জীবন-নদী যাত্রা ।। তাপস দাস

নদী যাত্রা

ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেড়িয়ে পরা। তবে একটু ঘুর পথে। এবারের সাথী বন্ধুবর জন্তত ঘোষ দা। দীর্ঘদিনের সাথী সামাজিক সমস্ত কাজের কমরেড, জীবিকায় সহকর্মী। ওর বেড়ে ওঠা দক্ষিণ দিনাজপুরে। অবিভক্ত দিনাজপুরের গৌরব ওর অন্তরের ভিত। সেই ভিতের উপর তৈরি আদ্যপান্ত বাঙালি। বাইক যাত্রায় এমন সাথী পথের ক্লান্তি দূর করে এগিয়ে চলার উৎসাহ যোগায়। জানি প্রতিবারের মতন এই যাত্রার অগোছালো নোটই শেষ হবে পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা তৈরি হবে না। তাই, রিভার বাংলা সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ ভাইয়ের আহ্বানে রিভার বাংলা ডট কম এর পাঠকদের সামনে রইলো জীবন-নদী যাত্রার এই দিনপঞ্জী।

১৩ নভেম্বর ২০২০ : তিনশো একুশ কিলোমিটার পথ চলার পর আজকের পথ থামলো। রাত্রিবাস সাথী সাদ্দামের বাড়িতেকলকাতা শহরের নর্দমা আদি গঙ্গা দেখে শুরু হয়েছিল পথ চলা শেষ হল গঙ্গা তীরে। নোয়াই, বুড়ি গঙ্গা, যমুনা, চূর্নি, খড়ে, পাগলা চণ্ডী, ফিডার খাল, ভাগীরথী (বহরমপুর) শেষে গঙ্গা। (অনেকটা পথ অন্ধকারে চলতে হল কিছু নদীর নাম বাদ দিলে শুধরে দেবেন)। জাতীয় সড়ক ৩৪ পুঁজির কল্যানে টোলের আশায় আজ মসৃণ তাই চললাম বেশ গতীতেই। আমাদের মতন ধর্মে ভবঘুরে-জাতে বাউণ্ডুলের গতি মনের মতনই গতিশীল। কৃষ্ণনগর এর পি ডাব্লু মোড়ে অপেক্ষা করছিল সাথী অনুপ সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো জলঙ্গী নদীর পাড় ও নপাড়ের মানুষের কাছে। খড়ে/জলঙ্গী আর চামটা বিলের ধারে “বাঁধাল” আর “চট জাল” দেখা আর কৃষক, স্থানীয়, প্রান্তিক মৎস্যজীবীদের সাথে কথা বলতে অনেক সময় ‌গেল। আলাপ হল নতুন বন্ধু অজিত এর সাথে। কৃষ্ণনগর ১ ব্লকের, চর শম্ভু নগরে অনেকটা পথ ক্ষেতের মধ্য দিয়ে গিয়ে বাঁধালের কাছে পৌঁছতে হল।(পরে আরো লিখছি এই বিষয়) তারপর সোজা ধুলিয়ান হয়ে পারলালপুর ঘাট, নদী পারাপারের খরচ বাইক সহ দুজনের ৭৫ টাকা। যা কয়েক মাস আগেও ছিল অনেক কম।

হঠাৎ এত খরচ কেন খোঁজ নিতে জানলাম এই ঘাটের ডাক (টেন্ডার) হয়েছে দেড় কোটি টাকা। কলকাতা থেকে প্রায় তিনশো কিলোমিটার দূরে একটি ঘাটের গুরুত্ব বুঝা যাচ্ছে এই অর্থ মূল্যে। যদিও সীমান্ত অঞ্চলে আসল অর্থ বুঝতে আরো অনেক কিছু বলতে হবে তাই সকলের বোঝার শক্তির উপর ভরসা রাখছি। যদিও পারদেওনাপুর গ্রামের শিক্ষক, নরুল হক, মনিরুল ও জহিরুদ্দিন স্যার মাস পিটিশন করে চেষ্টা চালাচ্ছেন এই পারাপারের খরচ কমাবার। পারদেওনাপুর জনকল্যাণ সমিতিতে ছোট আলোচনা, যদিও আলোচনা না বলে শিক্ষাগ্রহণ বলাই ঠিক হবে, এই বিষয়গুলো আজ বাকি রাখছি।

