আমার শৈশবের তুরাগ এখন অর্ধমৃত! ।। মোহাম্মাদ এজাজ

তুরাগ

দেশের অনেক নদীই আজ তার ঐতিহাসিক নাম হারিয়ে যেন এক নামে উপনীত হয়েছে- সেটি হলো ‘মরা নদী!’ একটি নদী মরে গেলে শুধু নদীই মরে না, তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনসংস্কৃতিও মরে যায়! জনসাধারণের জীবিকা নির্বাহের প্রতিবন্ধকতা, নদীমাতৃক এলাকায় মরুকরণ, জীববৈচিত্র্যের বিপন্নতাসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। দেশের সেই সব মরণাপন্ন নদীর একটি তুরাগ।

দখল, ভরাট আর দূষণে ‘নিখোঁজ’ হতে চলেছে তুরাগ নামের এই নদটি। এটিই  আমার শৈশব ও কৈশোরের কহর দরিয়া। শৈশবে এই তুরাগই আমার উচ্ছলতা ও চঞ্চলতার নেপথ্যে ছিল। এটিই আমার ভালবাসার নদ। প্রিয় তুরাগ, আদালতের রায়ে জীবন্তসত্তা তুরাগ।  আমার জন্ম ও তার পরে দীর্ঘ চার দশক সময় ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠা এই নদের অববহিকায়। তুরাগ নদের পাড়ে ফুটবল খেলা, বৃষ্টিতে নদীতে ডুবানো, সাঁতার কাটা, বিকেল ও সন্ধ্যায় বটগাছতলায় গান-বাজনা ছিল নিত্যকর্ম। এই নদকে ঘিরে আরেকটি মজার স্মৃতি হচ্ছে প্রতি কোরবানীর ঈদের আগে এ  নদ দিয়েই যমুনার চর যেতাম কোরবানীর গরু কিনতে। আর এ দিনটির জন্য আগ্রহ সহকারে অপেক্ষা করতাম। এ কাজটি এখনো অব্যাহত আছে।

একদিকে ঢাকার নগর জীবনের জনবহুলতা বৃদ্ধি, তার সাথে বিশাল জলাধার সমৃদ্ধ তুরাগের জলরাশি ও জোয়ার ভাটার প্রাভাবে সুন্দর তুরাগ আমার মানবিক বিকাশকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। যদিও তুরাগ এখন দখল-দূষণের কারণে ইকোলোজিক্যালি সংকটাপন্ন অবস্থায় ধুঁকছে।বর্ষাকালে জীবন্ত থাকলেও শীতকালে মরে যায়। এর জন্যই আমি বলছি আমার প্রিয় তুরাগ এখন অর্ধ মৃত।

৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ তুরাগ ঢাকা শহরের অন্য নদীগুলো থেকে ভিন্ন চরিত্রের। তুরাগ সাতটি নদীর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলায় বংশী নদী থেকে তুরাগের উৎপত্তি। মধুপুরের জঙ্গলের নিচু অঞ্চল থেকে উৎপন্ন তিন নদী- শালদহ, লবন্দহ, গোয়ালিয়া (গোয়ালার) তার পানি নিয়ে কালিয়াকৈর এলাকায় এসে তুরাগকে সারা বছর পানি দিয়ে থাকে। এদিক থেকে এই তিনটি নদী তুরাগের উপনদী।

আশুলিয়া- টঙ্গী অঞ্চলে এসে তুরাগের শাখা নদী টঙ্গী খাল (সরকারি নাম) টঙ্গী বাজার দিয়ে তেরমুখ হয়ে বালূ নদীতে মিলেছে। গণমাধ্যমে এই নদিকে তুরাগ নামেই আখ্যায়িত করা হয়। এই চ্যানেলের তীরেই তাবলীগ জামায়াতের ইজতেমার আয়োজন হয়ে থাকে। এদিক থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ টঙ্গী খাল/নদী তুরাগের একটি শাখা নদী। তুরাগের উপত্যকা টঙ্গী খালের সংযোগস্থল পর্যন্ত প্লাবনভুমি গ্রাস করেছে। ধারণা করা হয়ে থাকে, ১৯৫০ সালের আসাম ভূমিকম্পের পর এই পরিবর্তন।

তুরাগ এখন অর্ধমৃত! : ছবি লুৎফর রহমান

ঢাকা শহরের জলবায়ু ও তাপমাত্রার ক্ষেত্রে তুরাগের ভুমিকা অনন্য। কারণ, এর ভৌগোলিক চরিত্র। তুরাগ নদের আকারে মিয়ান্ডারিং (আকা বাঁকা) চরিত্র তুরাগকে এক অসাধারণ সৌন্দর্য দান করেছে। ঢাকার পাশে আর কোন নদীতে এত সুন্দর আঁকাবাঁকা জলরাশি দেখা যায় না। তুরাগ অন্য নদীর মত শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক জলধারা নয়। আগেই বলেছি তুরাগের আফটেক এ প্লাবন ভূমি টঙ্গী পর্যন্ত বিদ্যমান। টঙ্গী-আশুলিয়া থেকে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত তুরাগে ৫ টি বড় বিল (ফ্লাড প্লেইন) তুরাগকে ইকোলজিক্যালি অনেক সমৃদ্ধ করেছে। আশুলিয়া বিল, টঙ্গী বিল, বিরুলিয়া বিল, কাউন্দিইয়া বিল, গাবতলি বিল তুরাগকে মাছ ও অন্যান্য জলীয় সম্পদে সমৃদ্ধ করেছে।

