‘নদীর বই: জলের লেখাজোকা’-রিভার বাংলা’র এই আয়োজনের জন্যই পুনরায় পড়লাম কালজয়ী উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। যদি বলি এই প্রথম বার তাও বলা যায়। কেননা এতটা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আগে এই বহুপঠিত উপন্যাসটি পড়িনি। পাঠ্যপুস্তকে এই উপন্যাসের অংশবিশেষ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ শিরোনামে পড়লেও তা তো সমগ্র ছিল না। ছিল অংশ বিশেষ। তাই তার দু-একটি সংলাপ মনের মধ্যে থাকলেও এবার যেন পুরো উপন্যাসটিই বুকের ভেতর ঢুকে এল। যদিও এই উপন্যাস আশ্রিত চলচ্চিত্র (নির্দেশনা: গৌতম ঘোষ) বেশ কিছু বছর আগে দেখেছি। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকের পদ্মা নদীর মাঝি, চলচ্চিত্র পদ্মা নদীর মাঝি আর ক’দিন আগের পড়া পদ্মা নদীর মাঝির মধ্যে ব্যবধান সময়ের দিক থেকে অনেক তাই পূর্ববর্তী বেশী কোন ধারণা স্মৃতি বা মস্তিষ্কে ভার হয়ে ছিলনা। বরং একটা একরৈখিক ইমেজ ছিল মাত্র।
এর আগেই পদ্মা নদীর মাঝি সম্পর্কে বহুপঠিত শব্দটি ব্যবহার করেছি। এবার ‘বহুল জনপ্রিয়’ এই শব্দবন্ধও ব্যবহার করতে চাই। এর কারণ হিসাবে বিশিষ্ট সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বঙ্গ সাহিত্য উপন্যাসের ধারা’তে কি বলেছেন দেখে নেওয়া যাক। তিনি লিখছেন -‘…..ইহার একটি কারণ অবশ্য বিষয়ের অভিনবত্ব -পদ্মানদীর মাঝিদের দুঃসাহসিক ও কতকটা অসাধারণ জীবনযাত্রারও আকর্ষণী শক্তি।দ্বিতীয় কারণ, পূর্ববঙ্গের সরস ও কৃত্রিমতা বিবর্জিত কথ্য ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগ। কিন্ত উপন্যাসটির সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হইতেছে ইহা সম্পূর্ণরূপে নিম্নশ্রেণী অধ্যুষিত গ্রাম্য জীবনের চিত্রাঙ্কনে সূক্ষ্ম ও নিঁখুত পরিমিতিবোধ,ইহার সঙ্কীর্ণ পরিধির মধ্যে সনাতন মানব প্রবৃত্তিগুলির ক্ষুদ্র সংঘাত ও মৃদু উচ্ছ্বাসের যথাযথ সীমা নির্দেশ….’।
পদ্মা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই উপন্যাসকে বলাই যায় একটি সার্থক আঞ্চলিক উপন্যাস। উপন্যাসটির গঠনরীতি,রচনার ধরণ, চরিত্ররা যে ভাষায় কথা বলে,তাদের জীবন-অভ্যাস সবটাই আঞ্চলিকতার বার্তা দেয়। কিন্তু শুধু তার গন্ডী তেই একে আটকে রাখা বোধহয় যায় না।
কিছুদিন আগে পদ্মা নদীর মাঝি নিয়ে আদ্যন্ত একটি আধুনীক মাধ্যম ‘ফেসবুক-এ একটি পোস্ট করেছিলাম যে নদীনির্ভর উপন্যাস গুলির মধ্যে কোনটি তাদের কাছে গ্রহণীয়? তাতে আপাত শহুরে নাগরিক রাও পদ্মা নদীর মাঝির স্বপক্ষেই বেশি মাত্রায় রায় দিয়েছেন। তাহলে বলতে হবে নদীকে কেন্দ্রে সমাজ ও সম্পর্কের এই অনায়াস চিত্রায়ন সব জায়গার পাঠককেই তার দিকে টেনেছে। কুবের,কপিলা, হোসেন,গনেশ, মালা, ধনঞ্জয়, রাসু ইত্যাদি চরিত্ররা যেন জীবন্ত!আমাদের ভীষণ চেনা। ছোটবেলায় এই উপন্যাসের চরিত্র কুবের দের ডায়লগ আমাদের মুখে মুখে ফিরতো।যেমন কুবের হাঁকিয়া বলে,যদু হে এ এ এ -মাছ কিবা?কিংবা যদুর জবাব -জবর। এইসব! কিন্ত উপন্যাসের গভীরতা বোঝার বয়স তো তখন নয়। এখন যেমন কতকটা অনুভব করি। কি অনির্বচনীয় বর্ণনায় শুরু হচ্ছে উপন্যাস!
