাকায় উৎপন্ন হয়ে উত্তর অভিমুখে হাজারিবাগ, মানভূম জেলার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার উত্তর পশ্চিম কোণে প্রাচীন গোপভূমের বাথানবাড়ীতে এসে প্রবিষ্ট হয়েছে। পরে পশ্চিম বর্ধমান জেলার পশ্চিম সীমা নির্দেশ পূর্বক, মাইথন শহর ছুঁয়ে দক্ষিণে শিয়ালডাঙায় পশ্চিম থেকে আসা দামোদরের সাথে মিলিত হয়েছে।
এই নদীর প্রবাহপথে সব থেকে উল্লেখযোগ্য স্থান বরাকরকে স্পর্শ করে প্রবাহিত হওয়ায় নদীর নাম হয়েছে ‘বরাকর’। উত্তর পশ্চিম থেকে পূর্ববাহিনী এই নদীটির মোট অববাহিকার আয়তন ৬,১৫৯ বর্গ কিলোমিটার।এই বরাকর নদীর দুটো উপনদী হলো উশ্রী নদী (দক্ষিণ থেকে) এবং বর্ষোতি নদী (উত্তর থেকে)। এছাড়া আরও ১৫ টি ছোটবড় উপনদীর জলে এই নদী পুষ্ট হয়ে দামোদরে মিলিত হয়ে দামোদরে ভীষণ জলস্ফীতি ঘটায়। তার ফলে বরাকর থেকেই দামোদর নদে বন্যার তাণ্ডব শুরু হয়ে যায়। দামোদর পরিকল্পনায় তিলাইয়া ও মাইথনে ব্যারাজ নির্মিত হওয়ার ফলে দামোদরের বন্যার প্রকোপ কমেছে। তবে এই দুই বাঁধের বজ্র বাঁধনের কবলে পড়ে বরাকর নদী গতিহীন হয়ে পড়েছে।
বরাকর নদীর কাছেই অবস্থিত বিখ্যাত কল্যাণেশ্বরী মন্দির। এই মন্দিরের পিছনের পাহাড় থেকে চালনা নামে এক ছোট নদী নেমে এসে বরাকর নদীতে পড়েছে। এই বরাকর নদীর তীরে অবস্থিত কর্মব্যস্ত বরাকর শহর। যে শহরকে চিরে দিয়ে চলে গেছে ২ নম্বর জাতীয় সড়ক। এই বরাকর শহরের কয়েক হাজার বাসিন্দা জলের জন্য এই নদীর উপর নির্ভরশীল। কিন্তু নদীর দূষণের জেরে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বাসিন্দারা। বরাকর, কুলটি, ডিসেরগড়, ওল্ড জি টি রোডসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিকাশি জল বরাকর নদীতে পড়ছে। জলের সঙ্গে আবর্জনাও ভেসে আসছে।বর্ষায় জলের তোড়ে আশেপাশের এলাকায় আরও ছড়িয়ে পড়ে আবর্জনা। বাসিন্দাদের নরকযন্ত্রনা ভোগ করতে হয়।
এককালের ভরা নদী আজ দূষণে জেরবার, বাঁধের ফাঁসে গতিহীন। তবে কী আমরা আরও একটি নদীর মৃত্যু ঘণ্টা শুনতে পাচ্ছি! উত্তর লুকিয়ে আছে কালের গহ্বরে। আপাতত আমরা সচেতন হয়ে যদি কোনো উপায় করতে পারি, তাহলে হয়তো বরাকর নদীকে ভেন্টিলেশন থেকে বের করে আনা যেতে পারে। দূষণ প্রতিরোধে নদী সংস্কারের বিষয়ে পুরসভার তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আমরাও আশায় বুক বাঁধছি।
গাঙ নিহন্তা ।। কপোতাক্ষী নূপুরমা সিঞ্চি
ধলেশ্বরী নদী: ভাঙ্গন রোধে এলাকাবাসীর উদ্যোগে নদীতে বালুর বস্তা নিক্ষেপ
রিভার বাংলা’র আয়োজনে অনলাইন বিতর্ক উৎসব শুরু