নদী বাঁচাতে জীবন দিলেন তিনি। জন্ম হলো এক মর্মান্তিক বিয়োগগাথার, শ্রদ্ধায় অবনত হলো মস্তক। ভারতের গঙ্গা নদীকে দূষণ থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন তিনি। করেছিলেন ১১১ দিন অনশন। সরকার তাঁর কথা শোনেনি। অনশনরত অবস্থাতেই ভারতের হরিদ্বারে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। গঙ্গাকে বাঁচাতে বহু লড়াই করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এই মানুষটির নাম জি ডি আগরওয়াল। গত ২২ জুন থেকে হরিদ্বারে অনশনরত ছিলেন তিনি। সরকার আবেদন শোনেনি, তিনিও ছাড়লেন এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর মায়া।
জি ডি আগরওয়াল স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানাদ নামেও পরিচিত ছিলেন। পরিবেশকর্মী জি ডি আগরওয়াল ১১১ দিন অনশনরত ছিলেন। গত বুধবার উত্তরাখন্ড পুলিশ তাঁকে জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করে। আইআইটি কানপুরের প্রফেসর ছিলেন জি ডি আগরওয়াল। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্যও ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে জি ডির সঙ্গে শেষ দেখা। দক্ষিণ এশিয়ার পরিবেশ জলবায়ু উন্নয়ন প্রাকৃতিক সম্পদের ন্যায্য ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে এক বিশাল বাহাসে তাঁকে নিয়ে আসা হয়েছিল। নাম-পরিচয়ে তিনি ছিলেন স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ। দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশ থেকে আসা, এমনকি ভারতের তরুণ পরিবেশকর্মীদের অনেকেই তাঁকে ধর্মগুরু কিছিমের লোক মনে করেছিলেন। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আইআইটি) সাবেক অধ্যাপক ও ভারতের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একসময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য (মেম্বার সেক্রেটারি) জি ডি আগরওয়াল দাড়ি আর গেরুয়া পোশাকে হারিয়ে যাননি কখনো।
সেবার কাঠমান্ডু আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ভারতের ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে সবাই আশঙ্কা ব্যক্ত করছিলেন। গেরুয়াবসনা জেডিরও শঙ্কা অব্যক্ত থাকেনি। তবে তিনি বরাবরই নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদিকে ভাই বলেই উল্লেখ করছিলেন। ধর্মের লেবাস পরা বেনিয়ারা যে দিকে দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা কবজা করছে, তাতে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না। তবে বিজেপি-মনোনীত মোদির প্রতি একটু যেন ভরসার গন্ধ ছিল তাঁর কথাবার্তায়। দামোদর একটা নদীর নাম, নদীর নামের মানুষ নদীকে অন্য চোখে দেখবে, ব্যবসার চোখে দেখবে না—এই আবেগপ্রবণ ব্যাখ্যা বা বিশ্বাস কি তাঁর ছিল?
অনশন শুরুর আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে গঙ্গা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে যে চিঠি তিনি লেখেন (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮), সেখানেও তিনি ভাই বলেই সম্বোধন করেছিলেন। প্রায় চার মাস উত্তরের অপেক্ষায় থেকে প্রধানমন্ত্রীকে দ্বিতীয় চিঠিও লিখেছিলেন ভাই সম্বোধনে (১৩ জুন ২০১৮)। দ্বিতীয় চিঠিরও উত্তর না পেয়ে ২০১৮ সালের ২২ জুন থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন জি ডি। অনশনের মাসখানেকের মাথায় গঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীরা তাঁদের প্রতিবাদ আন্দোলন আরও বেগবান করে তোলেন। ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী হারিস রাওয়াত জলমানব বা ওয়াটারম্যান হিসেবে নিরাপদ পানি আন্দোলনের পুরোধা ড. রাজেন্দ্র সিংসহ অনেকে নানা প্রতিবাদে যোগ দিতে থাকেন। তাঁরা জে ডির জীবন রক্ষার্থে অনশন শেষ করার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। রাহুল গান্ধী আর শরৎ যাদবের সঙ্গে দেখা করেন। সিদ্ধান্ত নেন, হৃষিকেশ থেকে দিল্লি পর্যন্ত গঙ্গা পদযাত্রা হবে। এর মধ্যে অনশনের দেড় মাস কেটে যায়, মোদির নীরবতা কাটে না। এবার জি ডি শেষ চিঠি লেখেন প্রধানমন্ত্রীকে (৫ আগস্ট)। এ চিঠিতে আর ভাই বলে সম্বোধন না করে শুধুই ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ লিখেছিলেন তিনি। বলেছিলেন ‘আমার অনুরোধগুলো সরকার না মানলে আমি অনশন চালিয়ে যাব। আর তার জন্য মরতে হলে মরব।’
কী অনুরোধ ছিল তাঁর
গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার জন্য গঙ্গা মহাসভার (গঙ্গা রক্ষার জন্য একটি জনপ্রিয় কিন্তু অরাজনৈতিক গণ-উদ্যোগ) বানানো খসড়া বিলটিকে তাড়াতাড়ি লোকসভায় পেশ করুন; আলোচনা শুরু হোক। এই খসড়া বিল প্রায় তিন বছর ফাইলের নিচে চাপা পড়ে আছে। লম্বা আলোচনায় কালক্ষেপণ না করে বিলের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম থেকে নবম অনুচ্ছেদ পর্যন্ত সুপারিশগুলোকে অবিলম্বে রাষ্ট্রপতির অরডিন্যান্স জারির মাধ্যমে কার্যকর করুন। কারণ, গঙ্গার মৃত্যু আপনাদের আলোচনার জন্য থেমে থাকবে না।