বর্ষার মাঝামাঝি।পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরসুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোন সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। সন্ধ্যার সময় জাহাজঘাটে দাঁড়াইলে দেখা যায় নদীর বুকে শত শত আলো অনির্বাণ জোনাকির মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। জেলে নৌকার আলো ওগুলি। সমস্ত রাত্রি আলোগুলি এমনিভাবে নদীবক্ষের রহস্যময় ম্লান অন্ধকারে দুর্বোধ্য সঙ্কেতের মতো সঞ্চালিত হয়। এক সময় মাঝরাত্রি পার হইয়া যায়। শহরে,গ্রামে,রেলস্টেশনে ও জাহাজঘাটে শান্ত মানুষ চোখ বুজিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। শেষরাত্রে ভাঙা-ভাঙা মেঘে ঢাকা আকাশে ক্ষীণ চাঁদটি ওঠে।জেলে নৌকার আলোগুলি তখনও নেভে না। নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিষ্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।
কুবের মাঝি আজ মাছ ধরিতেছিল দেবীগঞ্জের মাইল দেড়েক উজানে। নৌকায় আরও দুজন লোক আছে। ধনঞ্জয় এবং গনেশ। তিনজনের বাড়িই কেতুপুর গ্রামে।
এই যে শুরু তাতে পদ্মা,পদ্মার ইলিশ, মাঝিদের কথা এবং যেন পরিষ্কার ভাবে পাঠককে নদীকেন্দ্রিক এই উপন্যাসের বিষয় এবং তার কেন্দ্রীয় চরিত্রের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তারপর একটু একটু করে উপন্যাসের শরীরে প্রবেশ করছে কুবের-গনেশের ভালবাসা মাখা বন্ধুত্বে, হোসেন মিঞার মতো চরিত্র,ষড়যন্ত্র, কপিলার প্রতি আদিম আকর্ষণ, মালার অসহায়তা,নকুইলার নিষিদ্ধ ‘ইঙ্গিত’, অভাব আর গরীবিয়ানার ফাঁক দিয়ে একটু ভাল থাকতে চাওয়ার ইচ্ছা এইসব।
একনাগাড়ে পড়ে শেষ করবার পর আমার প্রথম অভিব্যক্তি ছিল ‘এভাবে লেখা যায়?!’ অবশ্যই স্বগোতোক্তি। তবুও তা বাইরে প্রকাশ হয়ে যায়। পদ্মা নদীর মাঝি একটি চরম বাস্তববাদী উপন্যাস। কিন্তু তার শেষটা ফিকশনধর্মী। যেখানে কপিলা কুবেরকে বলছে -আমারে নিবা মাঝি লগে?
একই সাথে এই উপন্যাস সামাজিক,নিরীক্ষামূলক এবং মনোসমীক্ষণ সম্পর্কিত। প্রথমে ১৯৩৪ সাল থেকে সঞ্জয় ভট্টাচার্য্য সম্পাদিত পূর্বাশা পত্রিকায় এবং তারপর ১৯৩৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত এই উপন্যাস নদীরও আবার নদীমানুষেরও।এত বিস্তৃত এবং গভীর ভাবে বিধৃত এই কথন যে সমাদর পাবেই তা বোঝাই যায়। আবার অনুবাদের দিক থেকেও এটি ‘অটোমেটিক চয়েস’।
১৯৪৮ সালে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ‘Boatman of the Padma’ নামে প্রথম ইংরেজী অনুবাদ করে। এছাড়াও এই উপন্যাস ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা সহ হাঙ্গেরিয়ান, চেক, রুশ, লিথুয়ানিয়ান, জার্মান, ডাচ ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে। উপন্যাসে পদ্মার বিশালতা ও জলহীনতার কথা,মাছের অপ্রতুলতার কথা থাকলেও নদীর সঙ্কট কিংবা নদীর সঙ্কটের গভীরতা আবর্তিত হয়নি। পদ্মার দুর্দশা কেতুপুর, দেবীগঞ্জ গ্রামগুলির বাসিন্দাদের ভবিষ্যৎ জীবনকেও কিরূপ প্রবলভাবে আক্রমণ করবে তার মুহুর্মুহু বর্ণনা না থাকলেও এটা প্রবল ভাবেই নদীর উপন্যাস। যে নদীকে ঘিরে মানুষ আবহমানকাল ধরে জীবন এবং যাপন করছে। উপন্যাস শেষ করে হোসেন মিঞার ময়নাদ্বীপে কুবের, কপিলাদের সাথে যেতে ইচ্ছে করে ঠিকই তবে আরও ইচ্ছে করে নদীর বুকে ভেসে থাকতে, নৌকার আলোগুলির সাথে কথা বলতে আর সারারাত ধরে পদ্মার জলের গন্ধ নিতে। পাঠ করবার পর আজ দশদিনের বেশি অতিক্রান্ত। তবু অনুভব করি পদ্মার হাওয়া লাগছে গায়ে,চোখে,মুখে আর মনেও। সত্যিই ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ আমাকে পদ্মাতেই নিয়ে ফেললো। ইচ্ছে হচ্ছে এবং প্রবল ভাবেই হচ্ছে এবার বাংলাদেশে গেলে বিক্রমপুর-ফরিদপুরে পদ্মা নদীর কাছে সবার আগে গিয়ে চুপ করে বসবো, নৌকার আলোতে চিনে নিতে চেষ্টা করবো জলের মন আর ওদেরকেই জিজ্ঞেস করবো নদীর সন্তান মানিককে ওদের মনে পড়ে কিনা!