নদীতো নানাভাবে জীবনের কথাই বলে। জীবনের সাথে নদীর জুড়ে থাকার এক টুকরো উদাহরণ নদিয়া জেলা। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় মাঝামাঝি তার অবস্থান। নদিয়া নাম কেন হল? অনেক পণ্ডিতেরা বলেন নদী থেকেই নদিয়া নাম। এক সময় জেলাটাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল একটা লোক ছড়া। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদয়ে(নদিয়াতে) এল বান’। নদ-নদীতে ভর্তি ছিল নদিয়া জেলা। এক পা এগোলেই একটা করে নদী পড়তো।
নদী যেহেতু আমার যাপন সংসার, তাই প্রথমে শুরু করেছিলাম অঞ্জনা নদীকে খোঁজার কাজ। রবীন্দ্রনাথের নামের সাথে যুক্ত হয়ে থাকা এক নদী। শুরু রবীন্দ্রনাথ কেন!নজরুল, মাইকেল মধুসূদন সকলেই অঞ্জনার রূপে মোহিত হয়েছিল। এই ভাবেই শুরু হল নদিয়ার নদী নিয়ে খোঁজা খুঁজি।
জেলার একদিকে ভাগীরথী নদী, জেলার ঠিক মাঝামাঝি বয়ে গেছে জলঙ্গি নদী, আর জেলার প্রান্ত দিয়ে মাথাভাঙা, ইছামতী আর চূর্ণী। এরা সকলেই নদিয়ার নদী। সাহেবরা এই সব নদী গুলোকে একসাথে বলতেন ‘নদিয়া রিভার্স’।
উনিশ শতকের প্রথম দিকের সাহেবদের অনুসন্ধিৎসা ও তাদের গবেষনা থেকে নানা তথ্য পাওয়া যায়, বাংলা তথা নদিয়ার নদীগুলোকে নিয়ে। তাদের কাজগুলো মূলত ধরা আছে নানা রিপোর্টের মধ্যে। এছাড়াও নানা মানচিত্রেও সাহেবরা নদীদের গতিপথকে এঁকেছেন। আসলে তাদের নদীর গতিপথ বোঝার পেছনে ছিল মূলত বাণিজ্যিক কারণ। ব্যারস(১৫৫০) গ্যাসাটালডি(১৫৬১) ব্লেভ(১৬৬০) উইট(১৭২৬) টিরিয়নস(১৭৩০) ডেলিসলি(১৭৪০) এনভিন(১৭৫২) কিটচিন(১৭৬০) রেলেন(১৭৭৬) টাসিন (১৮৪০), এরা সকলেই নির্মাণ করেছিলেন নদী বাঙলার নদীর মানচিত্রকে। এই মানচিত্রগুলো নদী গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের কাছে বড় উপাত্য।
বড় নদীর কথাতো হামেশায় জানা যায়। কিন্তু ছোট নদীর কথা। কখনো উল্লেখ হয়। আবার কখনো হয় না। এই ছোট বড় সমস্ত নদী মিলেই নদিয়ার নদী সংসার। এই সংসারে ছিল পাগলাচন্ডী, ছোট গঙ্গা, সাতকুলি, চকাই, ছোট চকাই, যমুনা, মরালী, ভৈরব, ভৈরববাঁকি, কুমারী, হাউলিয়া, ছোট জলঙ্গি, খোড়ে, কলিঙ্গ, ঝোড়, অঞ্জনা, অলকানন্দা, ইন্দুমতী, বাঁচকো, সুরধনী, হরিনদী। এরা সকলেই বড় নদী গুলকে কেউ জল দিত, কিংবা কেউ জল নিত। এই নেওয়া দেওয়াতেই কেউ হতো উপনদী কেউ বা শাখা নদী। বন্যা নিয়ন্ত্রণে এদের একটা ভূমিকা ছিল। যত দিন গড়াল তত ছোট নদী গুলোর গুরুত্ত্ব মানুষের মন থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করল।
নদীর মরে যাবার পেছনে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল পাড় বাঁধ বা এমব্যাঙ্কমেন্ট। সেচ বিজ্ঞানী উইলকক্স সাহেব নদী পাড়ের বাঁধকে বলেছিলেন ‘শয়তানের শৃঙ্খল’। নদী মারার যেন এক অস্ত্র। এক সময় বেশ অনেক গুলোয় রায়তী বাঁধ ছিল। যেগুল দেখাশোনা করত স্থানীয় জমিদারেরা। যার মধ্যে নওদা বাঁধ, চন্দননগর বাঁধ, গড় শান্তিপুর বাঁধ, মোরাঘাটা বাঁধ,পাবাখালি বাঁধ, জলঙ্গি বাঁধ, শ্যাকরাখালি বাঁধ উল্লেখযোগ্য। প্রথমের দিকে বাঁধ তৈরি হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে মাথায় রেখে। যে করেই হোক বন্যাকে রুখতেই হবে। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও বন্যাকে নিয়ন্ত্রন করার পরম্পরা কে আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারেনি। আর সেই কারণেই নদী মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়েছে।
নদী থাকলে তো ভরা শ্রাবণের বর্ষায় বন্যা আসে। তখন নদী নতুন জীবন পায়। বাঁচার আশ্বাস পায়। নদিয়ার নদীরা দেখেছে বন্যার সাত কাহন। ১৯৫৬,১৯৭৮,১৯৯৯,২০০০, ২০০৬ এই রকম অনেক গুলো বন্যা দেখেছে নদিয়া জেলা ও পলি দিয়ে তার শরীর গড়া নদীরা।
নদিয়ার খাল বিল পুকুর ও কিন্তু কম নেই। কত সুন্দর তাদের নাম। পোলতার খাল, গুড়গুড়ে খাল, পীরতলার খাল, খাল বোয়ালিয়া খাল, রাণীনগর খাল, অভয়নগর খাল, চিংড়ির খাল, ধরকুটোর খাল, রামজীবনপুর খাল, পীথভাঙ্গা খাল ইত্যাদি। আবার পুরো জেলা জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন হাঁসাডাঙ্গা বিল, ভালুকা বিল, জিধা বিল, শুকনির বিল, ভাসানির বিল, সরডাঙ্গার বিল, বান্দার বিল, আভাংগীর বিল, পিপুলবেরিয়া বিল, খোলসী বিল ইত্যাদি।
এই রকম খাল বিল নদী নালা নিয়ে তৈরি হয়ে উঠেছিল, অনেকটা মনের অজান্তেই ‘নদীয়ার নদী ও জলাভূমি কথা’।বইটা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। প্রকাশক ছিল কলকাতার বই পাড়ার জে.এন.চক্রবর্তী অ্যাান্ড কোম্পানি। এই বছর বইটা ১০ বছরে পা দিল।