১৪ নভেম্বর ২০২০ : ফরাক্কা ব্যারেজের ভাটিতে বিশাল দুই চর একটি হুসেনপুরের দিকে আর একটি পশ্চিম দিকে। এই চর দুটির জন্যই হুসেনপুর, কুলিদিয়ারা, সুজাপুর, পার অনুপ নগর, গোলাপ মন্ডল পাড়া থেকে পারলালপুর ভাঙনের প্রধান কারণ মনে করে সাথী-বন্ধু ইউনুসসহ অন্য বন্ধুরা । ২০১৭ সালের বন্যার পর ফারাক্কার দিকের চরা আরো উঁচু আরো জমাট হয়ে ফারাক্কার ছাড়া জল এর দাপট আটকানোর শক্তি পায়। এতে ধাক্কা খেয়েই পূর্ব পারের গ্রামগুলি ভাঙছে অতিরিক্ত হারে। যা কয়েক বছর ধরে খবরে আসছে। পারলালপুর মন্দির বাঁচাতে উদ্যোগ নেওয়া হলেও গ্রামগুলির খবর আমাদের জানা।

ওপর দিকে ধুলিয়ান শহর বাঁধানো বেশ পক্ত। গোলাপ মন্ডল পাড়ার ইউনুসরা বর্তমান প্রজন্ম, ফারাক্কার সুখ স্বপ্নে তারা বিভোর নয় তাই প্রশ্ন তোলে নদী যত কাছে আসছে আমাদের টিউবওয়েল শুকোচ্ছে -পাইপ আরো গভীরে যাচ্ছে। কিন্তু তাঁর আগের প্রজন্মের মনে আছে শুধু নদীর খামখেয়ালী মন। কখন সে পূর্বে চলে তো কখনো পশ্চিমে। হাই-স্কুলের ইংরাজি শিক্ষক মাননীয় নরুল হক জানালেন তার বাবাকে ১৬ বার বাড়ি বদলাতে হয়েছে নদীর খেয়ালী মনের কারণে। তার থেকে ভাল হয়েছে নদীকে বেঁধে তাতে নদী এক পথেই চলছে সত্তরের পর থেকে এতদিন। এ এক জটিল প্রশ্ন ব্যাক্তি জীবনের স্থায়িত্ব আর প্রকৃতি আর মানুষের প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকার। নরুল হক বা জহিরুদ্দিন স্যার সকলেরই ধারণা ফারাক্কার পরে তাঁদের লাভ হয়েছে। ওনাদের সাথে গতকাল কথা বলতে গিয়ে মনে পরছিল বরাকর নদীর উপর তিলাইয়া বাঁধে মাছ ধরতে আসা মৎস্যজীবীর কথা। তিনি কেন তিলাইয়াকে ঘিরে ৫৬ গ্রামের মানুষেরা বেশ খুশিতে আছেন কারণ লেকের জলে সহজে পাওয়া যায় মাছ।

ঠিক তেমনি হরিশচন্দ্রপুর, রতুয়া, মানিকচকের প্রায় ৪টি অঞ্চল এমনকি তাদের নিজেদের গ্রাম পারদেওনাপুর এর একটা বুথ এলাকা জলে তলিয়ে গেলেও নরুল বাবুদের এখন আর বাড়ি বদলাতে হয় না। কালিয়াচকের ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা করতে পারছে কারণ তাদের স্থায়ী বাসস্থান আছে। বুঝলাম নতুন করে ভাঙন একদম চোখের সামনে ঘটতে দেখলেও পুরো ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার জন্য যথেষ্ট যুক্তি খুঁজে পান না তারা। তবে গতকাল থেকে নরুল হক সাহেবের একটি কথা ভীষণভাবে বারবার মনে আসছে, তিনি ২০১৭ সালের বন্যার ভয়াভয়তার কথা তুলে ধরতে বলেন “মানুষ বন্যার সঙ্গে বাঁচতে ভুলে গিয়েছে”।

