ঘুসকি, একটি সম্ভাবনার নাম ।। কৌশিক বিশ্বাস

ঘুসকি

অন্তঃদেশীয় জলাভূমির ক্ষেত্রে অবিভক্ত দিনাজপুর এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। বর্তমান দিনাজপুরে হারিয়ে গেছে অনেক নদী। আজ আমরা আত্মবিস্মৃত আমাদের হারিয়ে যাওয়া নদীর ইতিহাস নিয়ে। এরকম অনেক নদী পরিণত হয়েছে খাঁড়িতে। ঠিক এমনই একটি নদী ঘুসকি। ইংরেজ সমীক্ষক মন্টেগোমারি মার্টিন ১৮০৮ সাল নাগাদ তাঁর সমীক্ষাপত্রে এই ঘুসকি নদীর উল্লেখ করেছেন।

এই ঘুসকি নদীই বর্তমান সময়ে ঘুপসি খাঁড়ি নামে বহুল প্রচলিত। ঘুসকি নদীর গতিপথ আমাদের আশ্চর্য করে। এই নদীর প্রাচীন ইতিহাস নি:সন্দেহে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সামনে আমাদের দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ফুলবাড়ি দিয়ে গোপালবাটি, অমৃতখন্ড, চিঙ্গিশপুরে এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

এই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতে ঘুসকির তীরে এমন বহু গ্রাম আছে যে সমস্ত গ্রামের নাম শুরু হয়েছে চক শব্দটি দিয়ে। চক অর্থাৎ নদী তীরবর্তী চর থেকে যে ডাঙ্গার উদ্ভব হয় এবং কালক্রমে সে স্থান বসতিপূর্ন হলে স্থাননামের আগে এই চক কথাটি যুক্ত হয়। এই ঘুপসির পথে এমন অনেক গ্রাম আছে যা এই চক শব্দটি দিয়ে শুরু হয়েছে যেমন চকমাধব, চকতাহের, ইত্যাদি। সুতরাং আমরা এই ঐতিহ্যবাহী নদীর বিভিন্ন সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলির প্রতি আলোকপাত করে এর গুরুত্ব বিষয়ে অবহিত হব।

ঘুসকি নদী
ঘুসকি নদী : ছবি- কৌশিক বিশ্বাস

তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘুসকির গতিপথ জলপূর্ণ অবস্থায় থাকে। গ্রীষ্মকালের তিনমাস সময় বাদ দিলে মোটামুটি গতিপথে জল থাকে। বর্তমান সময়ে কামারপাড়া, বাদামাইল, কুড়মাইল, হরিপুরের গতিপথ একশো দিনের কাজের মাধ্যমে সংস্কারের ফলে এই জলস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে। সারাবছর এই জলকে ব্যবহার করে কৃষিতে সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বর্তমানে কুড়মাইল ও কামারপাড়ায় খাঁড়িপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় এই জলকে ব্যবহার করে চাষের কাজ করা হয়।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে মৎসচাষ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘুসকিতে বাংলার নদীয়ালী মাছ দেখতে পাওয়া যায়। বর্ষাকালে ট্যাংরা, তিনকাটা, গুচি, মাগুর ইত্যাদি প্রায় লুপ্ত হতে চলা দেশী মাছ দেখতে পাওয়া যায়। বাদামাইল, কামারপাড়ার লেবেলগেট সংলগ্ন এলাকা এবং মধুপুরে স্থানীয় জেলেরা নৌকার ব্যবহার করে মাছ সংগ্রহ করেন।

এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট জালের বাঁধ দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ ছেড়ে মৎসচাষ করলে উপার্জন ও জীবিকার এক নতুন দিকের যে উন্মোচন হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। ঘুসকি নদীর গতিপথ এলাকাগুলিতে বিক্ষিপ্তভাবে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন নিবিড় বনসৃজন লক্ষ্য করা যায়। তবে স্থানীয় প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে ঘুসকির দুইপার ধরে নিবিড় বনসৃজন করলে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও পরিবেশ সংরক্ষণ দুইই হতে পারে। এই নদীর গতিপথে প্রচুর বাঁক লক্ষ্য করা যায় ; যেখানে বছরের দীর্ঘ সময় জল দাঁড়িয়ে থাকে।

স্থানীয় লোকজন মূল গতিপথ থেকে চ্যানেল করে সেই জলকে কৃষিকাজে ব্যবহার করে। এটি কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায়। স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে উদ্যোগ নিয়ে ছোট ছোট জলাধার তৈরী করলে চাষবাসের কাজ আরো ত্বরান্বিত হতে পারে। কামারপাড়ায় হাতিবান্ধা নামক স্থানে ঘুসকির গতিপথ বেঁকে প্রবাহিত হওয়ায় জায়গাটি একটি ইংরেজি ‘ও’ অক্ষরের ছোট দ্বীপের মতো দেখতে হয়েছে। ১০ নং অমৃতখন্ড অঞ্চল গ্রাম পঞ্চায়েত একশো দিনের প্রকল্পে একটি ইকোপার্ক তৈরীর প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে এলাকার নদী পর্যটনের উদ্যোগ নেওয়া হলে এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নে এই নদী যে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করবে এটা বলা বাহুল্য।

কুড়মাইল ও মধুপুরের কাছে এর গতিপথে ও কুড়মাইলে আলাউদ্দিন মন্ডলের বাগানে প্রচুর পরিযায়ী পাখি যেমন শামুকখোলের আনাগোনা দেখা যায়। সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে জীববৈচিএ্য ও বনসংরক্ষণে একটি নতুন দিশা দেখা যাবে। স্বাধীনতার পূর্বে এমনকি ষাটের দশকেও এই ঘুসকির নদীপথকে কাজে লাগিয়ে পণ্য পরিবাহিত হতো।

ঝিনাইপোতা গ্রামে এসে সেই পন্য পরিবাহী নৌকা পুনরায় নির্দিষ্ট স্থানে যাত্রা শুরু করতো। পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা করে ছোট ছোট নৌকার মাধ্যমে এখনো পণ্যপরিবহনের পুরো সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের সাথে নদীপথে আন্তর্জাতিক পণ্যপরিবহন হতে পারে বলেও স্থানীয় মানুষের প্রত্যাশা। দক্ষিণ দিনাজপুরে হারিয়ে যাওয়া নদীর মধ্যে ঘুসকি এমনই একটি সম্ভাবনাময় নদী যার একটি ইতিহাসগত প্রেক্ষাপট রয়েছে। সমস্ত দিক বিবেচনা করে এর পুনরুজ্জীবনের ব্যবস্থা হলে জল ও জীবন দুইই পাবে এক নতুন ঠিকানা, নতুন আশ্রয়!

বাজই অ লো সহি হেরুঅ বীণা

সুন অন্তি-ধনি বিলসই রুণা

চর্যার এই ছোট দুটি লাইনের মতো ঘুসকির জলতরঙ্গ সুর, তাল, লয় বেয়ে বয়ে নিয়ে যায় সুদূর অতীতের কোন এক বিকেলবেলায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বন্দে আলী মিঞার “আমাদের ছোট গ্রাম…” পড়তে পড়তে চোখ পড়ে যেত প্রচ্ছদে। দেখতাম ঠিক আমাদের এই গুসকিই যেন বইয়ের পাতায় উঠে এসেছে। অবিকল একেঁবেঁকে চলেছে ছোট গ্রামের পাশ দিয়ে। এই নদীর ধারেই বড় হওয়া তাই নদী ও মানুষের আন্তঃ সম্পর্ক এ শুধুমাত্র উপলব্ধি নয়; বলা যেতে পারে এ এক নদীযাপন! প্রত্যেকদিন দেখা হত, কথাও হত।