অলকানন্দা, ধৌলিগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিন্দার ও মন্দাকিনীতে নির্মাণাধীন সব জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ অবিলম্বে বন্ধ করুন।
গঙ্গা অববাহিকায় প্রস্তাবিত অন্য সব জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বিশেষ করে হরিদ্বার-কুম্ভসহ অববাহিকার যেসব জায়গায় খননকাজ চলছে, তা বন্ধ করুন।
নদী ও নদীতীরবর্তী এলাকা থেকে বালু উত্তোলন এবং গাছ কাটা বন্ধ করুন।
গঙ্গার পরিচ্ছন্নতা আর সুস্থতার সঙ্গে প্রবাহ বজায় রাখার বিষয়গুলো তদারকের জন্য পূর্বপ্রতিশ্রুতিমোতাবেক একটা স্বাধীন নিরপেক্ষ সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করুন।
এসব কোনো অনুরোধেরই জবাব দেননি প্রধানমন্ত্রী মোদি। তবে শেষ চিঠি পাওয়ার পর তাঁকে একটা চিঠি লিখেছিলেন মোদি সরকারের জলসম্পদ ও ‘গঙ্গা বাঁচাও’ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি। চিঠিতে তিনি অনশন তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু দাবি না মানা হলে অনশন চালিয়ে যাবেন বলে জি ডি আগেই ঘোষণা করেছিলেন। বিজেপির গেরুয়াবসনা নেত্রী উমা ভারতীকেও পাঠিয়েছিল হাইকমান্ড। জি ডিকে টলানো যায়নি।
লেবু, মধু, জল ছাড়া আর কিছু গ্রহণ করেননি জি ডি দীর্ঘ ১০৯ দিন। তারপর বন্ধ করে দেন সেই জলগ্রহণ। পুলিশ এসে চ্যাংদোলা করে হৃষিকেশের এইমস হাসপাতালে নিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। সেই চাপেই তাঁর প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়। ডাক্তার মৃত্যুসনদে লিখেছেন, জি ডি মরেছেন হার্ট অ্যাটাকে, অনশনে নয়।
অনশনে সফলতার স্বাদ জি ডি প্রথম পান ২০১০ সালে উত্তরাখন্ডে গঙ্গাকে বেঁধে ৬০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ লহারিনাগ পালা প্রকল্প নিয়ে। সেবার তাঁর আমরণ অনশনের সামনে সরকার প্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা মেনে নিয়ে পিছু হটে। এরপর মনমোহন সরকার গঙ্গার ওপর যেকোনো প্রকল্প আর গঙ্গার নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ ঠিক রাখার দায়িত্ব দিয়ে গঠন করেন ন্যাশনাল গঙ্গা রিভার বেসিন অথোরিটি বা জাতীয় গঙ্গা অববাহিকা কর্তৃপক্ষ (এনজিআরবিএ)। দাবি অনুযায়ী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এই কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান করা হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সভা আর ডাকা হয় না। আজ–কাল করে ১৮ মাস কেটে যায়। জি ডি আবার অনশনে বসেন। অনশনের আড়াই মাসের মাথায় জলগ্রহণও বন্ধ করে দেন। সরকারের টনক নড়ে, তাঁকে বিমানে করে দিল্লির হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মনমোহন সিং কাঙ্ক্ষিত সভা তলব করেন। জি ডি অনশন ভাঙেন। এবার সবাই ভেবেছিল, মোদি শেষ পর্যন্ত ছুটে আসবেন, আশ্বাসে অনশন প্রত্যাহার করবেন জি ডি। সেটা হলো না। গঙ্গা তার এক প্রেমিককে হারাল।
ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, আইআইটি কানপুরের অধ্যাপক আর কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্যসচিব একজন আধুনিক পরিবেশবিজ্ঞানী আর আন্দোলনের অগ্রপথিক প্রফেসর গুরুদাশ আগরওয়াল ২০১১ সালে হঠাৎ কেন সাধুর দীক্ষা নিয়ে স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ হলেন? সেই বছরে (২০১১) টানা ৬৮ দিন অনশনে থেকে তরুণ সাধক স্বামী নিগামান্দ সরস্বতী মৃত্যুবরণ করেন। তিনিও চেয়েছিলেন গঙ্গা দূষণমুক্ত হোক। হরিদ্বার আর কুম্ভ মেলা এলাকায় বেআইনিভাবে খনিজ উত্তোলন বন্ধ হোক। খনি–দস্যুদের হাতে গঙ্গা দূষিত হচ্ছিল, খোলা খনির অনিরাপদ বর্জ্য নদীকে মেরে ফেলেছিল, সাধুসন্তদের একত্র করে এক গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তিনি। জি ডির কি মনে হয়েছিল, যে দেশের মানুষ নদীকে ভগবান জ্ঞান করে, সে দেশে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে নদী রক্ষার একটা উপায়ে সাধুদের সংগঠিত করা যাবে? ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নানা দিক নিয়ে জি ডির নিজস্ব মূল্যায়ন ছিল। তিনি একটা নতুন পথ খুঁজছিলেন কি? সে আলোচনা আমাদের এগোয়নি। নেপালের এভারেস্টের দিকে চোখ রেখে বলেছিলেন, ‘বলব তোমাকে।’ সেটা আর শোনার পথ রইল না। তবে গঙ্গার পক্ষে লড়াইয়ের লোকের অভাব হবে না। গুরুদাশরা মরে না। গঙ্গা মরবে না।
গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণকর্মী, গবেষক। সূত্র: প্রথম আলো, ১৫ অক্টোবর ২০১৮।।