সকালে মরু গাঙের চরে কিছু সময় কাটিয়ে হুসেনপুর এ উঠলাম। আলমগীর ও আর এক বন্ধু আগে থেকেই পৌঁছেছিল আমাদের বাইক নিয়ে সেখানে। ওরা ফিরলো নৌকায় আমরা বাঁধের পথ ধরে আঠেরো মাইলে জাতীয় সড়কে সেখান থেকে মালদা বাইপাস ধরে মহানন্দা পার করে ধরলাম হবিবপুরের পথ। সেখানে জগজীবনপুরে সেখানে খ্রীষ্টিয় নবম দশকের পত্নস্থল বৌদ্ধ বিহার। ১৯৯২ থেকে খনন করা শুরু হয়েছে এখনো চলছে। বিহারের রাজ্যের বিক্রমশিলার ইতিহাস আমরা জানি অথচ প্রত্নস্থলের খবর অনেকের কাছে নেই।প্রত্নস্থল দেখে সেখান থেকে নালাগোলা পেরিয়ে ভিকাহার। এখানেও একটি ভাঙা মন্দির দেখলাম একটি ১৬ হাতের দেবী-মুর্তি পাশে ডান কাত হয়ে শোয়া দেবতার মুর্তি। দেবীর নামে ‘মায়ের থান’। তবে পুরোন ঢিপির উপরে এই স্থানটিতে প্রত্নস্থল হিসেবে খনন করা দরকার বলে আমার মনে হল। এরপর দেখলাম ভিকাহার গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী “মন্দির বাসিনী” কথিত দিনাজপুরের রাজার তৈরি মন্দির। যদিও রক্ষণাবেক্ষণ অভাবে ভগ্নদশা। মন্দিরকে ভেঙে আবার বেঁধে রেখেছে বিশাল বট গাছ।

অন্য কথায় যাই, বাঁধাল নিয়ে এই সময় আমরা খুব চর্চা করি। জলঙ্গী নদী সমাজের নদী কর্মী এক বন্ধুকে কোপাই, রায়ডাকের বাঁধালের কথা বলি সে বলে ওখানেও বাঁধাল? বাংলাদেশের নিউজ পোর্টালে আত্রেয়ী নদীর উপর আড় বাঁধের খবর বেড়িয়েছিল। আমরা যে ছবিটি দিলাম সেটি নালা গোলার কাছে পুনর্ভবা নদীর উপর। জোড় করে ক্ষমতাকে কায়েম করার বাসনা শুধু জলঙ্গী নদী বাঁধাল বাধা পাখি ঘোষ বা শম্ভু নগরের চট জালের মালিক স্বপন ঘোষ এর নয়। ভারত উপমহাদেশ জুড়ে এমনভাবে নদীকে করায়ত্ব করতে চাইছেন অনেকে। সব কর্পোরেট পুঁজির দোষ কামান দাগো। বলে চললে নিজের মধ্যে থাকা হিংসাকে বাড়িয়ে চলি আমরা প্রতিনিয়ত। সমস্যাকে সমস্যার মতন করে বুঝি না, বুঝি আমি যা জানি তার মতন করে।

লকডাউনে সারাবিশ্ব যখন জীবীকানির্বাহ করতে হিমশিম তখন চর শম্বুনগর এর মৎস্যজীবীরা টের পাননি কোন সমস্যার।কারণ তাদের কাছে প্রবাহিণী জলঙ্গী ছিল। বহুদিন পূর্বে কৃষকসভার একটি দাবি ছিল “জাল যার জল তার”। একই কথা ভূতত্ত্ববিদ তাপস ঘটককে বলতে শুনেছি বয়ে চলা ‘জল’ কার? প্রবাহিত জল এর মালিকানার দাবি যখন কেউ করতে পারেন না তবে সরকার কীভাবে জল আটকে বড় বাঁধ তৈরি করে কিংবা পাখি ঘোষের মতন চুনো পুঁটিরা নদীর সব মাছকে তাদের “বাপের জমিদারী” মনে করেন।

আসলে দেশের মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তার ন্যায্য দাবি আদায় করতে ভুলেছে। এটা ঠিক, দাবি আদায়ের সফলতার কাহিনী অনেক থাকলেও মানুষ তার অধিকার বোধকে গড়ে তুলতে পারেনি। গত দুই বছর আগে এমনি বাঁধাল তৈরি হয়েছিল জলঙ্গীতে কিন্তু বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ করায় গত বছর বাঁধাল বাধা হয়নি। এবছর যখন হচ্ছে মৎস্যজীবীরা বুঝতে পারছিলেন তাদের বিপদ আসছে, তারা চিঠি লিখে সরকারের এ দুয়ার ওদুয়ার করছে অথচ ৫০০ জন নারী-পুরুষ জমাতে করে গিয়ে বাঁধালের বাশ উপড়ে ফেলা যায়। কিন্ত না যা হওয়ার নেই। মানুষের আত্মবিশ্বাস আজ তলানিতে। ফরাক্কা থেকে জলঙ্গী ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারলে নদীকে বাঁচানোর লড়ায়ে আমরা এগতে পারবো না বলে আমার মনে হয়।

