বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, বর্তমানের যে জলবায়ু সংকট তা মানবসৃষ্ট। নানাভাবে আমরা পরিবেশকে নষ্ট করছি। সংরক্ষিত বনাঞ্চলগুলো বিভিন্ন লাভজনক প্রকল্পের আওতায় এনে প্রতিনিয়ত তা ধ্বংস করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছি। ১৭ নভেম্বর, শুক্রবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপি জলবায়ু ন্যায্যতার দাবিতে সমাবেশের প্রথম দিনের উদ্ভোধনী আয়োজনে সভাপতির ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, এই সমাবেশ থেকে নিজেদের করণীয় খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু সংকটের জন্য দায়ি ধনী দেশগুলোকে জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণে বাধ্য করতে সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
জলবায়ু ন্যায্যতার দাবিতে রাজধানীর স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধেশ্বরী ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী সমাবেশের প্রথম দিনের কর্মসূচি শুরু হয় বর্ণাঢ্য র্যালির মধ্য দিয়ে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি বক্তব্য রাখেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ফাতিনাজ ফিরোজ। মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন এশিয়ান পিপলস্ মুভমেন্ট অন ডেট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এপিএমডিডি)’র সমন্বয়ক লিডি ন্যাকপিল ও ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুরশীদ। সঞ্চালনা করেন সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল।
সমাবশে বক্তৃতা করেন জাপান প্রতিনিধি মাকিকু আরিমা, নেপাল প্রতিনিধি অর্জুন কারকি, ‘তারা ক্লাইমেট ফাউন্ডেশন’এর ডেপুটি রিজিওনাল প্রোগ্রাম ডিরেক্টর কাইনান হাউটন, ইউএনডিপি’র সহকারী আবাসিক প্রতিনিধি আনোয়ারুল হক, সিইআর প্রতিনিধি চৌধুরি মোহাম্মদ শাহরিয়ার আহমেদ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, আইইইএফএ’র প্রতিনিধি শফিকুল আলম, কোস্ট ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী, সিপিআরপি’র প্রধান নির্বাহী মো. শামসুদ্দোহা, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক মীর মোহাম্মদ আলী ও রিভার বাংলার সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ প্রমূখ।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর বিশিষ্ট জলবায়ু বিশেষজ্ঞ সলিমুল হকের জন্য একমিনিট নিরবতা পালন করা হয় ও তার স্মৃতিচারণ করেন সাকিবুর রহমান সাকিব হক।
সমাবেশের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ দূত এমপি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে কম দায়ীরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে। আবার যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ, জলবায়ু অভিযোজনে তাঁরাই সবচেয়ে কম সক্ষমতা সম্পন্ন। তাই এই সংকট মোকাবেলায় জলবায়ু ন্যায্যতার দাবি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণে ধনী দেশগুলোকে বাধ্য করতে সম্মিলিত অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
এপিএমডিডি’র সমন্বয়ক লিডি ন্যাকপিল বলেন, বিজ্ঞানীদের ধারণার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি গতিতে জলবায়ু পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে। আমাদের পৃথিবীর গড় তাপমাত্রার ১.৫ ডিগ্রীর মধ্যে রাখার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিলো, ধনী দেশগুলো ক্রমাগত কার্বন নিঃসরণের ফলে তা আপাতদৃষ্টিতে প্রায় অসম্ভব। ২০৫০ সালের মধ্যে আমাদের কার্বন নিউট্রাল হওয়ার কথা থাকলেও আমরা এখনো সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের ধারে কাছেও নেই। আগামী দুই-তিনটি বছর আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে ধনী দেশগুলোকে বাধ্য করতে হবে।
সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব শরীফ জামিল বলেন, ভ্রান্ত উন্নয়ন নীতির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার প্রতি চরম অবহেলার সংস্কৃতি তৈরী করছি। এমতাবস্থায় এই সম্মেলনের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী স্বার্থন্বেষী মহলকে একটি বার্তা পৌছে দিতে চাচ্ছি। যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের ক্ষোভ ও দুর্দশার কথা তুলে ধরবে। ভবিষ্যতের অপ্রত্যাশিত আসন্ন সংকট প্রতিহত করতে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান তিনি।
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, সঞ্জীব দ্রং বলেন, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ শতাংশ জনগোষ্ঠী হচ্ছে আদিবাসী। এতদসত্বেও, এই পৃথিবীর মোট জীববৈচিত্রের ৮০ শতাংশ রক্ষা করে আদিবাসী জনগোষ্ঠীরা। উন্নত বিশ্বের অপরিণামদর্শী উন্নয়ন দর্শন আমাদের মতো দেশগুলোর বাস্তুসংস্থানকে চরমভাবে আহত করেছে। বিশেষ করে আমাদের আদিবাসি জনগোষ্ঠি খুব বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
উদ্বোধনী পর্ব শেষে মোট চারটি অধিবেশন – ‘জীবিকা, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব’, ‘বিশুদ্ধ শক্তি, জল এবং কর্মসংস্থানের অধিকার: জীবাশ্ম জ্বালানী প্রকল্পের সম্প্রসারণের প্রভাব’, ‘বদ্বীপ বাস্তুতন্ত্রের উপর প্রভাব ও সর্বশেষ জলবায়ু ন্যায্যতায় তরুণদের ভাবনা’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সকল আলোচনায় বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থ মানুষদের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৮) উপলক্ষে আয়োজিত প্রথম দিনের এই আলোচনায় দেশি-বিদেশি সহস্রাধিক অংশগ্রহণকারী যোগদান করেন। শনিবার বেলা ৩টায় ঘোষণাপত্র গ্রহণের মধ্য দিয়ে এই সমাবেশ শেষ হবে।
সমাবেশের আয়োজকবৃন্দ: ব্রতী সমাজ কল্যাণ সংস্থা, গণসাক্ষরতা অভিযান (সি এ এম পি ই), সেন্টার ফর আত্মস্ফেরিক পলিউশন (সি এ পি এস), স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট (সি পি আর ডি), কোস্ট ফাউন্ডেশন, গ্লোবাল ল থিংকার্স সোসাইটি (জি এল টি এস), ইন্ডিজিনাস পিপলস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস (আই পি ডি এস), লোকাল এনভায়রনমেন্ট ডেভেলপমেন্ট এন্ড এগ্রিকালচার সোসাইটি (লিডার্স),ন্যাশনাল রিভার আলাইন্স, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস, এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ (ডাব্লিউ কে বি)।
জাতীয় সহ-আয়োজক: বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম, বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজ (বি এ আর সি আই কে), এনভায়রনমেন্ট রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ই আর ডি এ), রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আর ডি আর সি), রিভার বাংলা ও নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এনডিএফ)।
আন্তর্জাতিক সহ-আয়োজক: এশিয়ান পিপলস মুভমেন্ট ফর ডেপ্ত এন্ড ডেভেলপমেন্ট (এ পি এম ডি ডি), এশিয়ান এনার্জি নেটওয়ার্ক (এ ই এন), জাপান সেন্টার ফর এ সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোসাইটি (জে এ সি এস ই এস), ৩৫০.ওআরজি সাউথ এশিয়া, ওয়েল চেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল (ও সি আই) (TBC), ইন্সিটিউট অফ এনার্জি ইকোনমিক্স এন্ড ফিনান্সিয়াল এনালাইসিস ( আই ই ই এফ এ), এল ডি সি ওয়াচ, গ্লোবাল গ্যাস এন্ড অয়েল নেটওয়ার্ক, ইউ এন ডি পি বাংলাদেশ এবং ওয়াটারকিপার এলায়েন্স।
আরও পড়ুন…