গ্রামীণ বাংলায় আগে খুব বেশি পাকা সেতু থাকতো না। কিছু জায়গায় এই পাকা সেতুর ব্যবস্থা ছিল। আমরা সেই সৌভাগ্যবান ছিলাম যে বিদ্যালয়ে যাবার রাস্তাটিও ছিল এই সেতু ধরেই। দেখতাম ব্রীজ থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে। জলের বেগ অনেক বেশি থাকায় কত ফেনা হত। ঢিল মারা, থুতু ফেলা দেখা যে জলের স্রোতে কার থুতু কতদূর আর কত তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারে। যারটা প্রথম হত সে জয়ী বলা ধরা হত!

গ্রীষ্মকালে যখন জল শুকিয়ে আসতো তখন বাড়ি থেকে একটা থাল নিয়ে কাদার মধ্যে চলতো মাছ ধরার হিড়িক। কাদা ছোড়াছুঁড়ি আর ধাক্কা দিয়ে ফেলে মজার দিনগুলো ফিরিয়ে দিত গ্রামীণ লোক উৎসব “দধিকাদো” র দিনগুলি। বর্ষা আসলেই ছোট ছিপ বগলদাবা করে আটার গুলি নিয়ে সোজ্জা ঘুসকি! দেখতাম অবাক হয়ে আমাদের ছোট নদী কিভাবে আমাদের আত্মীয় হয়ে উঠছে। কিছুটা অংশে শাপলা ছিল বিশেষ করে কুড়মাইলের দিকটায়। পদ্মও ছিল।

ছোটবেলায় দেখেছি দুর্গাপূজার সময় পদ্ম তোলার হিড়িক। আর ভ্যাটের মাঝখানের অংশটা তো খাওয়া একটা রীতিই ছিল। কত ছোট ছোট নৌকা আগে যেত, এই ঘুসকির বুকের উপর দিয়ে! একটি জায়গায় নৌকাডুবি হবার জন্য তো নামই হয়ে গেল “নাওডোবা”। শুধু দুপুর আর সন্ধ্যা বেলা ছিল নিষেধ। বাড়ি থেকে বলতো – খবরদার পাশেই শ্মশান ; মাথা ঠেসে ধরবে কিন্তু। ভয় তো ছিলই; অগত্যা দল ধরেই যেতাম।

নদীর ধারে হাতিবান্ধায় চলতো কিতকিত, গাদল ইত্যাদি গ্রামীণ খেলা। প্রতিবার বৈশাখ মাসে নদীর ধারে শ্মশানকালী পূজা উপলক্ষে বসতো বাউল গানের আসর আর মেলা! সারারাত দুদিন নদীর ধারে বাউলের সুর ভেসে যেত অনেক দূর ; নাম না জানা কোন অচিনপুরে! যেখানে অকূল দরিয়ার কোন কূল থাকে না ; হয়তো সেখানে।

গোটা জীবনের সাথে জুড়েছে এই নদী। লালিত করেছে হাজারো মানব জীবন। আজও ইচ্ছে হয় ছোটবেলার সেই দিনগুলোর মতো সাদা কাগজের নৌকায় ভর করে বেড়িয়ে পড়ব ঝিঁঝিঁপোকার ডাক আর অন্ধকারে জোনাকির আলো খুঁজতে! বলবো -ও নদীরে….. একটা কথাই শুধায় শুধু তোমারে………..।

কৌশিক বিশ্বাস : শিক্ষক ও লেখক।

আরও পড়তে পারেন….
স্মৃতির লোহালিয়ায় আজও ভাসে মন ।। মো.ইউসুফ আলী
নদী একটাই ।। রাজেশ ধর
কালনির স্নিগ্ধতায় আমার ছেলেবেলা ।। আলম মাহবুব

সংশ্লিষ্ট বিষয়