১৫ নভেম্বর ২০২০ : চীনের উসকানিতে নেপাল ভারত বিরোধী হয়ে উঠেছে। এইটি বেশ জনপ্রিয় আলোচনার বিষয় এখন দেশে। এই বিষয় বিশেষজ্ঞ মতামত বেশ ভালো শেয়ার-প্রচার হয়। কিন্তু নেপাল সীমান্তে থাকা ভারতীয়রা কি ভাবেন? পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন , “মানুষই শেষ কথা বলে” আদোও তিন বলেছিলেন কি না বা কোথায় বলেছিলেন তা জানি না, কিন্তু এই কথাও বেশ শেয়ার-প্রচার হয় সমাজ মাধ্যমে। আমারও তাই মনে হয় কিন্তু, মানুষের কথা শুনতে হলে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে তো। আর বিশ্বাস পেতে ধারাবাহিক কাজও তো করতে হয়। ভাবছেন এইসব কথা কোথা থেকে নিয়ে আসছি, রায়গঞ্জে বসে। আসলে এখানে এসে প্রথম জানালাম উত্তরবঙ্গের মধ্যবিত্ত পরিবারের হাসপাতালের প্রয়োজনে তাঁরা কলকাতা-শিলিগুড়ি দৌঁড়ানোর বদলে প্রাধান্য দেন নেপালকে। খরচ-ব্যবহার-চিকিৎসা সব মিলে বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থা। নদীর কথা শুনতে-বুঝতে বেড়িয়ে বাংলার প্রত্নস্থল থেকে সংস্কৃতি, চিকিৎসা পরিষেবা, নানা অজানা জেনে চলেছি।

গতরাতে ছিলাম ভিকাহার গ্রামে সেখান থেকে মাত্র ৯৭ কিমি যাত্রা শেষে। বিকালে রায়গঞ্জ। আগামীকাল কুলিক নদী দেখতে যাবো। তারপর উত্তর -দক্ষিণ দিনাজপুরের নদীর কথা হবে। আজ শুভরাত্রি

১৬ নভেম্বর ২০২০ :  ছোট নদী কানায় কানায় ভরে ওঠে ফি বছর। তির-চার বছরে ছোট বন্যা। আট-দশ বছরে বড় বন্যা। নদীতে নৌকা মাছ প্রাণবন্ত প্রবাহ। এই তো বাংলার নদী, এই তো ছিল কুলিক নদী। সেই কুলিকে ১৯৯৮ এরপর বন্যা এলো ২০১৭ তে। সেই খবর উচ্ছসিত হয়ে জানায়েছিলেন রূপকদা অর্থাৎ রায়গঞ্জের রূপক পাল। প্রকৃতি-পরিবেশের নিয়ম মেনে কৃষি সংস্কৃতি নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সকলেই চেনেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপককে। ফোনে কথা বা সমাজ মাধ্যমে যোগাযোগ থাকলেও অনেক দিন পর দেখা হল। গতকাল সন্ধ্যায় দেখা করে গিয়েছিলেন। আজ আবার সকালে চলে এলেন, তিনজনে কুলিকে বাঁধ ধরে অনেকটা পথ গেলাম সঙ্গে নানান গল্প কুলিকের। কথা শুনে মনে হচ্ছিল দাদুর উত্তরাধিকার সূত্রে কুলিককে ভালবাসা বয়ে নিয়ে চলেছেন। ভাবছিলাম আমাদের প্রজন্ম কি আমামদের উত্তরসুরিদের কাছে সেই ভালবাসার বার্তা পৌছে দিতে পারছি। মনে হয় না।

