ঢাকার নদীর সীমানা নির্ধারণে বসানো ১৪২৩টি পিলারই ভুল জায়গায়- আরডিআরসি 

ঢাকার নদীর সীমানা নির্ধারণে বসানো ১৪২৩টি পিলারই ভুল জায়গায় স্থাপিত হয়েছে বলে বলছে, নদী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি। আজ ২ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ইমেইলে পাঠনো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

আরডিআরসি বলছে, বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশের জনজীবন, প্রকৃতি, কৃষি সবই প্রায়  নদীকেন্দ্রিক। জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি-শিল্প-সাহিত্য সবকিছুর সঙ্গে আমাদের নদ-নদীগুলোর রয়েছে গভীর সম্পর্ক । তাই বলা হয়, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। কিন্তু দখল,দূষণ আর আমাদের দায়িত্বহীনতার কারণে দেশের অধিকাংশ নদ-নদীর অস্তিত্বই আজ হুমকির সম্মুখিন। সঠিকভাবে নদীর সীমানা চিহিৃত করে সুরক্ষার দায়িত্ব না নেওয়ায় অনকে নদ-নদীই আজ বিলিন হয়ে গেছে। আর যেগুলো বেঁচে আছে, সেগুলোও মরছে ধুকে ধুকে। এই পরিস্থিতে রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে রক্ষায় ৩হাজার ৮৪টি সীমানা পিলার বসিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এরমধ্যে আরডিআরসি’র জরিপ রিপোর্টে দেখা গেছে ১৪২৩টি পিলার ফোরশোর অথবা নদীর মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। আরডিআরসি মনে করে, এই ভুল বা দুর্নীতির মাধ্যমে নদীগুলোকে সরু করা হয়েছে। দখলদারদের আরো দখলের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার, (আরডিআরসি) কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টের প্রচ্ছদ।
জরিপে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীতে ৩১২টি পিলার ভুলভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এরমধ্যে পশ্চিম প্রান্তে ২২৮টি আর পূর্ব প্রান্তে ৮৪টি । তুরাগ নদীতে ১১১১টি পিলার ভুলভাবে স্থাপন করা হয়েছে। এরমধ্যে পশ্চিম প্রান্তে ৭১০টি বন্যা প্রবণ এলাকায় এবং পূর্ব প্রান্তে ৪০৯টি ।

এই ১৪২৩টির বাইরেও কিছু পিলার পাওয়া গেছে যা বিতর্কিত বলে উল্লেখ করেছে আরডিআরসি। যেমন কোথাও বেরিবাধের ঠিক ওপরে যেখানে কখনই নদীর পানি আসে না। আবার একই বেড়িবাধের একেবারে ২০-৩০ ফুট নিচের দিকে পিলার বসানো হয়েছে। এমন বিতর্কিত পিলার পাওয়া গেছে ৩৯০টি।  সরকারের এতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি করা হয়েছে বলে মনে করছে আরডিআরসি।  এসব পিলার দখলদারদের পক্ষে যাবে।

যেভাবে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার-আরডিআরসি তাদের এই জরিপ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন: ২০২০ সালের ১৫-১৭ অক্টোবর রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে আমরা তুরাগ এবং বুড়িগঙ্গা নদীতে নতুন করে যেসব সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়েছে সেগুলো সরাসরি জরিপ করি। এই জরিপের ফলাফল এনালাইসিস করে  এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

২০০৯ সালে যখন মহামান্য হাইকোর্ট একটি যুগান্তকারী রায় দিয়েছিল। সেখানে, ঢাকার চার নদীর দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদীগুলোকে টেকসইভাবে দখলমুক্ত করার জন্য সীমানা পিলার তৈরির নির্দেশনা দেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় তৎকালীন গাজীপুর, ঢাকা এবং নারায়ণগঞ্জের ডিসি মহোদয় বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগে প্রায় ৬হাজার পিলার স্থাপন করেন। এর অধিকাংশ পিলারই নদীতে কিংবা নদীর ধারে এমনভাবে স্থাপন করা হয় যে, এর মাধ্যমে দখলদারদের দখলে আরও উৎসাহিত করা হয়। এটি নিয়ে তুলপাড় হলে টাস্কফোর্সের মিটিংএ একজন ডেপুটি সেক্রেটারির নেতৃর্ত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি ২০১৪ সালে রিপোর্ট দাখিল করেন। সেখানেও বলা হয়, স্থাপন করা পিলারের অধিকাংশই ভুলভাবে স্থাপিত হয়েছে।

