আধুনিক ভারতীয় সভ্যতার বিষম ভয়ঙ্কর দিকগুলি তাঁহারা নিজেদের প্রাণ দিয়া দেখাইয়া গেলেন

জাহ্নবী-যোদ্ধা

বাইশে জুন হইতে এগারো অক্টোবর— প্রায় চার মাসের যুদ্ধ তবে শেষ হইল। ছিয়াশি বৎসর বয়সে জি ডি অগ্রবাল, সন্ন্যাসগ্রহণের পর যাঁহার নাম হইয়াছিল স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ, চার মাস পূর্বে, বাইশে জুন গঙ্গাদূষণের নিরাময়কল্পে আমরণ অনশনের মাধ্যমে যে যুদ্ধটি শুরু করিয়াছিলেন, তাহা সমাপ্ত হইল। দীর্ঘ অনশনের ফলে তাঁহার দেহ জীর্ণ ও অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছিল, কিন্তু নিজের সঙ্কল্প হইতে তাঁহাকে এক বিন্দু টলানো যায় নাই। এত বড় যুদ্ধ দিয়াও কোনও ভাবে তিনি তাঁহার কল্পনার পবিত্রপ্লাবিনীকে ফিরাইয়া আনিতে পারেন নাই।

ফিরাইয়া আনা অসম্ভব ছিল। কেননা যে নদীকে তিনি ও তাঁহার মতো অসংখ্য মানুষ পূতপবিত্র বলিয়া মনে করেন, যাহার জল সেবনে আত্মিক শুদ্ধতা ফিরিয়া পাওয়া যায় বলিয়া বিশ্বাস করেন, সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলিতেছে, মানবদেহ যে সীমা পর্যন্ত ব্যাকটিরিয়া সহন করিতে পারে, গঙ্গানদীর জল পানের ফলে তাহার তেরো গুণ বেশি ব্যাকটিরিয়া মানবশরীরে প্রবেশ করে। স্বামী জ্ঞানস্বরূপ সানন্দ ভাগ্যবান, স্বেচ্ছায় তাঁহার প্রয়াণ হইয়াছে।

ভারতের যে নাগরিকরা গঙ্গানদীর পবিত্রতার উপর আস্থা রাখিয়া তাহার জল পান করিতেছেন, তাঁহাদের প্রয়াণও হয়তো প্রতি দিন ত্বরান্বিত হইতেছে— তবে স্বেচ্ছায় নহে, অজান্তে। আর, ইত্যবসরে গঙ্গানদীর শোধনকল্পে বিরাট অঙ্কের ফান্ড গড়িয়া হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বিশ্বাসসাগর হইতে প্রতি দিন অমৃতমন্থন করিতেছে— লক্ষ্য কোনও ভাবে পূর্ণ না করিয়াই তাঁহারা গৌরবে দিন দিন স্ফীতবক্ষ।

মোদী সরকারের অধীনে জাতীয় স্তরে গঙ্গাশোধনের জন্য রিভার বেসিন অথরিটি তৈরি হইবার পর পরই স্বামী জ্ঞানস্বরূপ প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখিয়াছিলেন। সেই চিঠির বক্তব্য ছিল, নদীশোধন সত্যই সরকারের অভিপ্রায় হইলে এখনই যেন বড় মাপের কলকারখানাগুলি নদীর পাড় হইতে সরাইয়া লওয়া হয়, অথবা বন্ধ করা হয়। দূষণকারী কারখানা ও নদীস্রোতরোধকারী প্রকল্পগুলি নদীর সর্বনাশ করিতেছে, বারংবার তিনি সে দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। অলকানন্দা ও মন্দাকিনী নদীর উপর প্রকল্পগুলি বিষয়ে সত্বর পদক্ষেপ করিতে অনুরোধ করেন।

অধ্যাপক জি ডি আগরওয়াল

তাঁহার এই সব অনুরোধে ও প্রস্তাবে দৃকপাত করিবার সময় কাহারও হয় নাই। যদিও সরকারি কর্তারা অবগত যে, অতীব কৃতী ছাত্র জি ডি অগ্রবাল কিন্তু এই বিষয়ে গবেষণা করিয়াছেন, প্রখ্যাত ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া (বার্কলে) হইতে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডক্টরেট করিয়াছেন, সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের প্রথম সচিব নিযুক্ত থাকিয়াছেন, এবং ভাগীরথী ও অন্যান্য নদীর উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির বিরুদ্ধে দৃঢ় মত দিয়া আসিয়াছেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার যে কোনও সদস্য অপেক্ষা তিনি এ বিষয়ে অধিকতর জ্ঞানী ও বিবেচনাক্ষম। অথচ তাঁহার সতর্কবাণী কিংবা প্রস্তাবসমূহে বর্তমান কিংবা পূর্বতন কোনও সরকারই কর্ণপাত করে নাই।

প্রসঙ্গত, জি ডি অগ্রবাল হইলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি যিনি গঙ্গার শুদ্ধিকরণের দাবিতে প্রাণত্যাগ করিলেন। ইতিপূর্বে স্বামী নিগমানন্দ সরস্বতী ২০১১ সালে ১১৪ দিনের অনশনের পর মৃত্যুবরণ করিয়াছিলেন। আধুনিক ভারতীয় সভ্যতার বিষম ভয়ঙ্কর দিকগুলি তাঁহারা নিজেদের প্রাণ দিয়া দেখাইয়া গেলেন। কিন্তু ভারতীয় নাগরিকরা যথেষ্ট চোখ মেলিয়া দেখিলেন কি, কান খুলিয়া শুনিলেন কি? রাজনীতিকরা যে দেখিবেন না এবং শুনিবেন না, তাহা বলিবার অপেক্ষা রাখে না। এমনকি বিজেপি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ যখন দিনকয়েক আগে তাঁহার প্রধানমন্ত্রীর চরিত্রশুদ্ধতা বিষয়ে ‘গঙ্গাজল’-এর উপমাটি ব্যবহার করিলেন, তখনও তাঁহার মনে পড়িল না গঙ্গার প্রকৃত পরিস্থিতির কথা!

সূত্র: আনন্দবাজার, সম্পাদকীয়, ১৩ অক্টোবর, ২০১৮ ।।

আরো পড়তে পারেন…

গঙ্গা দূষণের প্রতিবাদে ১১১ দিন টানা অনশন : মারা গেলেন জিডি আগরওয়াল

সংশ্লিষ্ট বিষয়