যাই হোক কুলিক দর্শন শেষ করে সন্ধ্যায় এসে পৌঁছালাম দক্ষিণ দিনাজপুরের সোনার অলঙ্কারে সব থেকে বেশী সম্পদশালী এবং জনমনে প্রভাবশালী বোল্লা কালির মন্দির পেরিয়ে এসে বালুরঘাটের কাছে সোদপুর এ। পাকা ধানে ঘেরা বিস্তীর্ণ মাঠে ঘেরা গ্রাম। এই বোল্লা মায়ের আশীর্বাদ পেতে নেপাল, ভূটানসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে মানুষ ছুটে আসেন রাসপূর্ণিমার পরের শুক্রবার। মুল মেলা চলে সোমবারের প্রতিমা ভাশানের পর পর্যন্ত। গত বছর কোচবিহারের এক ভক্ত সোনার রামদা দিয়েছেন। এই গেল বর্তমান সময়ের গল্প কিন্তু আমাদের আকর্ষণ করলো এত অজ গ্রামের মন্দিরের এত প্রচার কীভাবে?

বিশেষ করে কালী পুজো অথচ তা হচ্ছে শুক্রবারে।কেন এমন? জানা গেলে এক লড়াই এর কাহিনী। ১৮৬০ সাল হবে (নির্দিষ্ট সাল সম্পর্কে প্রশ্ন আছে) গ্রামের হাট হয় শুক্রবার করে। গ্রামের মানুষের সপ্তাহের রসদ জোগাড়ের দিন, কেনা-বেচার জীবন চক্র চলে। এদিকে দিনে দিনে নীল কর সাহেবের অত্যাচার বেড়েই চলে হাট বারে এসে যত জোড় জুলুম। গ্রামের মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে একবার দিলেন বেধরড় পিটিয়ে। উত্তজনায় গণধোলাই তো হল, একে সরকারি লোক তাতে আবার সাহেব। গ্রামের মানুষ ভয় পেয়ে ছুটলেন হাটের ধারে ছোট্ট মন্দিরের দেবীর কাছে, মানত করলেন এই বিপদ থেকে উদ্ধার পেলে পরের হাটবারেই সাড়ে সাত হাতের দেবী বোধন হবে। কোনভাবে বিপদ মুক্ত হল গ্রামবাসী, সেই থেকেই এই তিথিতে পূজো। শুধু তাই নয় পুরো মূর্তি তৈরি হয় হাতে কোন ছাঁচের ব্যবহার হয় না। বিশাল এক কাঠামোতে খড়-মাটি লেপে মূর্তি তৈরি হয়। পূজা শেষে চাকা লাগানো কাঠামোকে পুকুরে নামিয়ে দেওয়া হয়। শুধু মর্তির বরাভয় হাত থাকে জলের উপরে।
পথে দেখলাম বানগড়, ধলদীঘির তীরে প্রাচীন পীরের দরগা প্রত্নস্থল আর দেখলাম গঙ্গারামপুরের কাছে বানগড়। মৌর্য বংশ থেকে মুসলিম শাসনকালের অজানা কাহিনী যে ঢিপির মাটিতে চাপা আছে।
আজকের পথে ছোট কয়েকটা খাড়ি ছাড়াও পেরতে হল ছেড়ামতী, টাঙ্গন, পূণর্ভবা। সেই কথা নিয়ে পরে কথা বলছি। শুভরাত্রি।

১৮ নভেম্বর ২০২০ : বেশ কাটলো গতকাল, সন্ধ্যা হতেই শিয়ালের আওয়াজ কখনো দক্ষিণে তো কখনো পূর্বে। জয়ন্ত ইচ্ছা প্রকাশ করলো আওয়াজ শোনালো কিন্তু দেখা দিতেও পারতো। আজ বহরমপুর শহরে তাও উৎসবের মরসুম। আজকের চারিদিকের শব্দ কী হতে পারে সকলের আন্দাজ আছে। সারাদিনের নবান্ন উৎসব শেষে সন্ধ্যায় গ্রামের মন্দিরের সামনে বসলো আড্ডা। বেশীরভাগ মানুষেরা বয়জেষ্ঠ। তাদের স্মৃতির তরীতে আমরা ভেসে চললাম, কখনো খাপুরের তেভাগা আন্দোলনের কাহিনী, কখনো তাদের বাবা-ঠাকুরদার কাছে শোনা হিলি শিয়ালদাহ ট্রেন যাত্রা। হিলি থেকে সকালে বেড়িয়ে কলকাতার কাজ শেষ করে রাতে ফেরা যেত দিনাজপুরের ফুটানিগঞ্জে। ব্রিটিশদের জরিপ জ্ঞান থেকে গ্রামের মন্দিরের প্রাচিনত্বের দাবিতে নানা মত। গ্রামের নতুন মন্দিরে একটি ভাঙা সূর্য মূর্তি আছে। কোন এক ভাবে পেয়েছিলেন তাঁরা মন্দিরে রেখে দেওয়া হয়েছে।