এরই প্রেক্ষিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে আবারও নদীর দখলমুক্ত করতে বিআইডব্লিউটিএকে দায়িত্ব দেয়া হয় নদী দখলমুক্ত করে আবার নতুনকরে সীমানা পিলার স্থাপন করতে। এজন্য বাজেট দেয়া হয় প্রায় ৮শ কোটি টাকা। উচ্ছেদ অভিযান হলো। দেশবাসীর মতো  আরডিআরসিও আশা করেছিল ঢাকার নদীগুলো এবার দখলমুক্ত হবে। যখন নতুন করে ১০ হাজার পিলার বসানো শুরু হলো.. এবং কিছু কিছু জায়গায় পিলার বসানো শেষ হলো তখন খবর আসতে থাকলো সেই আগের মতোই ভুলভাবে বসানো হচ্ছে এসব পিলার। এরই প্রেক্ষিতে আরডিআরসি’র নিজস্ব অর্থায়নে  এই জরিপ কাজ পরিচালনা করা হয়।

আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ

এ প্রসঙ্গে আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজরিভার বাংলাকে বলেন, ২০০৯ সালে মহামান্য হাইকোর্টের  যুগান্তকারী রায়ের পর যখন নদীতে সীমানা পিলার স্থাপন করা হলো, তখন আমরা দেখলাম সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। তখন থেকেই আমরা নদীকর্মীরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছিলাম। তারপর দ্বিতীয় দফায়ও যখন নদীতে সীমানা পিলার স্থাপন করা হলো, তখনও একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটলো।আমাদের কাছে স্থানীয়রা এবিষয়ে অভিযোগ করলেন, এবং আমরা নদীতে গিয়েও এর সত্যতা পেয়েছি। বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগের আশুলিয়া ল্যান্ডিং স্ট্যাশন পর্যন্ত প্রায়  ৩৭ কিলোমিটার এলাকা সরেজমিন ঘুরে আমরা এই রিপোর্ট প্রস্তুত করেছি। সবশেষ বর্ষায়ও আমরা দেখলাম, অনেক পিলার পানির মধ্যে আছে। অর্থাৎ সঠিক স্থানে নেই।আমরা লক্ষ করলাম সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পও দায়িত্বহীনভাবে সম্পন্ন করা হলো।অথচ দেশের নদ-নদী সুরক্ষায় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয় পর্যন্ত নদী সুরক্ষায় সোচ্চার। এইযে কিছু লোকের দায়িত্বহীনতার কারনে কাজটি সঠিকভাবে হলো না, রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হলো, এর দায় কে নেবে? আমরা মনে করি, বর্তমান স্থান থেকে পিলারগুলো সরিয়ে সঠিক স্থানে বসানোর এখনও সুযোগ রয়েছে। এবং অবশ্যই তা করা উচিত। আমাদের এই রিপোর্টটি আরডিআরসির ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে।যে কেউ চাইলেই তা দেখতে পারবেন।

আরডিআরস ‘র ওয়েভ এড্রেস-  https://www.rdrc.info/

রিপোর্ট- https://www.rdrc.info/report-on-field-survey-of-the-demarcation-pillars-sat-by-biwta-on-buriganga-and-turagh-rive/?fbclid=IwAR3UQoR3M9djG0-k_8ffQ__cN5fCvqIQCDytM7ODRMGTc4AF9mrSh040uxc


আরও পড়তে পারেন….
রিভার বাংলা’র সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ।। তানভীর আহমেদ তুষার
জীবন-নদী যাত্রা ।। তাপস দাস
মুক্তিযুদ্ধে গড়াই নদী ।। ইমাম মেহেদী

সংশ্লিষ্ট বিষয়