এই পাঁচ বিলের পানি ১৯৮৮ সালের বন্যার পরেও শ্যামলীর হকসাহেবের গ্যারেজ, কল্যাণপুর খাল, দারুসসালাম থেকে শুরু করে সাভার পর্যন্ত নদীর পানিতে ভরে যেত। তুরাগের এই বিশালতার জন্যই তুরাগ কে স্থানীয় পুথি সাহিত্যে কহর দরিয়া নামেও ডাকা হয়। কহর শব্দটি ফার্সি থেকে বাংলায় ও উর্দুতে ব্যাবহার হয়। এর দুটি অর্থ: অধীক (সাদীদ) গোসসা, কোথাও ফার্সিতে সমুদ্র/দরিয়া অর্থে ও ব্যাবহার হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কহর দরিয়া মানে বিশাল দরিয়া বা সমুদ্রের ন্যায় প্রাবাহমান তুরাগকেই স্থানীয় সাহিত্যে নামকরণ করা হয়েছে।

৯০ এর দশকের শেষদিকে ও ২০০৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা ও আশেপাশের মানুষজন সপরিবারে আশুলিয়ার রাস্তায়, বেড়িবাঁধে উত্তাল নদীর ঢেউইয়ে আছড়ে পড়া দেখার জন্য আশুলিয়া অঞ্চলের তুরাগ পাড়কে মিনি কক্সবাজার বলেও সম্বোধন করতো। পরবর্তীতে নদীর পাড়, জলাভূমি ভরাট ও বেড়িবাঁধের অংশে অনেক ফ্যাক্টরির অবৈধ দখলের কারণে এর সুন্দররাজ্য নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৯০সালের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ বানানোর পরে তুরাগকে ঢাকার জলাভূমি, ও নিচু ভুমি থেকে পৃথক করে এর ব্যাপকতাকে সংকুচিত করা হয়। ঢাকার চিড়িয়াখানা ও বোটানিক্যাল গার্ডেন ছিলো তুরাগ পাড়ে। বেড়িবাঁধের মাধ্যমে তুরাগকে এই বন্ধন থেকে ছিন্ন করা হয়। উত্তরার আবাসন প্রাকল্পের ভরাটের কারণে আনেক পুরাতন একটি নদী ‘কনাই নদী’ (যার গতিপথ এখনো দিয়াবাড়ি খাল দিয়ে কিছুটা দেখা জায়) নিখোঁজ হয়ে যায়। ‘কনাই’ টঙ্গি খাল থেকে বের হয়ে এয়ারপোর্ট এর পিছন দিয়ে তুরাগের সাথে মিলিত হয়েছিলো।

এখনো তুরাগের এই পাঁচটি বিলের অস্তিত্বের কারণে পশ্চিম ঢাকা তথা উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মধুবাজার, পশ্চিম ধানমন্ডি, হাজারীবাগ এলাকার তাপমাত্রা মধ্য ঢাকার তাপমাত্রা থেকে তুলনামূলক কম। যারা এই এলাকাগুলোতে থাকেন বা আসাযাওয়া করেন তারা এটা অনুভব করতে পারবেন। এবং এর কারণ হচ্ছে পাঁচটি বিল সমৃদ্ধ তুরাগের পানি। এখনো বর্ষায় তুরাগের পাড়ে গেলে সাভার পর্যন্ত তুরাগের পানির বিস্তৃতি প্রত্যক্ষ্য করা যায়। এই প্লাবন ভূমিকে রক্ষা না করলে ঢাকা ও সাভার অঞ্চলের মানুষ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।

প্রয়োজনে ভূমি একুইজিশন করে হলেও বিলগুলোকে সরকারি সম্পত্তির আওতায় এনে এগুলো রক্ষা করা উচিৎ। অন্যদিকে বিআইডাব্লিউটিএ এর দ্বিতীয় ফেইস এ যখন তুরাগের সীমানা পিলার তুরাগের পশ্চিম দিকে বিলের মধ্যে দেয়া হবে তখন বিলের মধ্যে ভূমির মালিকরা তাদের নিচু জমি ভরাট করে বা হাউজিং কোম্পানিগুলোকে দিয়ে নদীর ফ্লাডপ্লেইনকে ধ্বংস করেদিতে পারে। প্রকল্পের এই বিষয়টি মাথায় না রাখালে নতুনভাবে তুরাগকে মেরেফেলাই হবে এই প্রকল্পের সাইড আউটকাম বা ফলাফল। নদী থেকে নদীর সংযুক্ত পাঁচটি বিলকে কোনভাবেই আলাদা করে ফেলা যাবে না। কারণ এগুলো নদীরই অংশ।

তুরাগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে তুরাগ ছিলো মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ। প্রচুর ফ্লাডপ্লেইন বিল থাকায় ঢাকার মাছের জোগান এক সময় এই তুরাগ থেকেই করা হতো। বিগত ২০ বছর ধরে গাজীপুর ও ইপিজেডের শিল্পের দূষণের আগে এখানকার স্থানিয়রা তুরাগের পানি খাবার জন্য ও বাসার কাজের জন্য ব্যাবহার করতেন।  আর বড় বড় মাছ ও বিভিন্ন জাতের ছোট মাছের অভয়ারণ্য তুরাগ থেকে যে প্রচুর মাছ ও নদীনির্ভর জেলে জনগোষ্ঠী ছিলো তা কাউন্দিয়ে, বিরুলিয়া ও হিজলা অঞ্চলের জেলেদের গ্রামের উপস্থিতি এখনো লক্ষ্যনিয়। এবং এই অঞ্চলে মাছ ধরা, মাছ ও কৃষি শস্য নির্ভর উপহার আদানপ্রাদান, পিঠা, মেলা, উৎসবের প্রচলন অত্র বেসিন এলাকায় এক স্বকীয় কালচার এখনো বিদ্যমান।

ধলেশ্বরী নদীর একটি শাখা নদী কর্ণতলী (স্থানীয়ভাবে অনেকে পুরাতন বংশী ও বলে থাকেন) তুরাগে এসে পড়েছে। এই চ্যানেল দিয়ে প্রচুর পানি এসে থাকে। তুরাগ চারটি উপনদী, ও ৩৯ টি খাল (টঙ্গির অংশ বাদ দিয়ে) থেকে সারাবছর পানি সোরসিং করে থাকে। এবং এই সকল পানি নিয়ে তুরাগ বুড়িগঙ্গাকে তার সমগ্র পানি ও সেডিমেন্ট দিয়ে ফিড করেথাকে। মূলত বুড়িগঙ্গার উঠস হচ্ছে তুরাগ নদ। বছিলা অঞ্চলের ঘাটারচর মউজার পর থেকে ও খোলামোড়া ঘাটের কিছুটা উপর থেকে বুড়িগঙ্গার সীমানা ধরা হয়। হাইকোর্টের রীট পিটিশন ৩৫০৩/২০০৯ এর রায়ের পরে নুতন জরিপে খোলামোড়া ঘাটের কিছুটা আপ থেকেই বুড়িগঙ্গার সীমানা ধরা হয়ে থাকে। এই হিসেবে বছিলা ব্রিজ তুরাগ নদের উপরেই অবস্থান। অনেকেই বছিলা ব্রিজ থেকে বুড়িগঙ্গা ধরে থাকেন , তা ভুল। মূলত তুরাগ ও্যাসপুর, ও ঘাটারচর মউজার পরে সি এস দাগ ১৭৫৩ এর দক্ষিন দিকের নিচে খোলামোড়া ঘাটের কাছ থেক শুরু হয়ে সদরঘাট হয়ে জাজিরার দিকে প্রাবাহিত হয়েছে।

দুষিত বুড়িগঙ্গার কথা বললে এর প্রধান কারণ তুরাগের পানিকে বাদ দিয়ে চিন্তা করাটা হবে মস্ত বড় ভুল। কারণ তুরাগের পানিদিয়েই বুড়িগঙ্গার উথপত্তি। গাজিপুরের ইপিজেড, ও শিল্পাঞ্চলের দুষিত পানি, বিশেষ করে লবনদহ নদী থেকে আসা দূষিত শিল্প বর্জ্য, আশুলিয়া অঞ্চলের অপরিশোধিত  ফ্যাক্টরির পানি, এবং ঢাকা ওয়াসার খাল দিয়ে আসা দূষিত পানি দিয়ে তুরাগের পানি ও ফ্লাডপ্লাইন/বিল গুলোকে একদম হত্যাকরে প্রথমে তুরাগ ও পরবর্তীতে বুড়িগঙ্গার ইকোলোজিকে হত্যা করা হয়েছে প্রায় দুই যুগ ধরে। হাইকোর্টের রীট পিটিশন ৩৫০৩/২০০৯ এর রায়ে তুরাগকে ইকোলোজিকালি ক্রিটিকাল এরিয়া ঘোষণা করে এর দ্রুত ব্যাবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও এখনো এর দূষণ রোধে কোন কার্যকর ব্যাবস্থা নেয়া হয় নাই। আমরা আশা করব, এখনই ঢাকার এই নদীকে রক্ষার জন্য সরকারকে ও এর সাথে জড়িত সকলে এগিয়ে আসবেন।

লেখক:  মোহাম্মাদ এজাজ : চেয়ারম্যান, রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আর ডী আর সি)

আরও পড়তে পারেন…..
বানের পানি চোখের জল একাকার!
যে জলে জীবন জ্বলে ।। রেজাউল করিম
নদীস্নানের পর কিছু একলা মুহূর্ত ।। হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার শৈশব নদী ।। হামিদ কায়সার

সংশ্লিষ্ট বিষয়