গতকাল খাসপুর, পাগলিগঞ্জ প্রভৃতি জায়গা ঘুরে দেখে এলাম, আত্রাইয়ের পশ্চিমদিকে। বিস্তীর্ণ সাদা বালুচর। লরি আসছে যাচ্ছে ঐ বালিতেই শহর হবে নদী কোন এক পারে। পাগলিগঞ্জে যেতে আগে নৌকার পার হতে হোত এখন ব্রীজ তৈরি হয়েছে। ছয়টা থামের তিনটি দিয়ে জল বইছে বাকি তিনটি বালুচরে। এখনেও দহতে ঝোপ-ঝাড় ফেলে মাছ ধরার পদ্ধতি ব্যবহার করা হ । নদীয়ায় একে কুমর বলে এনারা বলেন কাটা। এটি হল, নদীর একটি স্থানকে প্রথমে বাঁশ দিয়ে ঘেরা হয়। তারপর এই ঘেরা জায়গায় পাতা শুদ্ধু বড় বড় ডাল ফেলা হয় সারি দিয়ে। এমন ভাবে এক-দেড় মাস রাখা হবে। তারপর জল আরো কমলে বাঁশ ঘেরা যায়গায় জাল দিয়ে ঘিরে ডালপালা তুলে মাছ ধরা হবে। অনেক পুরোন পদ্ধতি প্রায় এই সফরের সব জেলার নদীতেই এই ব্যবস্থা দেখলাম। শুধু গঙ্গায় এমন পদ্ধতি নজরে আসেনি। সন্ধ্যার আড্ডার মাঝে বালুরঘাট শহর থেকে বিশ্বজিৎ বসাকদা চলে এলেন সঙ্গে আরেক সাথী। আমাদের তরফে বিডিও স্তরে যে চিঠি পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেই বিষয় প্রয়োজনীয় কথা বলে আমরা আবার গ্রাম আড্ডায় চলে এলাম।

বিশেষ কিছু কারণে আমাদের সফর ছোট করতে হচ্ছে তাই দঃদিনাজপুর থেকে সোজা বহরমপুর। পথে মালিয়ান দীঘিতে বালি হাঁস, গৌড় দীঘি , আলতা দীঘিতে হোয়াট ক্রেস্টেড ইগল (আমরা চিনতে ভুল না করলে) দেখলাম। আলতা দীঘি নিয়ে লোক কথায় আছে, রানীর দাবি তার নিজস্ব এক স্নানের দীঘি চাই । রাজা বললেন, তুমি হেঁটে যতদূর যাবে তত দূর হবে তোমার দীঘি। হাঁটতে হাঁটতে রাণীর পায়ে হল ক্ষত বেড়তে শুরু করলো রক্ত সেই রক্ত ঢাকতে রাণীর পায়ে দেওয়া হল আলতা। সেই আলতায় দীঘির নাম আলতা দীঘি। রাজারবাস যেখানে সেখানে পুরাণের কাহিনীও জুড়ে আছে। এখানে আছে পঞ্চ পান্ডবের কাহিনী। বিরাটরাজার প্রসাদ ছিল এখানেই পান্ডবেরা “সমী গাছ” এ লুকিয়ে রেখেছিল তাদের সমস্ত অস্ত্র। এই গাছ এখনো এই আলতা দীঘির ধারে দাঁড়িয়ে আছে। যোশীমঠে ২৭০০  বছরের প্রাচীন বৃক্ষ দেখেছি কিন্তু এর বয়স কত? জানা নেই। এমন অনেক অজানা আমাদের ঘিরে থাকে প্রতিদিন। শুধু মুখোমুখি হলেই বুঝি আমরা কত, কত কম জানি।

২০ নভেম্বর ২০২০ :  সকালে বহরমপুরে গোরাবাজার ফেরিঘাট থেকে ভাগীরথী পার করলাম। স্থানীয় সাথী সোমনাথ মুখার্জী দেখালেন নার্সিং হোমের বিছানার চাদর ধোয়া হচ্ছে ঐ ঘাটে। নদী পার হতে হতে চিৎকার করে বললো এই ভাবে হবে না তাপসদা কয়েকটা পাগল দরকার স্বাভাবিক মানুষের কাজ নয় নদী বাঁচানো। উত্তেজনার ওম নিতে নিতে নদী পার হলাম। পথে মজা উত্তরাসন (ভুল না করলে) পার করে রাজা শশাঙ্কের কর্ণসুবর্ণ পৌছালাম। আমি আগে কয়েকবার দেখেছি পরিব্রাজকদের বর্ণনা অল্প কিছু পড়েছি। এবার লোহার বেড়ায় ঘেরা মাটির স্তুপে উঠলাম না। জয়ন্ত দা এগিয়ে গেল। ভীষণভাবে বৌদ্ধ দর্শনের অনুরাগী জয়ন্তদার এই স্তুপ দেখার পর মনের অনুভূতি জানা হল না। জগজীবনপুরের বৌদ্ধ বিহার দেখার পর আক্ষেপ করতে শুনেছি বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসের নানা কথায় জাপান, কম্বোডিয়া, শ্রীলংকা জানি কিন্তু আমার নিজের জেলায় এমন প্রাচীন নিদর্শন আছে জানতাম না।

যাইহোক আরো এগিয়ে রামনগরের আগে পিচ রাস্তা ছেড়ে গ্রামের পথ ধরে ‘বাছড়া’য় পৌঁছলাম। এখন গ্রামের পথ মানে কংক্রিটের পথ সেই পথ পেরিয়ে। মাটির পথ বছরের পর বছর চলে মানুষ যে পথ খুঁজে পায় তেমন পথ। ক্ষেতে কাজ করছিলেন এক কাকা। তিনিই চিনিয়ে দিলেন বাবলা আর ভাগীরথী নদী। ভাগীরথী কেমন ভাবে মাটি কেটে কেটে তার প্রবাহ পথ তৈরি করে চলেছে সে কথা বুঝিয়ে দিল। ওনাদের কাছেই প্রথম শুনলাম বাবলা নদী আর ভাগীরথী খুব কাছাকাছি এসেছে। মাত্র তিন ফুটের মাটির দেওয়াল দুই পারে দুই নদী। কুয়ে, দ্বারকেশ্বর, ব্রাহ্মণী, ময়ূরাক্ষী এসে পরে হিজলি বিলে সেই জলরাশি মিলেই সৃষ্টি এই বাবলা নদী। পুরোন রেনেলের ম্যাপে এটি কুয়ে নদীর পুরোন পথ। মাত্র ৪০ কিমি পথ এই নদী চললেও বাংলার অন্যতম বন্যা প্রবণ কান্দি ব্লকেকে বাঁচাতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই নদী।

সম্ভাব্য নতুন মোহনা তৈরী হতে চলেছে এই বাছড়াতে এই খবর এর আগে পাইনি, সোমনাথদার কাছেও খবর ছিল না। নদীতো এমনভাবে নতুন ভূগোল তৈরি করে। আর এই ভূগোল ঘিরেই তৈরি হয় জীব জগৎ, সমাজ তার থেকে ইতিহাস। ভাগীরথীতে বাছড়াতে বাবলা মিশলে বাকি পথটির কী হবে সে বিশেষজ্ঞরা বলবেন। আমাদের বেশ ভালোই লাগলো সম্ভাব্য নতুন মোহনা দেখে। তবে স্থানীয় আর এক কৃষক জানালেন ভাগীরথী এই পথ ছেড়ে পলাশীর দিকে সরে যেতেও পারে। তবে হয়তো বাবলা তার চেনা পথেই থাকবে। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে ফিরলাম একই পথে। বিকেল তিনটায় বহরমপুর ছেড়ে বাড়ি ফিরলাম রাত এগোরোটায়।


আরও পড়তে পারেন…..
মুক্তিযুদ্ধে গড়াই নদী ।। ইমাম মেহেদী
পুনর্ভবা : আমরা তোমার কথা ভাবি
মেঘভাঙা বৃষ্টি ।। ইন্দ্রনীল সুমন
কাকলী প্রধানের আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘নদী নেবে!’

সংশ্লিষ্ট বিষয়